সমগ্র প্রাচীন ও মধ্যযুগের সর্বশেষ এবং সক্ষম প্রতিনিধি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রায়। ভারতচন্দ্র সম্ভবতঃ ১৭০৭ খ্রীঃ অথবা ১৭১০ খ্রীঃ পড়ুয়া বা রাধানগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা নরেন্দ্র রায় ছিলেন ভূরসুটের রাজবংশের সন্তান। বর্ধমান রাজ কীর্তিচন্দ্রের অত্যাচারে ভারতচন্দ্র জন্মস্থান পরিত্যাগ করে মাতুলালয়ে চলে যান। তিনি টোলে সংস্কৃত এবং দেবানন্দপুর গ্রামে ফার্সী ভাষায় পাঠ গ্রহণ করেন। শেষােক্ত স্থানেই তিনি রচনা করেন তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সত্যনারায়ণের পাঁচালী’। এর পর তিনি ঘরে ফিরে আসেন এবং রাজরােষে পড়ে কারাগারে নীত হন। ঘুষ দিয়ে ভারতচন্দ্র কারাগার থেকে পলায়ন করে সন্ন্যাসী দলের সঙ্গে নানাস্থান পরিভ্রমণ করে এক সময় ফরাসডাঙ্গার দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ রায়ের নিকট উপস্থিত হলে দেওয়ান তার গুণের পরিচয় পেয়ে তাঁকে কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নিকট পাঠিয়ে দেন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ভারতচন্দ্রকে পরম সমাদরে গ্রহণ করলেন এবং তাকে সভাকবি নিযুক্ত করে ‘রায়গুণাকর’ উপাধিতে ভূষিত করেন। গুণগ্রাহী রাজা তাকে মূলাজোড়ে প্রচুর ভূসম্পত্তিও দান করেন। কৃষ্ণচন্দ্রের ইচ্ছাতেই ভারতচন্দ্র তার শ্রেষ্ঠ কাব্যকীর্তি ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্য রচনা করেন। ১৭৬০ খ্রীঃ ভারতচন্দ্র বহুমূত্র রােগে দেহত্যাগ করেন।

ভারতচন্দ্রের কাব্য এবং প্রতিভা-সম্পর্কে আলােচনার পূর্বে যে কালের পটভূমিকায় তিনি কাব্যরচনা করেছিলেন, সে বিষয়ে একটু আলােকপাত প্রয়ােজন। কারণ তাঁর কবিপ্রতিভার বিকাশে সমকালীন পটভূমিকারও একটা বিশেষ ভূমিকা ছিল।

কবির কবিপ্রতিভা দেশ-কাল-নিরপেক্ষ আকাশস্থ নিরালম্ব বায়ুভূত নিরাশ্রয়’ কোন বস্তু নয়, এবং কবিও নন দেশ-কালের ঊর্ধ্বে। কাজেই একান্ত প্রাসঙ্গিক কারণেই ভারতচন্দ্রের ব্যক্তি মানসের গঠনে যেমন, তেমনি তাঁর কাব্যেও সমকালের প্রভাব পড়বে—এটা স্বীকার করে নেওয়াই ভালাে।

সমকালের পটভূমি: ভারতচন্দ্র স্বয়ং রাজার সন্তান হয়েও ভাগ্যদোষে তাকে অনেক সময় আশ্রয়-সন্ধানে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে, এক সময় কারাযন্ত্রণাও তাকে ভােগ করতে হয়েছিল, এবং জীবিকানির্বাহের জন্য তাকে অপরের দাসত্ব স্বীকার করতে হয়েছে এবং প্রভুর মনস্তুষ্টি সাধনও করতে হয়েছে। ভারতচন্দ্র যে কালে কাব্য রচনা করেছেন, ইতিহাসের বিচারে, তাকে বলা হয় অবক্ষয়ের যুগ’। সমাজদেহের সর্বত্র ঘুণ ধরেছে। বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে তখন দুর্যোগের ঘনঘটা। তখন ভিতরে ভিতরে চলছে ষড়যন্ত্র। সেই কুচক্রীদেরই একজনের সভায় আশ্রয় নিয়েছে ভারতচন্দ্র। কবির পৃষ্ঠপােষক রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তখন প্রবল প্রতাপান্বিত, প্রায় অর্ধবঙ্গেশ্বর। অবক্ষয়িত মােগলাই বিলাসের মােহে সম্ভবতঃ অপর সকলের মতােই তিনিও গা’ ভাসিয়েছিলেন। সেই রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাশ্রিত কবি ভারতচন্দ্র সম্ভবতঃ বুঝতে পেরেছিলেন, অন্নদাতার মন-তুষ্টি সাধন করতে পারলেই চতুর্বর্গ লাভ হবে। ভারতচন্দ্র কাব্যরচনায় কৃষ্ণচন্দ্রের যে মনস্তুষ্টি সাধন করতে পেরেছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায়, কিন্তু কবি-প্রতিভার বিচারে তিনি ছিলেন দেবী সরস্বতীর বরপুত্র, সেই দেবীর তুষ্টি সাধন করতে পারেন নি। কারণ তিনি রাজসভারই কবি হয়েছিলেন, মানব-সাধারণের কবি হতে চান নি, পারেনও নি। -তার সমস্ত জীবনটাকেই নিয়ন্ত্রিত করেছিল সমকালের পটভূমি।

ভারতচন্দ্র প্রথম জীবনেই দুখানি সত্যপীরের পাঁচালী রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়- প্ৰথমখানি আশ্রয়দাতা হীরারাম রায়ের নির্দেশে এবং দ্বিতীয়খানি রামচন্দ্র মুন্সীর নির্দেশে বাংলা ১১৪৪ সালে রচিত হয়। বিভিন্ন সংস্কৃত ও মৈথিল গ্রন্থের সার অনুবাদরূপে ভারতচন্দ্র সম্ভবতঃ ১৭৪৯ খ্রীঃর পূর্বই ‘রসমঞ্জরী’ রচনা করেন। ভারতচন্দ্রের শ্রেষ্ঠ রচনা ‘অন্নদামঙ্গল’। গ্রন্থটি ১৭৫২ খ্রীঃ রচিত হয়েছিল। সম্ভবতঃ এর কিছু পূর্বেই ভারতচন্দ্র সংস্কৃত ভাষায় ‘নাগষ্টিক’ রচনা করেন। এছাড়া তিনি ‘গঙ্গাষ্টক’, বিবিধ কবিতা এবং চিণ্ডীনাটক নামক একটি গ্রন্থের ভূমিকা অংশ রচনা করেন—এই অংশটিতে তিনি সচ্ছন্দে সংস্কৃত, বাঙলা ও হিন্দি ভাষা ব্যবহার করেন।

ভারতচন্দ্রের শ্রেষ্ঠ এবং প্রাগাধুনিক যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্য অন্নদামঙ্গল গ্রন্থের রচনাকাল বিষয়ে কবি লিখেছেন

বেদ লয়ে ঋষি রসে ব্রহ্ম নিরূপিলা।

সেই শকে এই গীত ভারত রচিলা।।

এ থেকে পাওয়া যাচ্ছে, কাব্যটির রচনাকাল ১৬৭৪ শকাব্দ বা ১৬৫২ খ্রীঃ। কবির এ কাব্যটি তিন খণ্ডে বিভক্ত- প্রথম খণ্ডে অন্নদামঙ্গল’ দ্বিতীয় খণ্ডে ‘কালিকা মঙ্গল’ বা ‘বিদ্যাসুন্দর’ এবং তৃতীয় খণ্ডে ‘মানসিংহ-ভবানন্দ’ কাহিনী স্থান পেয়েছে। প্রথম খণ্ডের ‘অন্নদামঙ্গল’ প্রধানতঃ পুরাণ কাহিনী অবলম্বনে রচিত। দ্বিতীয় খণ্ডের ‘বিদ্যাসুন্দর’ সম্ভবতঃ কোন লৌকিক কাহিনীকে আশ্রয় করে অনেক পূর্বেই সংস্কৃত ভাষায় রচিত হয়েছিল। তবে ভারতচন্দ্রের কাব্য কোন অনুবাদ নয় সম্পূর্ণ স্বাধীন রচনা তৃতীয় খণ্ডের ‘ভবানন্দ-মানসিংহ’ কাহিনী ঐতিহাসিক ঘটনার ওপর ভিত্তি করে রচিত।

প্রথম খণ্ড: গ্রন্থটি তিন খণ্ডে বিভক্ত এবং এর প্রথম খণ্ড প্রকৃতপক্ষে মঙ্গলকাব্যের আদশে্শে রচিত ‘অন্নদামঙ্গল’। অপরাপর মঙ্গলকাব্যের মতােই এই খণ্ডের প্রথমেই দেবীর পৌরাণিক কাহিনী বর্ণিত হয়েছে—এতে দক্ষযজ্ঞে সতীর দেহত্যাগ, উমা-পার্বতীরূপে পুনর্বার জন্মগ্রহণ, শিবের সঙ্গে তার বিবাহ, শিবের শশুরগৃহে বাস, হরগৌরীর কোন্দল প্রভৃতি অংশ মােটামুটিভাবে মুকুন্দ চক্রবর্তীর অনুসরণে রচিত হয়েছে। এই অংশে শিবের কাশী প্রতিষ্ঠা এবং ব্যাস কাহিনী যুক্ত হয়েছে। এরপর শুরু হলাে নরখণ্ড। প্রথমে হরিহাড়ের কাহিনী—দেবীর কৃপায় হরিহর লক্ষপতি হলেও তার গৃহে পারিবারিক কলহের কারণে দেবী আন্দুলিকা গ্রামের রাম সমাদ্দারের গৃহে উপনীত হলেন। রাম সমাদ্দারের পুত্র ভবানন্দ মজুমদার দেবীর কৃপা লাভ করেন, ইনিই মূল গ্রন্থের প্রধান চরিত্র এবং এরই বংশধর কবির পৃষ্ঠপােষক রাজা কৃষ্ণচন্দ্র।

দ্বিতীয় খণ্ড: গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ড ‘বিদ্যাসুন্দর’। মূল কাহিনীর সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই। যশােরপতি প্রতাপাদিত্যকে দমন করতে এসে মুঘল সেনাপতি মানসিংহ এক আকস্মিক বিপর্যয়ের মুখে কানুনগাে ভবানন্দ মজুমদারের সঙ্গে পরিচিত হন। ভবানন্দই প্রসঙ্গক্রমে তাকে বিদ্যা ও সুন্দরের কাহিনীটি শুনিয়েছিলেন।

তৃতীয় খণ্ড: গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে আবার মানসিংহ ও ভবানন্দ মজুমদারের কাহিনী। ভবানন্দের সহায়তায় মানসিংহ রাজা প্রতাপাদিত্যকে দমন করে রাজকীয় খেতাবের জন্য ভবানন্দকে নিয়ে দিল্লী যান। তথায় অবশ্য দেবীর মাহাত্ম্যও কিছু কিছু প্রদর্শিত হয়। দিল্লী দরবার থেকে ‘রাজা’ উপাধি নিয়ে ভবানন্দ দেশে ফিরে আসেন।

কবি ভারতচন্দ্রের এই গ্রন্থ-রচনার মূল উদ্দেশ্য ছিল তার পৃষ্ঠপােষক রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ভবানন্দ মজুমদারকে দেব-অংশ বলে বর্ণনা এবং তাঁর মাহাত্মখ্যাপনএই মুল উদ্দেশ্যটুকু মাথায় রেখেই কবি চারদিক থেকে এত কাহিনী টেনে এনে এর সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন।

অন্নদামঙ্গলে ভারতচন্দ্রের কৃতিত্ব

গ্রন্থের প্রথম খণ্ড অর্থাৎ প্রকৃত ‘অন্নদামঙ্গল’ কাহিনীতেই ভারতচন্দ্রের সর্বাধিক কৃতিত্ব প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থােক্ত হরিহােড় এবং ভবানন্দ মজুমদারের কাহিনী কবির স্ব-উদ্ভাবিত, অবশিষ্ট অংশ কবিকঙ্কণ, ঘনরাম এবং স্কন্দপুরাণের কাশীখণ্ড থেকে গৃহীত হয়েছে। এই খণ্ডে কবি ভাষা, ছন্দ-অলঙ্কারাদির সার্থক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে গ্রন্থটিকে রাজসভার যােগ্য করেই তুলেছিলেন। মঙ্গলকাব্যে দেবীর মাহাত্মকীর্তনে ও কাহিনী বর্ণনায় কবির যে আন্তরিকতা প্রত্যাশিত আলােচ্য গ্রন্থে তার অভাব লক্ষ্য করা যায়। এই খণ্ডে কলমের দু’একটি আঁচড়ে কবি ঈশ্বরী পাটনীর যে চিত্রটি অঙ্কন করেছেন, তেমন সজীব চিত্র প্রাচীন সাহিত্যে একান্তই দুর্লভ। বস্তুত সমগ্র মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যে কবিকৃতির নিদর্শনরূপে অন্নদামঙ্গলের প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে একমাত্র ‘কবিকঙ্কণ চণ্ডী’ই উপমিত হবার যােগ্যতা রাখে।

বাঙলা মঙ্গলকাব্যধারায় বিদ্যাসুন্দর

গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ড ‘বিদ্যাসুন্দর-কে কবি অসাধারণ কুশলতায় পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক কাহিনীর সঙ্গে যােগযুক্ত করেছেন। এই খণ্ডের অধিষ্ঠাতা দেবী অন্নদা নন, ‘কালিকা’। তাই কেউ কেউ ‘কালিকামঙ্গল’ নামে অভিহিত করে থাকেন। বাঙলা ভাষায় যত বিদ্যাসুন্দর’ কাহিনী রচিত হয়েছে, তাদের মধ্যে এটি সর্বশ্রেষ্ঠ। বিদ্যা এবং সুন্দরের অবৈধ প্রেমের চিত্র অঙ্কন করতে গিয়ে কবিকে অনেক সময়ই শ্লীলতা এবং সুরুচির গণ্ডী অতিক্রম করতে হয়েছে—ভারতচন্দ্রের বিরুদ্ধে অনেকেই এই অভিযােগ উত্থাপন করলেও প্রখ্যাত সমালােচক প্রমথ চৌধুরী মন্তব্য করেছেন, “ভারতচন্দ্রের অশ্লীলতার ভিতর আর্ট আছে, অপরের আছে, ন্যাচার।” তবে দোষেগুণে এই খণ্ডটিই যে বাঙলা ভাষায় রচিত প্রথম নাগরিক সাহিত্য এ সত্য অস্বীকার করবার কোন উপায় নেই।

তৃতীয় খণ্ডের ব্যর্থতা: গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডের ভিত্তি ইতিহাস হলেও এটিতেই কবির দুর্বলতা সর্বাধিক প্রকট। মুঘল সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহ ও বাঙলার বারাে ভুইঞার অন্যতম যশােহরপতি প্রতাপাদিত্য এবং তাদের সংগ্রাম ঐতিহাসিক বিষয়। কিন্তু ভারতচন্দ্র এর ইতিহাসের উপর গুরুত্ব আরােপ না করে প্রধানতঃ লােকশ্রুতির উপরই নির্ভর করেছেন। এর ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত ঘটনাগুলি কোন ঐক্যসূত্রে বিধৃত না হওয়াতে কাহিনীটি জমাট বাঁধতে পারেনি। চরিত্রসৃষ্টিতেও কবি বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিতে না পারায় তৃতীয় খণ্ডটি সাধারণতঃ উপেক্ষিত হয়েই থাকে। পূর্বেই বলা হয়েছে যে ভারতচন্দ্র লােকশ্রতির উপর নির্ভর করে ঐতিহাসিক ঘটনা বিবৃত করেছিলেন, ফলে ইতিহাসেরও বিকৃতি ঘটেছে। মানসিংহের সঙ্গে প্রতাপাদিত্যের যে সংঘর্ষকে ভিত্তি করে তিনি এই কাব্য রচনা করলেন, একালের ঐতিহাসিকগণ ঐ ভিত্তিকেই প্রচণ্ড আঘাতে ধ্বংস করে দিয়েছেন। তারা মনে করেন যে অনুরূপ কোন যুদ্ধই সংঘটিত হয়নি। অতএব কবি ভারতচন্দ্রের কাব্যে ইতিহাসের মর্যাদা রক্ষিত হয়নি।

বাঙলা মঙ্গলকাব্যধারায় ভারতচন্দ্র

বিচ্ছিন্নভাবে ভারতচন্দ্রের কাব্যের অংশত্রয় বিচার-বিবেচনা করা হলেও তার কাব্য-বিচারের প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড অর্থাৎ অন্নদামঙ্গল’ এবং ‘বিদ্যাসুন্দর ই আলােচনায় আসে। সামগ্রিক বিচারে ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যকে অষ্টাদশ শতকের শ্রেষ্ঠ কাব্য এবং সমগ্র প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্যরূপে বিবেচনা করা হয়। ভারতচন্দ্রের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী কবি ছিলেন ষােড়শ শতকের কবিকঙ্কন মুকুন্দ চক্রবর্তী। ভারতচন্দ্রের পাণ্ডিত্য এবং কবিত্বশক্তি দুইই ছিল; কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি এমন একটা অবক্ষয়ের পরিবেশে বর্তমান ছিলেন যে তিনি প্রধানতঃ কাব্যের অঙ্গ-নির্মাণের সমস্ত পটুত্ব ও কৌশল প্রদর্শনেই বাধ্য হয়েছিলেন। যদি তিনি এই কাব্যে প্রাণ সৃষ্টি করতে পারতেন, তবে তিনি নিঃসন্দেহে প্রাচীন ও মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবির মর্যাদা লাভ করতে পারতেন। ভারতচন্দ্রের শ্রেষ্ঠত্ব এখানেই যে, তিনি যুগপরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিলেও তার ব্যক্তিআত্মাটি ছিল যুগ- অতিক্রমী আধুনিক। অধ্যাপক ডঃ সত্রাজিৎ গােস্বামী লিখেছেন, “দেববাদনির্ভর ধর্মীয় বাতাবরণের মধ্যে থেকেও ভারতচন্দ্র বস্তুত ছিলেন মুক্তপ্রাণ নাস্তিক। যদিও সেই নাস্তিকতাকে তীব্ররূপে প্রকাশ করে তিনি সমাজ-বিপ্লব ঘটাতে চান নি। রাজন্য-অভিজাত শ্রেণীর অন্নপুষ্ট হলেও তিনি এই শ্রেণীটির দুর্বলতা ও কপট স্বার্থপরতা সম্বন্ধে সম্যক অবহিত ছিলেন। অর্থাৎ ভারতচন্দ্রের কবিআত্মাটি ছিল যুগের মধ্যে থেকেও যুগােত্তীর্ণ, বিশেষ শ্রেণীভুক্ত হলেও স্বশ্রেণীর নির্মোহ সমালােচক।”

ভারতচন্দ্র ভাষা-ব্যবহারে দক্ষতা

কবির মাতৃভাষা বাঙলা। তিনি চতুষ্পাঠিতে সংস্কৃত এবং মুন্সীর কাছে ফারসী ভাষায় পাঠ গ্রহণ করেছিলেন। দীর্ঘকাল উত্তর ভারত পরিভ্রমণ সূত্রে তিনি হিন্দী এবং মৈথিলি ভাষাতেও যে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন তার প্রমাণের অভাব নেই। বস্তুতঃ বিভিন্ন ভাষায় পাণ্ডিত্যের বিচারে সেকালে ভারতচন্দ্রের জুটি ছিল না। এই পাণ্ডিত্যের সঙ্গে কবিত্বশক্তির সংযােগে ভারতচন্দ্র যে কাব্য রচনা করেন, তার উৎকর্ষ অবশ্য স্বীকার্য। তিনি সংস্কৃত, ফারসী, হিন্দী ও বাঙলা ভাষার মিশ্রণে যে পদ রচনা করেন, তাতে শ্রুতিমাধুর্য কিম্বা অর্থবােধের কোন হানি ঘটেনি।

কবি অকৃপণ হস্তেই অন্নদামঙ্গল ও বিদ্যাসুন্দর কাব্যে রস পরিবেশন করেছেন, হয়তাে সে রস কোথাও একটু কড়াপাক, কোথাও একটু গেঁজে গেছে। কাব্যে যথার্থ রসের সৃষ্টিতে যে গীতিপ্রাণতার সৃষ্টি হয়, তার দৃষ্টান্তও ভারতচন্দ্রের কাব্যে দুর্লভ নয়। তার কাব্যের বিভিন্ন অধ্যায়ের গােড়ায় তিনি কিছু কিছু বিষ্ণু পদ সৃষ্টি করেছেন, সেগুলিকে বৈষ্ণব পদের সমকক্ষ বলেই জ্ঞান করা হয়। অনেকেই এগুলিতে আধুনিক গীতিকবিতার পূর্বাভাষ লক্ষ্য করে থাকেন। ডঃ আশুতােষ ভট্টাচার্য বলেন, “যে গীতি-সুর ও গীতিরস ইতিপুর্বে মঙ্গলকাব্যের কাহিনীর অস্তর্নিবিষ্ট হইয়াছিল, ভারতচন্দ্রের মধ্যে আসিয়া তাহাই স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বাধীন পরিচয় লাভ করিল।”

শব্দশিল্পে ভারতচন্দ্র যে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন, তার তুলনা সেকালে দুর্লভ। তিনি তার কাব্যকে ছন্দে অলঙ্কারে রাজসভার উপযােগী করেই সাজিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথও এ বিষয়ে যথাযথ মন্তব্য করেছেন- “রাজসভাকবি রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গল গান রাজকণ্ঠের মণিমালার মত, যেমন তাহার উজ্জ্বলতা তেমনি তাহার কারুকার্য।”

ভারতচন্দ্র ছন্দ-সৃষ্টিতে কৃতিত্ব

রবীন্দ্রনাথের পূর্বে বাঙলা সাহিত্যে ত্রিবিধ ছন্দ-ব্যবহারের কৃতিত্ব ভারতচন্দ্র ব্যতীত অপর কোন কবিই দেখাতে পারেন নি। প্রধানতঃ তিনি অক্ষরবৃত্ত ছন্দে পয়ার, ত্রিপদী এবং চৌপদী রূপকল্পই ব্যবহার করেছেন। পয়ারে মালঝাপ-আদি ব্যবহারে, ত্রিপদী ও চৌপদীতে পর্বান্তিক মিল ব্যবহারে তিনি একালের কবিদের চেয়েও অধিকতর পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি সর্বত্র মিল-ব্যবহারে যে নিপুণতার পরিচয় দিয়েছেন, তার তুল্য দৃষ্টান্ত সর্বকালেই দুর্লভ। তিনি ভুজঙ্গপ্রয়াত, টেক-আদি সংস্কৃত ছন্দকেও সার্থকভাবে বাঙলা ভাষায় ব্যবহার করেছেন—এ প্রচেষ্টা সেকালের অপর কোন কবির কাব্যে দেখা যায় না। আবার ভাবের অনুসারী করে ছন্দ-ব্যবহার করায় তার রচনা অসাধারণ কাব্যোৎকর্ষ লাভ করেছে। তিনি স্বরবৃত্ত ছন্দেও একটি পদ রচনা করে দেখিয়ে দিয়েছেন যে এ জাতীয় ছন্দের মূল প্রকৃতিটি তিনি যথার্থই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। ডঃ শিবপ্রসাদ ভট্টাচার্য মন্তব্য করেছেন, “বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন কবিদের মধ্যে ব্রজবুলির কবিদের কথা ছাড়িয়া দিলে ভারতচন্দ্রের মত। এমন ছন্দের সৌষ্ঠব, বৈচিত্র্য ও পারিপাট্য দ্বিতীয় কোন কবি দেখাইতে পারেন নাই।”

ভারতচন্দ্র অলঙ্কার-প্রয়ােগ কুশলতা

অলঙ্কার ব্যবহারেও ভারতচন্দ্র অপরিসীম কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। অলঙ্কার নির্বাচনে তিনি সর্বাধিক গুরুত্ব আরােপ করেছেন শব্দালঙ্কারে কারণ কাব্যের বহিরঙ্গের প্রসাধন-সাধনেই তিনি অধিকতর যত্নপর ছিলেন। তবে উপমা, রূপক, ব্যতিরেক, নিদর্শনা, দৃষ্টান্ত, ব্যাজস্তুতি প্রভৃতি অলঙ্কার প্রয়ােগেও তাঁর কুশলতা অবশ্য স্বীকার্য। ভারতচন্দ্রের ছন্দ ব্যবহারের প্রকৃতি বিচার করে ডঃ শিবপ্রসাদ ভট্টাচার্য বলেন, “ভারতচন্দ্রের কাব্য ইহার ভাষা ও ছন্দ-অলঙ্কারাদির এই বিশেষ প্রকৃতির মূলকথাই সমসাময়িক নাগর ও দরবারী জীবনের রুচি ও রূপ। ভারতচন্দ্র প্রধানতঃ এই জীবনেরই প্রতিনিধি। এ জীবনের সকল আর্টই অলঙ্কারধর্মী (decorative), সৃষ্টিমূলক ( creative) আর্টের সঙ্গে সে জীবনের পরিচয় ছিল না বলিলেই চলে। কাজেই কাব্যের আর্টও অনুরূপ। সে জীবনের মান এতই স্কুল যে সৃষ্টিমূলক বা প্রতীকধর্মী আর্টের উদ্ভব তখন সম্ভবই ছিল না। যে সূক্ষ জীবনবােধ বা মননশীলতা, ধ্যান ও কল্পনার ঐশ্বর্যে সেই উৎকৃষ্ট আর্টের জন্ম, অষ্টাদশ শতকের জীবনে তাহার উদ্ভবের সম্ভাবনা কোথায়? এইজন্যই ভারতচন্দ্রের কাব্যের আর্ট কবির শব্দ, ছন্দ ও অলঙ্কার—আগাগােড়াই একরূপ অলঙ্কারধর্মী।”

মঙ্গলকাব্যে হাস্যরস সৃষ্টিতে দক্ষতা ও পারঙ্গমত্ব

ভারতচন্দ্রের কাব্যে যে অপর গুণ বিশেষভাবে বিকশিত হয়ে উঠেছে, তা থেকে তার হাস্যরসিক, ব্যঙ্গনিপুণ একজন উঁচুদরের স্যাটায়ারিস্ট রূপটির সঙ্গেই আমরা পরিচিত হয়ে থাকি। সামাজিক কু-প্রথা এবং অভিজাত জীবনের নানা প্রকার অসঙ্গতির প্রতি বক্রোন্তি নিক্ষেপে তিনি একজন নিপুণ শিল্পী ছিলেন। ডঃ আশুতােষ ভট্টাচার্য বলেন, “তাহার ভক্তি, তাহার সর্বব্যাপী ও সুগভীর সামাজিক অভিজ্ঞতা প্রভৃতির ভিতর দিয়া তিনি তাহার ব্যক্তি-প্রতিভার ছাপ মুদ্রিত করিয়া দিয়া মঙ্গল কাব্যের সঙ্গে সঙ্গে এই বিশেষত্বগুলি তাহার ঐহিক প্রীতির নিদর্শনরূপে গণ্য হইবার মর্যাদা লাভ করিয়া তাহাকে আধুনিক যুগেরও অগ্রদূত বলিয়া নির্দিষ্ট হইবার যােগ্যতা দান করিয়াছে।” ডঃ শ্রীবকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ও একই কথা বলেছেন, “ভারতচন্দ্র বিশেষ করিয়া এক অভিনব বাস্তববােধের এক নূতন সমাজ সচেতনতা ও তীক্ষ্ণ, মােহমুক্ত স্বচ্ছদৃষ্টির, জীবন-পর্যালােচনার এক স্বতন্ত্র স্বকীয়তার জন্য আধুনিকতাধর্মী।”

মঙ্গলকাব্যের অসম্পূর্ণতা

ভারতচন্দ্রের কাব্যের অসম্পূর্ণতার বিষয়ে ডঃ শিবপ্রসাদ ভট্টাচার্য লিখেছেন “যেহেতু ভারতচন্দ্রের ব্যক্তি ও সমাজ-জীবনের সঙ্গে সমসাময়িক বৃহত্তর সমাজ-মানসের তেমন সহজ যােগ বা ঘনিষ্ঠতা ছিল না এবং দরবারী প্রতিবেশের মধ্যে প্রতিনিয়ত থাকায় কবি সেই প্রশস্ত জীবন ও সমাজের সঙ্গে আপন জীবনকে এক ও অভিন্ন করিয়া ভাবিতে পারেন নাই, সেইজন্য অন্নদামঙ্গলের দেব বা মানবচরিত্র এদেশের প্রচলিত বিশ্বাস ও সংস্কারের দৃষ্টিতে কেমন বিসদৃশ মনে হয় এবং এই সকল চরিত্রের সহিত সংযুক্ত বৈষয়িক সামাজিক বা তজ্জাতীয় নানা কাহিনীও অনেক ক্ষেত্রেই অস্বাভাবিক। ইহাতে শিল্পের দিক ফুটিলেও প্রাণের দিক ফুটিতে পারে নাই।”