বাংলা সাহিত্যের পথচলার শুরু তার হৃদয়ের নির্দেশে, যে হৃদয় তার আপন দেশের পরিচয়ে সুচিহ্নিত। তবু বাংলাদেশের সংস্কৃতি পূর্ববর্তী ধারা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন কোনো স্বয়ংজাত ব্যাপার নয়। প্রধানত সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষার আশ্রয়ে বাংলা সাহিত্যের আদি অধ্যায় প্রকাশিত। গুপ্তযুগ থেকে মুসলমান বিজয়ের আগে পর্যন্ত বিভিন্ন রচনায় তার লক্ষণ স্পষ্টরেখ।

প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাঙলা শুধু ভৌগোলিক কারণে সুজলা সুফলা নয়, তা বহুস্তরী চৈতন্য সম্ভাবনাও। উত্তর ভারতের ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কৃতির ঢেউ এদেশে পৌঁছাবার আগেই ‘সংস্কৃতের’ অনুপ্রবেশ ঘটেছিল পূর্ব ভারত থেকে আগত আর্যদের সঙ্গে। অবশ্য তাদের আচরণ ও উচ্চারণ সম্পর্কে নিন্দের বান ডেকেছিল—“অসুরাণাম্ ভবেৎ বাচঃ গৌড্র পুন্ড্রোদ্ভব সদা’ ( ‘আর্যমঞ্জুশ্রীকল্প’)। তবু তাঁদের ব্যবহৃত পোশাকী ভাষা বা আধিমানসিক ‘রাষ্ট্রভাষা’ রূপে সংস্কৃত ছড়িয়ে পড়েছিল বণিক, শাসক ও পুরোহিত সম্প্রদায়ের মধ্যে।

আবার সর্বভারতীয় সংস্কৃতির কায়াবিন্যাসে সংস্কৃত-জাত মানসিকতার সঙ্গে ছিল আর্যেতর মানসের প্রভাব। ভাষাচার্য সুনীতিকুমার জানিয়েছেন : “Sanskrit in its origin is an Aryan or Indo-European Language, as we know, But in its evolution on the soil of India the non-Aryan people had a share in its development…” (Journal of the Asiatic Society of Bengal, 1950. P. 148) মাগধী প্রাকৃত ও অপভ্রংশের মধ্যে প্রাচ্যখণ্ডে আদিম আর্যেতর কৌমজাতি তাদের ভাষাগত অস্তিত্ব রক্ষা করে। মহাযান শাখার ‘উপযানের’ মধ্যে, নাথসাহিত্যে, শিবের গাজন ও গম্ভীরা গানে, বৌদ্ধ বৈষ্ণব সহজিয়ার ভাবসম্পদের মধ্যে তার সেই ভাবনা নানাভাবে উদঘাটিত হয় ব’লে পণ্ডিতজনের অভিমত। বাঙালীর সাহিত্য ও সংস্কৃতি তাই আর্য ও অনার্য-মানসের বৈশিষ্ট্য নিয়ে ‘দ্বিরায়তনিক’ প্রকৃতিতে দেখা দেয়।

মৌর্যযুগ থেকেই সম্ভবত বাংলাদেশে আর্যভাষা ও সংস্কৃত ও প্রাকৃত) ও সাহিত্যের প্রসার আরম্ভ হয়। কারণ খ্রীস্টপূর্ব যুগে বাংলার সংস্কৃত ভাষার সবচেয়ে যে প্রাচীন লেখ্য নিদর্শন পাওয়া যায় তা মহাস্থান থেকে প্রাপ্ত একটি অনুশাসন। অনুশাসনটি ব্রাহ্মী অক্ষরে উৎকীর্ণ মাগধী প্রাকৃত লেখা। রাজাজ্ঞা জ্ঞাপক এই লিপিটি দেখে মনে হয় এ যুগে বাংলাদেশে প্রাকৃত ভাষা ছিল রাজভাষার সম্মানপ্রাপ্ত। পরবর্তী অনুশাসনটি পাওয়া যায় শুশুনিয়া থেকে খ্রীস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে লেখা চন্দ্রবর্মণ রাজার প্রস্তরলিপি। এর ভাষা সংস্কৃত হলেও মনে হয় এভাষা তখনও আগন্তুক মাত্র। কেননা এই লিপিটি ছিল গদ্যে লেখা। পরবর্তীকালের বাঙালীর সংস্কৃত ভাষায় বিশেষ পারদর্শিতা অর্জনের ফলে প্রশস্তি লেখা হতে থাকে পদ্যে। পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত সংস্কৃত ভাষা ছিল লিপি-লেখনে কোনো প্রকারে ভাব প্রকাশের উপায় মাত্র। কিন্তু সেই সংস্কৃত ভাষা সপ্তম শতকের মাঝামাঝি, বিশেষভাবে পাল আমলের সূত্রপাত হতে অপূর্ব ছন্দ লালিত্যময় কাব্যময় ভাব প্রকাশের বাহন হয়ে উঠেছে—যেমন লোকনাথের লিপি, পাল আমলের লিপিগুলি প্রভৃতি।

উত্তর ও পশ্চিম ভারত থেকে ব্রাহ্মণগণ ও জৈন-বৌদ্ধ যতি-সন্ন্যাসীদের সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষার রচিত সংহিতা ও সাহিত্য গ্রন্থাদি নিয়ে এই দেশে আগমনের ফলে পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটে। আর্যভাষা স্থানীয় ভাষাকে ক্রমে ক্রমে পর্যুদস্ত করে ফেলে। ব্রাহ্মণদের টোলে এবং বৌদ্ধ বিহারগুলির মধ্যে শাস্ত্রচর্চা ছাড়া ব্যাকরণ, শব্দতত্ত্ব, ন্যায়, দর্শন, চিকিৎসা, বেদ, সঙ্গীত, চিত্রাঙ্কন, ছন্দবিদ্যা, জ্যোতিষ বিদ্যা প্রভৃতি সম্বন্ধে শিক্ষা ও চর্চা শুরু হয়।

খ্রীস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর মধ্যে বা তারও আগে থেকে বাংলায় সংস্কৃতভাষা যে রীতিমত প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, বিভিন্ন অনুশাসন ও গ্রন্থরচনার তথ্যগত সাক্ষ্যে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এই সময় প্রশস্তি বা অভিনন্দন রচনা করার উপযুক্ত ভাষারূপে ‘গৌড়ী রীতি’ স্বীকৃত হয়। বৈদ্যদেবের কমৌলি লিপি, নারায়ণপুরের, ভাগলপুরের তাম্রশাসন ইত্যাদির মধ্যে তার পরিচয় পাওয়া যায়— “সখলু ভাগীরথী-প্রবর্তমান নানাবিধ নৌবাট-সম্পাদিত-সেতুবন্ধ নিহিত-শৈলশিখর শ্রেণী-বিভ্ৰমাৎ…” ইত্যাদি অনুশাসন কাব্যগন্ধী, শব্দ-সমাস-সন্ধির অতিরিক্ত সমাবেশে ভাষার জড়োয়া কারুকার্যের দিকেই যেন রচয়িতাদের ঝোক বেশি। ওজঃ এবং কান্তি এই দুটি গুণ এই ভাষায় বর্তমান। এছাড়া ছিল আরো দুটি রীতি—‘বৈদভী’ ও ‘পাঞ্চালী’। বৈদর্ভী রীতির মধ্যে সঞ্চারিত থাকে দশটি গুণ–শ্লেষ, প্রসাদ, সমতা, মাধুর্য, সুকুমারতা, অর্থব্যাপ্তি, উদারত্ব, ওজঃ, কাস্তি ও সমাধি। ‘গৌড়ী’ রীতিতে মাধুর্য বা সৌকুমার্য কিছু কম এবং সমাসবহুল। ‘গৌড়ী’ ও ‘বৈদভী’ এই দুই রীতির প্রয়োজনীয়তা ও শ্রেষ্ঠতা নিয়ে দীর্ঘদিন পর্যন্ত ভারতের প্রাচীন আলঙ্করিকদের মধ্যে ছিল মতভেদ। ভামহ-দণ্ডী বাণভট্ট-বামন-বিশ্বনাথ প্রমুখ অধিকাংশ কাব্যবেত্তাই এই দুই রীতি বিষয়ে বিশেষ সচেতন ছিলেন দেখা যায়। শিষ্ঠভাষা হিসাবে ভারতের অন্যত্র এবং গৌড়বঙ্গেও সাহিত্যচর্চার পক্ষে উপযুক্ত শিল্পিত রীতিরূপে ‘বৈদভী’ হয়ে ওঠে অধিকাংশ কবির আশ্রয়। কারণ দশটি গুণে সমৃদ্ধ এই রীতি অবলম্বন করে অভিনব ও নিত্যনব প্রকাশভঙ্গীর অবকাশ ছিল বেশি। ধোয়ীর পবনদূত এই ‘বৈদভী’ রীতিতে লেখা, সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিতমানস’ ছিল গৌড়ীরীতির দৃষ্টান্ত। কিন্তু ঐতিহাসিক তাৎপর্যে বৈদর্ভীর প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী রূপে গৌড়ীরীতির স্বীকৃতি লাভের মধ্যে বাঙালী সাহিত্যিকদের সংস্কৃতভাষায় নতুন রচনারীতি আবিষ্কারের মৌলিক চিন্তাধারা লক্ষ্য করা যায়। বলা যায় না এই প্রচেষ্টা এককালের আর্য-উপেক্ষার সমুচিত প্রত্যুত্তর কিনা!

সংস্কৃত ব্যাকরণের আলোচনায়ও বাঙালী পণ্ডিতেরা অনুৎসাহী ছিলেন না। কিন্তু সর্বভারতীয় প্রচেষ্টার তুলনায় মৌলিক রচনার আয়োজন তেমন হয়নি। সংস্কৃত ব্যাকরণের চন্দ্রশাখার প্রবর্তক চন্দ্রগোমিনের আবির্ভাব হয় এই সময়। তাঁর গ্রন্থ থেকে কাসিকা ৩৫ সূত্র স্বীকার না করেই গ্রহণ করেছিলেন। আরো কিছু বৈয়াকরণদের নাম পাওয়া যায়। যেমন জিনেন্দ্রবোধি, গোবর্ধন, দামোদর সেন ও ইন্দু মিত্র; ‘কাতন্ত্র’, ‘মুগ্ধবোধ’, ‘সংক্ষিপ্তসার’, ‘সারস্বত’, ব্যাকরণের সব শাখার বাংলাদেশে অনুশীলন হয়। শব্দশাস্ত্র ও কোষগ্রন্থ ছিল সুভূতিচন্দ্রের ‘কামধেনু’, বন্দ্যঘাটীয় সর্বানন্দের ‘টীকাসর্বস্ব’, নামক অমরকোষের টীকা।

সংস্কৃত রসসাহিত্যে বাঙালী কৃতিত্ব নির্ণয় প্রসঙ্গে প্রধান বাধা কালগত এবং ব্যক্তিগত। কবিদের নিজের স্থান, কাল, ব্যক্তি পরিচয় সম্পর্কে অনীহা সংস্কৃত সাহিত্যে একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। সম্ভবত ভারতীয় মানসের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য “কস্য ত্বং বা কুত আয়াতঃ” ইত্যাদি প্রশ্ন তাঁদের কাছে অবান্তর ছিল। সেইজন্য বিশাখদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস’, ভট্টনারায়ণের ‘বেণীসংহার’, মুরারী মিত্রের ‘অনর্ঘরাঘব’, ক্ষেমীশ্বরের ‘চণ্ডকৌশিক’, নীতিবর্মার ‘কীচকবধ’, শ্রীহর্ষের ‘নৈষধচরিত’, অভিনন্দের ‘রামচরিত’, সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিতমানস’ প্রভৃতি গ্রন্থের কবিরা বাঙালী কিনা সে সম্বন্ধে জল্পনা হয়েছে। বলা বাহুল্য, পিছনে যুক্তিও কিছু আছে; যেমন বিশাখদত্তের ও ভট্টনারায়ণের গ্রন্থে গৌড়ীয় রীতি ব্যবহার, আদিশূর নামক রাজার সময়ে ভট্টনারায়ণের কৌলীন্য মর্যাদালাভের ঘটনা, মুরারি মিশ্রের নাটকে কলচুরী বংশের মাহিষ্মতী নগরীর উল্লেখ, ক্ষেমীশ্বরের নাটকের প্রস্তাবনায় মহীপাল নামক জনৈক রাজার নাম পরিচয় এবং সভায় অভিনয় হওয়ার বিবরণ, নীতিবর্মার কাব্যের পুঁথিতে বঙ্গাক্ষর ব্যবহার এবং বাংলাদেশে তার অধিকাংশ টীকা রচনার প্রমাণ, শ্রীহর্ষের কাব্যে নারীদের হুলুধ্বনি, শঙ্খবলয় ধারণ প্রভৃতি পরিচয়গত বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। কিন্তু ঐতিহাসিকের যুক্তিজাগর মনোভঙ্গিতে এগুলি কবিদের বাঙালী-সর্বস্বতার নিঃসংশয় নিদর্শন নয়। সাহিত্য সৃষ্টিতে পরিবেশগত প্রভাব কিছু থাকেই, কিন্তু সেইজন্যই যে তা সবসময় আঞ্চলিক হবে তা বলা যায় না। শেকসপিয়ারের নাটকে, জিওফ্রে চসারের কাব্যেও তার পরিচয় আছে। ‘রামচরিত’ ও ‘রামচরিতমানস’ গ্রন্থের দুই রচয়িতা যথাক্রমে অভিনন্দ ও সন্ধ্যাকর নন্দীর পরিচয় ইতিহাস-সমর্থিত। প্রথমজন দেবপালের এবং দ্বিতীয়জন রামপালের সভাকবি ছিলেন বলে প্রকাশ। কিন্তু ব্যক্তি পরিচয়ে বাঙালী হলেও ভাষার চতুরালী ছাড়া শিল্পসিদ্ধি এবং ভাববিস্তারে কোন বিশেষ সারস্বত গৌরবে তাদের চিহ্নিত করা যায় না। কারণ সংস্কৃতে সৃজনমুখী সাহিত্যের অবসান বহু আগে কালিদাস, অশ্বঘোষ, ভাস প্রমুখ মহাকবিদের রচনায় নিঃশেষিত হয়ে গিয়েছিল। তার পুনরুজ্জীবন এইসব কবি তো দূরের কথা ভারবি, ভট্টি, নৈষধের পক্ষেও সম্ভব হয় নি।

সঙ্কলন গ্রন্থসমূহঃ মহাকাব্যের শব্দ, শ্লোকের অরণ্যে যা ছিল পথহারা, ছোট ছোট উদ্ভট শ্লোকের মধ্যে বাঙালী কবিরা যেন তাদের হৃদয়ের গতিপথ খুঁজে পেয়েছিলেন।


অন্যদিকে অবক্ষয়ী সাহিত্যের যুগগত কারণে দেখা দিয়েছিল সঙ্কলনের প্রবণতা। বিস্মিত হতে হয় অন্তত খানচারেক সঙ্কলন গ্রন্থে এইযুগের সাহিত্যচর্চার অবিকৃত পরিচয় দেখে। এখানে প্রকাশিত ক্ষুদ্র কবিতাগুলির তন্ত্রী রূপটি সংস্কৃত-ঘেঁষা, কিন্তু তার বিষয় আর কল্পনার অলঙ্করণ বাঙালী কবির ঘরোয়া সারল্যে আঁকা। এই সঙ্কলনগুলি হল যথাক্রমে— ‘কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়’ (প্রকৃত নাম ‘সুভাষিত—রত্নকোষ), ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ বা ‘সৃক্তিকৰ্ণামৃত’, (সঙ্কলক : লক্ষণসেনের মহামাণ্ডলিক বটুদাসের পুত্র শ্রীধর দাস), ‘বিদগ্ধমুখমণ্ডল’ এবং ‘মানসোল্লাস’ প্রভৃতি। সাধারণভাবে বলা যায়, ১২শ ১৩শ খ্রীস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে এইগুলি সঙ্কলিত হয়। এই সঙ্কলন গ্রন্থগুলির ঐতিহাসিক গুরুত্ব হল

  • (ক) খ্যাতিমান প্রাচীন কবির সঙ্গে নবীন অপরিচিত বা সমকালীন কবিদের রচনাসমূহকে একত্রভাবে সন্নিবেশ করা।

  • (খ) সংস্কৃত সাহিত্যের অবক্ষয় এবং রুচি-বিকৃতিকে পূর্ববর্তী কবি-দৃষ্টির ঐতিহ্যের আশ্রয়ে রোধ করার প্রচেষ্টা।

  • (গ) সমকালীন-সচেতনতার অস্ফুট প্রকাশ, দরিদ্রমানুষের জীবনযাপন সম্পর্কে মমতা বা সহনশীলতা।

  • (ঘ) বিষয়-বৈচিত্র্যঃ রাজবৃত্তের বাইরে লোকজীবন থেকে কবিতার বিষয়-উপকরণ সংগ্রহ করার প্রবণতা।

  • (ঙ) সংস্কৃত ভাষা এবং বাংলা ভাষা বা মাতৃভাষার প্রতি কবিদের মমতা প্রকাশ। যেমন—‘কবীন্দ্ৰবচন’ গ্রন্থের একটি আর্যায় একজন বাঙালী কবি লিখেছেন :

“ঘন রসময়ী গভীরা রক্তিম সুভগোপজীবিতাকবিভিঃ। 

অবগাঢ় চ পুণীতে গঙ্গা বঙ্গাল বাণীষু ॥”

অর্থাৎ, গঙ্গা ও বাংলা ভাষায় যারা ডুব দেয়, শুদ্ধতা লাভ করে। গঙ্গা জলপূর্ণ বাংলা ভাষাতেও বিভিন্ন রীতির দৃষ্টাস্ত আছে। একটি গূঢ় ধারায় চলে, অন্যটি মধুর ভাবনায় ভরা। দুয়েই কবিদের আনন্দ।

কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয় : ‘কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়’ (নেপাল থেকে আবিষ্কৃত, নেওয়ারী অক্ষরে লেখা, E. W. Thomas-এর বিবরণ অনুযায়ী) গ্রন্থটির গুরুত্ব হল, পরবর্তীকালে লক্ষ্মণসেনের রাজসভায় জয়দেব, গোবর্ধন প্রমুখ কবিদের রচনায়, যে আদিরসাত্মক ভক্তিবাদের ধারা প্রবাহিত হয়, সেই কেলি-বিলাস-কলার উৎস এই গ্রন্থের রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক শ্লোকের মধ্যে নিহিত। বাঙালী রূপে অনুমিত কবিদের মধ্যে আছেন বন্দ্য তথাগত, গৌড় অভিনন্দ, মধুশীল, শ্রীধর নন্দী, রতিপাল প্রমুখ। অবকাশ ছোট, তবু তাঁদের কুশলতা সুচিহ্নিত।

সদুক্তিকর্ণামৃত : ‘সদুক্তিকর্ণামৃতের’ (১২০৬ খ্রীস্টাব্দ) গুরুত্ব কবি বা কবিতার সংখ্যায় নয়, যুগ ও জীবন সম্পর্কে প্রগতিশীল মানসিকতায়। এখানে সর্বভারতীয় কবি ও পণ্ডিতদের (যেমন—পাণিনি, ভাস, ভারবি, কালিদাস, ভামহ, অমরু প্রমুখ) পাশাপাশি কেশব সেন, লক্ষ্মণ সেন, উমাপতি ধর, জয়দেব, ধোয়ী, শরণ, গোবর্ধন আচার্য, মথু, সাঞ্চাধর, বেতাল, কবিরাজ ব্যাস প্রমুখ বাঙালী কবিরা আছেন। এখানে আছে দারিদ্র্য জীবনের মর্মান্তিক বর্ণনা।

আর একজন অজ্ঞাতনামা বাঙালী কবি লিখেছেন :

“ক্ষুৎকামা শিশবঃ শবা ইব তনুমন্দাদরো বান্ধবো

লিপ্তা জর্জর কর্করী জললবৈনোমাং তথা বাধতে! 

গেহিন্যাঃ স্ফুটিতাংশুকং ঘটয়িতুং কৃত্বা 

সকাকুস্মিতং কুপ্যন্তী প্রতিবেশিনী প্রতিমুহুঃ সূচীং যথা যাৰ্চিতা ॥”

অর্থাৎ, শিশুরা ক্ষুধায় পীড়িত, দেহ শবের মত শীর্ণ, বান্ধবেরা প্রীতিহীন, পুরাতন জীর্ণ জলপাত্রে স্বল্পমাত্র জল ধরে–এ সকলও আমায় তেমন কষ্ট দেয়নি, যেমন দিয়েছিল যখন দেখেছিলাম আমার গৃহিণী করুণ হাসি হেসে ছেঁড়া কাপড় সেলাই করবার জন্য ক্রুদ্ধা প্রতিবেশিনীর কাছ থেকে ছুঁচ চাইছেন।

এই চিত্রে কেবল দুঃখভোগের কষ্ট নয়, বঞ্চনা ও বৈষম্যের স্পষ্ট ঐতিহাসিক ইঙ্গিতও আছে। তাই ড. নীহাররঞ্জন রায় ‘বাঙালীর ইতিহাস’ গ্রন্থে এই উদ্ধৃতি দিয়ে মন্তব্য করেছিলেন ঃ “দারিদ্র্যের এই বাস্তব কাব্যময় চিত্র সাহিত্যে সত্যই দুর্লভ। অথচ ইহার ঐতিহাসিক সত্যতা অস্বীকার করিবার উপায় নাই।..”

ব্যক্তিগতভাবে রাজারা দান-ধ্যান করিতেন, পাত্রাপাত্র বিবেচনা করিয়া কৃপাবর্ষণও করিতেন, সন্দেহ নাই কিন্তু রাষ্ট্র জনসাধারণের দুঃখ-দারিদ্র্য দূর করা সম্বন্ধে বা দুঃস্থপীড়িতদের সম্বন্ধে কোন দায়িত্ব স্বীকার করিত বলে মনে হয় না।