প্রশ্নঃ জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা দাও। বাঙালি জাতীয়তা ও বাংলাদেশী জাতীয়তার ধারণা দাও। তুমি কী মনে কর বাঙালি বা বাংলাদেশীরা একটি জাতি? যুক্তি দেখাও।
অথবা, জাতীয়তা কী? বাঙালি জাতীয়তা ও বাংলাদেশী জাতীয়তার মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কি কোন বিরােধ রয়েছে? তুমি কী মনে কর যে বাঙালিরা একটি জাতি? ব্যাখ্যা কর।
ভূমিকাঃ জাতীয়তাবাদ বর্তমান যুগের রাজনীতির অন্যতম প্রধান নিয়ন্ত্রণক শক্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর যেসব রাষ্ট্র ঔপনিবেশিক শক্তির কবল থেকে মুক্তি লাভ করেছে তার পেছনে প্রধানত কাজ করেছে জাতীয়তাবাদী মনােভাব। জাতীয়তাবাদ বিশ্বের মানুষকে জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনে অনুপ্রাণিত করেছে। জাতীয়তাবাদের আদর্শ বিশ্বসভ্যতাকে সমৃদ্ধ ও উন্নত করতে অগ্রসর করেছে।
জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞাঃ একই ভৌগােলিক সীমানায় বসবাসরত সমগ্র জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবােধের ওপর অন্যকোনাে ভৌগােলিক সীমারেখায় অবস্থিত মানুষের আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জনমতকে ঐক্যবদ্ধ করে সংগ্রাম পরিচালনা করার মানসিকতা হলাে জাতীয়তাবাদ। অর্থাৎ যখন কোনাে জনসমষ্টির মধ্যে ভাষাগত ঐক্য, সাংস্কৃতিক ঐক্য, জীবনধারণগত ঐক্য দেখা দেয় তখন তাদের মধ্যে জাতীয়তাবােধের সৃষ্টি হয়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ বিভিন্ন পণ্ডিত বিভিন্নভাবে জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে উল্লেখযােগ্য কয়েকজনের সংজ্ঞা উপস্থাপন করা হলাে-
অধ্যাপক প্যাডেলফোর্ড ও লিংকন (Padel Ford & Lincoln)-এর ভাষায়, ‘জাতীয়তাবাদ দুটি উপাদানের সংমিশ্রণ বিশেষ, একটি উপাদান হচ্ছে জাতীয়তার ধারণা সম্পর্কিত কোননা আদর্শবাদ এবং অন্যটি হচ্ছে জাতীয় রাষ্ট্রের মধ্যে ঐ আদর্শবাদকে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে রূপদান।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জে. এইচ হায়েস (J. H. Hayes) তার Essay on Nationalism গ্রন্থে। বলেন, “জাতীয়তাবাদ এবং দেশপ্রেম এদুই আধুনিক অনাসক্ত বিষয়ের এক আবেগপূর্ণ সমন্বয় ও অতিরঞ্জিতকরণ।”
হ্যান্স কো (Hans Koh)-এর মতে, জাতীয়তাবাদ সর্বাগ্রে মানসিক অবস্থা এবং এটি বিশেষ চেতনার সৃষ্টি বিশেষ।’ ‘The Idea of Nationalism’ গ্রন্থে বলেন, Nationalism is first and foremost a state of mind, an act of cortsciousness.’
উপযুক্ত সংজ্ঞাগুলাে আলােচনা করে আমরা বলতে পারি যে, জাতীয়তাবাদ একটি মানসিক চেতনা। এটা এক প্রকার মানবিক প্রবৃত্তি ও ভাবপ্রবণতা। এটা একত্রিত হবার ও একত্রে বসবাস করার মানবিক প্রবণতা।
বাংলাদেশে জাতীয়তার ব্যাপারটি বিতর্কিতঃ সম্প্রতি বাংলাদেশে বাংলাদেশের জাতীয়তা কী হওয়া উচিত সে সম্পর্কে বিতর্ক শুরু হয়েছে। অনেকে দাবি করেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশ। জন্মক্ষণে এর স্লোগান ছিল জয় বাংলা। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সকলেই বাঙালি, স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালি হিসেবে সবাই অংশগ্রহণ করে। অর্থাৎ বিজয়ের গৌরবেই সবাই বাঙালি হিসেবে অংশীদার। তাদের মতে, বাঙালি জাতীয়তাবাদই আসল। আবার অনেকে বলেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারণা সঠিক নয় কারণ বাংলাদেশ নামক ভূ-খণ্ডের সকল নাগরিক বাঙালি নয়। বাঙালি ছাড়াও দেশে রয়েছে। চাকমা, মারমা, গারাে, সাওতাল ও আরাে অনেকে। কাজেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারণা কৌশলগত দিক থেকে ভুল।
বাঙালি জাতীয়তাবাদঃ ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশ সংবিধানের নবম অনুচ্ছেদে বাঙালি জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তাবিশিষ্ট যে বাঙালি ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে সেই জনগােষ্ঠীর ঐক্য বাঙালি জাতীয়তার ভিত্তি। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের বাংলা ভাষাভাষী জনগণের সাথে যাতে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে এক করে দেখা না হয় সেজন্য বলা হয়েছে যে, শুধুমাত্র পূর্ববাংলার ভৌগােলিক সীমারেখার মধ্যে বসবাসকারী জনগােষ্ঠী সংকল্পবদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছে। সেই জনগােষ্ঠাহ বাঙালি জাতি। বাঙালি জাতীয়তাই ছিল আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল প্রেরণা। বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তারা মূল প্রেরণা। বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তারা ভাষা ও সাংস্কৃতিক ঐক্যের ওপর গুরুত্ব আরােপ করেন।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদঃ বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চম সংশােধনীতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের অনুসারীরা ভাষা ও সংস্কৃতি ছাড়াও রাজনৈতিক আকাক্ষা, রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ড, রাষ্ট্রীয় পরিবেশ, নৃতাত্ত্বিক ভিত্তি এবং ধর্মীয় চেতনার ওপর গুরুত্ব আরােপ করেন। কারণ বাংলাদেশে বসবাসকারী উপজাতীয়রা যেমন চাকমা, মারমা, গারাে ইত্যাদি এরা বাঙালি হতে পারে না। কাজেই দেশের সকল নাগরিকের পরিচিতি হবে বাংলাদেশী হিসেবে।
বাঙালি ও বাংলাদেশী জাতীয়তার ইতিবাচক সমন্বয়ঃ বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের আলােচনা হতে একটি বিষয় স্পষ্ট হয় যে, বাংলাদেশের সকল মানুষ একই ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকারী নয়। আর এ ভাষা ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতার কারণে সংবিধানের পঞ্চম সংশােধনীর মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ লেখা হয়। অর্থাৎ আমরা এখন বাংলাদেশী হিসেবে পরিচিত। বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্থলে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে তাই একটি ইতিবাচক সমন্বয় বলে মনে করা হয়। অর্থাৎ এখন আমাদের রাষ্ট্রীয় পরিচিতি বাংলাদেশী হিসেবে।
অতএব বাঙালি এবং বাংলাদেশী জাতীয়তার মধ্যে পার্থক্য থাকলেও আমরা সকলেই একই রাষ্ট্রের অধিবাসী। এবং সবাই মিলে একটি স্বতন্ত্র জাতি। আমাদের রাষ্ট্রীয় পরিচিতি আমরা বাংলাদেশী। আবার জাতিসত্তা ও নৃ-তাত্ত্বিক বিচারে আমাদের মধ্যে কেউ বাঙালি, কেউ চাকমা, কেউ গারাে কিংবা সাঁওতাল।
বাঙালি বা বাংলাদেশীরা কী একটি জাতির সাধারণত কোন নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ডে কোনাে জনগােষ্ঠী যখন অভিন্ন ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ধর্ম, ইতিহাস, ঐতিহ্যের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে জাতীয়তাবােধে উদ্বুদ্ধ হয় এবং রাজনৈতিক সংগঠনের ভিত্তিতে স্বাধীন হবার চেষ্টা করে বা স্বাধীন হয় তখন সেই জনগােষ্ঠীকে জাতি বলে। জাতির এরূপ সংজ্ঞার আলােকে যেকোনাে অর্থে বাংলাদেশীরা বা বাঙালিরা একটি জাতি। বাংলাদেশীরা যে একটি পরিপূর্ণ জাতি, নিম্নলিখিত যুক্তির সাহায্যে তা প্রমাণ করা যায়।
(১) ভাষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ঐক্যঃ যখন কোন সমাজে বসবাসকারী অধিকাংশ মানুষ একই ভাষায় কথা বলে, একই সাহিত্য সমভাবে তাদেরকে আকৃষ্ট ও অনুপ্রাণিত করে এবং তাদের মাঝে সাংস্কৃতিক অভিন্নতা থাকে তখন তাদের মাঝে সহজেই জাতীয়বােধের উন্মেষ ঘটে। এরূপ জাতীয়তাবােধে উদ্বুদ্ধ জনগােষ্ঠী রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করে জাতিতে পরিণত হয়, যেমন- বাংলাদেশীরা একটি জাতি।
(২) ভৌগােলিক ঐক্যঃ একই ভৌগােলিক সীমানায় বহুদিন ধরে বেশ কিছুসংখ্যক লােক বসবাস করতে থাকলে অধিবাসীদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই এক গভীর একাত্মবােধের সৃষ্টি হয়। একই অঞ্চলে বসবাসের ফলে তাদের মধ্যে যােগাযােগ ও আদান-প্রদান সহজ হয়। ফলে অধিবাসীদের মধ্যে ঐক্যচেতনা জাগ্রত হয়। বাংলাদেশের জনগণ একটি নির্দিষ্ট ভৌগােলিক সীমানার মধ্যে বসবাস করে। অতএব ভৌগােলিক দিক দিয়েও বাংলাদেশীরা একটি জাতি।
(৩) বংশগত ঐক্যঃ বংশগত ঐক্য জাতি গঠনের অন্যতম অপরিহার্য উপাদান হিসেবে মনে করা হয়। কেননা একই বংশ থেকে উদ্ভবের ফলে মানুষের মধ্যে ভালবাসা সৌহার্দ্য ও গড়ে ওঠে। বাংলাদশের অধিকাংশ লােক প্রায় একই রকম, এখানে মানুষের মধ্যে বিশেষ কোনাে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। অর্থাৎ এরা মােটামুটি একই বংশােভূত।
(৪) ইতিহাস ঐতিহ্যের ঐক্যঃ জাতি গঠনের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলাে ইতিহাস ও ঐতিহ্যগত ঐক্য। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ইতিহাস ও ঐতিহ্যগত ঐক্য বর্তমান, কারণ বাংলাদেশের জনগণ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে গৌরববােধ করে। অতএব বাংলাদেশীরা একটি জাতি।
(৫) ধর্মগত ঐক্যঃ জাতি গঠনের একটি গুরুত্ব উপাদান হলাে ধর্ম। ধর্মগত ঐক্য জনগােষ্ঠীর মধ্যে জাতীয়তাবােধের চেতনা সহজেই জাগ্রত করে। ধর্মীয় পার্থক্যের কারণেই ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারত নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। বাংলাদেশের প্রায় ৮০% মানুষ মুসলিম। অতএব বাংলাদেশীরা একটি জাতি।
(৬) অভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংগঠনঃ জাতির আর একটি উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য হলাে অভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংগঠন। দীর্ঘদিন ধরে একই সরকার ব্যবস্থার অধীনে থাকলে জনগণের মধ্যে সেই সরকার ব্যবস্থার প্রতি স্বাভাবিক আনুগত্যের সৃষ্টি হয় এবং জনগণের মধ্যে একাত্মবােধ গড়ে ওঠে। বাংলাদেশের সকল মানুষ একটি অভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংগঠনের অধীনে বসবাস করে। অতএব বাংলাদেশীরা একটি জাতি।
(৭) অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষার ঐক্যঃ যখন কোন জনসমষ্টি একই ধরনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষা পােষণ করে এবং সেই লক্ষ্যে তাদের কার্যাবলি পরিচালিত করে তখন ঐ জনগােষ্ঠী একটি জাতি। বাংলাদেশের | মানুষ সবাই মােটামুটি একই ধরনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষা পােষণ করে। অতএব বাংলাদেশীরা একটি জাতি।
(৮) মনস্তাত্ত্বিক ঐক্যঃ জাতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলাে মনস্তাত্ত্বিক ঐক্য। যখন কোনাে জনগােষ্ঠী মনস্তাত্ত্বিকভাবে নিজেদের মধ্যে একতা অনুভব করে তখন তারা জাতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। বাংলাদেশীরা মনস্তাত্ত্বিকভাবে ঐক্যবদ্ধ। অতএব বাংলাদেশীরা একটি জাতি।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে,আমরা সকলেই একই রাষ্ট্রের অধিবাসী, সবাই মিলে একটি স্বতন্ত্র জাতি এবং আমাদের রাষ্ট্রীয় পরিচিতি আমরা বাংলাদেশী। আবার জাতিসত্তা ও নৃ-তাত্ত্বিক বিচারে আমরা বাঙালি। কেননা জাতি ও জাতীয়তা গঠনের উপাদানগুলাে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, একটি জাতির যেসকল বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার বাংলাদেশীদের তার প্রত্যেকটিই আছে। অতএব আলােচনা শেষে এ কথা নিশ্চিন্তে বলা যায় যে, বাংলাদেশীরা একটি জাতি।
Leave a comment