প্রশ্নঃ বাঙালি সংস্কৃতির ওপর পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব কতটুকু তা আলােচনা কর।

অথবা, বাঙালি সংস্কৃতির ওপর পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব কতটুকু তা বিশ্লেষণ কর।

ভূমিকাঃ সংস্কৃতি সভ্যতার বাহন। সমাজজীবনকে সার্থক ও সুন্দর করে গড়ে তুলে সংস্কৃতি মানবজীবনের ভিত্তি রচনা করে। আদিম সমাজ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সভ্যতার উৎপত্তি, বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধনে সংস্কৃতির অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত জীবনপ্রণালি সংস্কৃতির গতিকে সচল রেখেছে। সংস্কৃতির পথপরিক্রমার মধ্য দিয়ে সভ্যতা বিকাশ লাভ করে।

বাঙালি সংস্কৃতির ওপর পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবঃ ইংরেজরা যখন এ দেশে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠা করল, তখন মুসলমানরা তাদের অতীতের যে গৌরবময় ইতিহাস ছিল তা থেকে বিচ্যুত হলাে। স্বাভাবিকভাবে মুসলমানরা পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে মােটেই গ্রহণ করতের চায়নি। তবে সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে শেষের দিকে মুসলমানরা ইংরেজি সংস্কৃতি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। তবে হিন্দুরা প্রথম থেকেই ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেদের অবস্থানকে দৃঢ় করে। যার ফলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক দিক দিয়েও তারা লাভবান হয়। ইংরেজ আমলে হিন্দুরা দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিল। ফলে তারা ইংরেজদের সংস্কৃতির প্রবাহে এগিয়ে যায়।

ব্রিটিশ শাসন ও শিল্পবিপ্লবের ফলঃ সামগ্রিক বিশ্লেষণে বলা যায় যে, ব্রিটিশ শাসন ভারতে প্রবর্তিত হওয়ার ফলে গােটা সমাজব্যবস্থায় একটা আমূল পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। এতে বাঙালির অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক জীবন, ভাব বিকাশ, শিক্ষা-দীক্ষা প্রভৃতিতে পরিবর্তনের সূচনা হয়। মূলত ব্রিটিশ শাসনের প্রভাবেই ইউরােপীয় শিল্পবিপ্লবের ফলে সৃষ্ট সাংস্কৃতিক অগ্রগতি বাঙালি সংস্কৃতিকে নতুন আলােকে আলােকিত করে। যদিও এই ধারা কতটা ইতিবাচক ছিল তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তবে সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে এই পরিবর্তন ছিল অত্যাবশ্যকীয়, বিশেষ করে আধুনিক শিক্ষার প্রেক্ষাপটে।

মিশনারি ও পাদ্রির তৎপরতা এবং বাঙালি সংস্কৃতির ওপর প্রভাবঃ ইংরেজ পাদ্রি উইলিয়াম ক্যারি কলকাতায় ছাপাখানা স্থাপন করে ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় বিভিন্ন ধর্মীয় পুস্তক ছাপিয়ে খ্রিষ্টধর্ম প্রচার করতে শুরু করেন। খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের প্রথম পর্বে অবশ্য হিন্দুসমাজ ছিল মিশনারিদের প্রধান কর্মক্ষেত্র। তবে পরবর্তীকালে মুসলমানদের মধ্যে তাদের সে কর্মক্ষেত্র বিস্তৃত হয়। এ দেশের মুসলমানদের প্রধান জনপদসমূহে বিশেষত বরিশাল, যশাের, ত্রিপুরা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলে মিশনারি প্রচারণা ক্রমান্বয়ে তীব্র ও ব্যাপকতা লাভ করে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, ১৮৫০ সালের মধ্যেই যশাের ও বরিশালে দশটি করে দেশিয় চার্চ স্থাপিত হয়। তা ছাড়া মধ্যবঙ্গের মুসলিম প্রধান অঞ্চলগুলােতেও মিশনারি প্রচার কর্মতৎপর ছিল। এরূপ মিশনারি তৎপরতার ফলে অসংখ্য বাঙালি হিন্দু-মুসলমান খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করে।

পাদ্রিদের খ্রিষ্টধর্ম প্রচার শুধু মুসলমান অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থাকে না বরং তারা প্রত্যক্ষভাবে বাঙালি হিন্দুদের খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। তবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসগার ও অন্যান্য বাঙালি শিক্ষাবিদ এর প্রতি অনিচ্ছা প্রকাশ করেন এবং এ ব্যাপারে তৎপর হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে বিদেশি পাদ্রিদের প্রতি বিদ্যাসাগরের শ্রদ্ধা কোনােদিনই ছিল না। এ দেশি লােক যারা ধর্মান্তরিত হয়ে পাদ্রি হতেন, তাদের সম্বন্ধে অনেকসময় তিনি প্রকাশ্যেই মন্তব্য করতেন। তাই হিন্দুদের পাদ্রিরা তেমন বেশি ধর্মান্তরিত করতে পারেনি।

বিভিন্ন আন্দোলনের প্রভাবঃ প্রাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে উনিশ শতকে এ দেশের শিক্ষিতরাও পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনে ব্রতী হয়। ডেভিড হেয়ার ও রাজা রামমােহন রায় ১৮১৭ সালে কলিকাতায় হিন্দু কলেজ স্থাপন করেন। ১৮৩৫ সালে মেকলে এ দেশে ইংরেজির মাধ্যমে শিক্ষাদানের সুপারিশ করেন এবং ১৮৮৫ সালে তা কার্যকরি করা হয়। রাজা রামমােহন রায় পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে ব্রাহ্ম সমাজ স্থাপন করে হিন্দু কতকগুলাে সংস্কার করার চেষ্টা করেন।

মুসলমানরাও পরবর্তীতে ইংরেজি শিক্ষায় আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। স্যার সৈয়দ আহমদ নিজ প্রচেষ্টায় আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। মুসলমানদের গােড়ামি দূর করে আধুনিক যুগের সাথে খাপ খাওয়ানাের প্রচেষ্টা করেন। এভাবে বাঙালিদের মাঝে তাদের সংস্কৃতির বিকাশে বিভিন্ন পর্যায়ে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিকাশ লাভ করে।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, ইংরেজদের প্রভাব আমাদের সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছে। শুধু তাই নয়, এমনভাবে প্রভাবিত করেছে যে তার সুদূরপ্রসারী ফলাফলও এ দেশের জনসাধারণের ওপর পড়েছে। বর্তমান সমাজব্যবস্থাকে বিশ্লেষণ করলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে বাঙালি জাতির সাথে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ধারা মিশে একাকার হয়ে আছে। তাই বলা যায়, পাশ্চাত্য সংস্কৃতি বাঙালি সংস্কৃতির শিরায়-উপশিরায় ছড়িয়ে পড়ছে। তবে একথা সত্য যে, বাঙালি জাতি এখনও তাদের আপন সত্তা ও সংস্কৃতিকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে টিকিয়ে রেখেছে, বিলীন হয়ে যেতে দেয়নি।