ভূমিকাঃ নৈতিকতার মানদণ্ড সম্পর্কীয় মতবাদ হিসেবে স্বজ্ঞাবাদের গুরুত্ব অপরিসীম। স্বজ্ঞা কোনাে রকম বিচার বুদ্ধির সাহায্য ছাড়াই কোনাে বিষয় সম্পর্কে আলােচনা করে। মানুষের অন্তরে বিবেক বা স্বজ্ঞা নামে একটা বৃত্তি রয়েছে। যার সাহায্যে মানুষ তার কাজের সরাসরি নৈতিক বিচার করতে পারে।
বাটলারের স্বজ্ঞাবাদঃ বিশপ বাটলার ছিলের গ্রেট ব্রিটেনের একজন প্রসিদ্ধ স্বজ্ঞাবাদী নীতিদার্শনিক। তিনি নীতিবােধ বা সৌন্দর্যবােধ সম্পর্কীয় স্বজ্ঞাবাদী মতকে খণ্ডন করে বলেন যে, নৈতিক অবধারণের ক্ষেত্রে অনুভূতি বা বােধশক্তিই পরম মানদণ্ড নয়। বরং বিবেকই হচ্ছে নৈতিক অবধারণের ক্ষেত্রে পরম মানদণ্ড। বাটলার মনে করেন, নীতিবােধ নয় বরং বিবেকই স্বজ্ঞামূলক শক্তি। তিনি স্বজ্ঞামূলক বৃত্তির জন্য ‘নীতিবোধ’ শব্দটিকে ‘বিবেক’ নাম দিয়েছেন। কারণ তিনি মনে করেন যে, ন্যায়-অন্যায়ের জ্ঞান অনুভূতির চেয়ে বরং বিচার বুদ্ধির ব্যাপার। তিনি মনস্তাত্ত্বিক সুখবাদকে খণ্ডন করে বলেন যে, সুখের পরিবর্তে বস্তুই মানুষের কাম্য। মানুষ কখনাে সুখকে কামনা করে না, বরং সে বস্তুকে বেশি করে কামনা করে। বস্তু লাভ করেই মানুষ সুখ পায়।
মানব মন একটা সংগঠনঃ বাটলার তার নৈতিক মতবাদকে মানব প্রকৃতি সম্পর্কিত নিরীক্ষিত ঘটনাবলির উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি মনে করেন মানব মন একটা সংগঠন, যা এমন অনেক উপাদান দ্বারা গঠিত, যে উপাদানগুলাের কতকগুলাে অপরগুলাে দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তিনি মানব মনের সংগঠনকে ব্রিটিশ সংবিধানের সাথে তুলনা করেছেন। ব্রিটিশ সংবিধানে যেমন রাজা ‘হাউস অব লর্ড’। হাউস অব কমন্স’ এদের প্রত্যেকেরই বিশেষ বিশেষ কার্যাবলি রয়েছে এবং এদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে। বাটলার মনে করেন, এসব সম্পর্ক হলাে প্রাকৃতিক এবং এভাবে নৈতিক নিয়ম হচ্ছে প্রাকৃতিক নিয়ম, নৈতিক নিয়ম প্রথা বা প্রচলিত রীতির ফল নয়।
স্বাভাবিক প্রবৃত্তিঃ বাটলার সব মানুষের মধ্যে চার রকমের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি রয়েছে বলে মনে করেন। নিম্নে সে সম্পর্কে আলােচনা করা হলাে।
প্রথমত, মানব মনের মধ্যে কতকগুলাে বিশেষ বৃত্তি রয়েছে ক্ষুধা, যৌন কামনা, ভয়, হিংসা ইত্যাদি হচ্ছে এই ধরনের প্রবৃত্তির প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এই প্রবণতাগুলাের কতকগুলাে প্রধান ব্যক্তির স্বার্থ এবং কতকগুলাে প্রধানত অপর মানুষের স্বার্থকে রক্ষা করতে চায়।
দ্বিতীয়ত, শান্ত আত্ম অনুরাগের সাধারণ নীতি রয়েছে। এই ধরনের নীতি বলতে বাটলার ব্যক্তির সর্বাধিক সুখের প্রবণতাকে বুঝিয়েছেন। বাটলার এই নীতিকে একটা বৌদ্ধিক নীতি বলে মনে করেন।
তৃতীয়ত, উদারতা বা পরােপকারিতার সাধারণ নীতি রয়েছে। এই নীতিও এক প্রকার বৌদ্ধিক নীতি। যা অপর মানুষের জন্য সাধারণ সুখ বৃদ্ধি করতে চেষ্টা করে।
চতুর্থত, বিবেকের নীতি রয়েছে, যার কর্তৃত্ব সবার উপরে। তার মতে, বিবেক এক দিকে বিচারধর্মী এবং অপরদিকে স্বজ্ঞামূলক। বিবেক ন্যায়ত্বের নিয়মের উপর বিচার বিবেচনার নীতি।
সমালােচনাঃ বাটলারের স্বজ্ঞাবাদের সমালােচনাসমূহ নিম্নে তুলে ধরা হলাে-
প্রথমত, বাটলার নীতিবােধ বা সৌন্দর্যবােধ সম্পর্কীয় মতকে খণ্ডন করে যদিও বলেন যে, নৈতিক অবধারণের ক্ষেত্রে অনুভূতি বা বােধশক্তি পরম মানদণ্ড নয়, বরং বিবেকই পরম মানদণ্ড, তাহলে তার স্বজ্ঞাবাদ ও স্বজ্ঞাবাদের অন্যান্য রূপের মত ত্রুটিপূর্ণ।
দ্বিতীয়ত, বাটলার একদিকে যেমন একজন নিষ্ঠাবান ধর্মযাজক, অন্যদিকে তেমনি একজন স্বজ্ঞাবাদী চিন্তাবিদ। তাই স্বাভাবিকভাবে তার মতবাদে এটা পরিলক্ষিত হয় যে, তিনি একদিকে বিবেককে বিচারধর্মী বলেছেন এবং অপরদিকে স্বজ্ঞামূলক বলেছেন। স্বজ্ঞাবাদ ব্যক্তি নির্ভর হওয়ায় কোনাে ক্রিয়ার ভালােত্ব-মন্দত্ব নিরূপণ করা সম্ভব নয়।
তৃতীয়ত, বাটলারের মতে, বিবেকের স্থানই সর্বোচ্চ এবং যখন আত্ম অনুরাগের নীতি ও পরােপকারিতা নীতির মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা যায়, তখন বিবেকের রায়ই চূড়ান্ত। কিন্তু তিনি বিবেক সম্পর্কে যা বলতে চেয়েছেন তা সন্তোষজনক নয়।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, নৈতিকতার মানদণ্ড সম্পর্কীয় মতবাদ হিসেবে বাটলারের স্বজ্ঞাবাদ একটা সন্তোষজনক মতবাদ নয়। কিন্তু তিনি স্বজ্ঞাবাদের ভিত্তিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে যেসব যুক্তি উপস্থাপন করেছেন নীতিবিদ্যার আলােচনায় সেগুলাের মূল্য অপরিসীম।
Leave a comment