রামায়ণের অন্যান্য কবি ও কাব্য: আদি-মধ্যযুগ বা চৈতন্য-পূর্ব যুগে কৃত্তিবাস ছাড়া অপর কোন রামায়ণ-রচয়িতার সন্ধান পাওয়া না গেলেও চৈতন্যোত্তর কালে যে রামায়ণ-রচনায় জোয়ার দেখা দিয়েছিল, তাতে সন্দেহের কোন কারণ নেই। এতাবৎ যত পাণ্ডুলিপি আবিষ্কৃত হায়েছে, তাতে কবির সংখ্যা পঞ্চাশের কম নয়কালে এই সংখ্যা বৃদ্ধির সম্ভাবনাই রয়ে গেছে। বাল্মীকি রামায়ণের অনুবাদ করতে গিয়ে কৃত্তিবাস বাল্মীকি ছাড়াও জৈমিনি ভারত, অদ্ভুত রামায়ণ, অধ্যাত্ম রামায়ণ প্রভৃতি গ্রন্থ থেকেও উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন, পরবর্তীকালেও এই রীতি অব্যাহত ছিল দেখা যায়। এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় ‘অদ্ভুত রামায়ণ’-এর ধারার কথা। বহু কবিই অদ্ভুত রামায়ণ’ রচনা করে সার্থকতার পরিচয় রেখে গেছেন। নিম্নে বিভিন্ন ধারার কিছু পরিচয় দেওয়া হলাে।
[১] বাল্মীকি রামায়ণ:- বাংলার প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতী ছিলেন ‘মনসামঙ্গল কাব্য’- রচয়িতা দ্বিজ বংশীদাসের কন্যা। দ্বিজ বংশীদাস ১৫৭৬ খ্রীঃ তার কাব্য সমাপ্ত করেন বলে উল্লেখ করে গেছেন—চন্দ্রাবতী সম্ভবতঃ ঐ কালেই জীবিত ছিলেন। চন্দ্রাবতীর রামায়ণের কোন পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়নি, গায়েনের মুখ থেকে শুনে তা’ সঙ্কলন করা হয়েছে। চন্দ্রাবতী মূলতঃ বাল্মীকির অনুসারী হলেও তাতে নতুন তথ্য অনেক সংযােজিত হয়েছে। সঙ্কলনের প্রথম খণ্ডে রাম-সীতার জন্মকাহিনী, দ্বিতীয় খণ্ডে সীতা কর্তৃক বনবাস-কাহিনী বর্ণনা এবং তৃতীয় খণ্ডে বহু নতুন বিষয়ের সমাবেশ ঘটেছে। এই গ্রন্থে সীতাকে রাবণের কন্যারূপে দেখানো হয়েছে। কৈকেয়ীর কন্যা ককুয়ার ভূমিকাও এই কাহিনীতে উল্লেখযোগ্য। চন্দ্রাবতী রচিত ‘দস্যু কেনারামের কাহিনী এবং সম্ভবতঃ ‘মলুয়া সুন্দরী ‘ময়মনসিংহ গীতিকায় সঙ্কলিত হয়েছে।
মহাপ্রভু নিত্যানন্দের বংশধর রঘুনন্দন গােস্বামী সম্ভবতঃ উনিশ শতকের গােড়ার দিকে সপ্তকাণ্ডে বিভক্ত ‘রামরসায়ন’ কাব্য রচনা করেন। এর উত্তরকাণ্ডে বিষয়বস্তুর অভিনবত্ব রয়েছে এবং এতে সীতার পাতাল প্রবেশ বর্ণিত হয়নি।
সপ্তদশ শতকের শেষভাগে অথবা অষ্টাদশ শতকের গােড়াতেই ভূরিত্রষ্টা কবি কবিচন্দ্র শঙ্কর চক্রবর্তী অন্যান্য বহু গ্রন্থ-সহ রামায়ণও রচনা করেছিলেন। বহুল প্রচলিত এই কাব্যটি সাধারণতঃ বিষ্ণুপুর রামায়ণ নামেই প্রসিদ্ধ। সম্ভবতঃ তিনিই প্রথম তরণীসেন’, ‘অঙ্গদের রায়বার প্রভৃতি অংশ রচনা করেন এবং পরে এগুলি কৃত্তিবাসের রামায়ণেও প্রক্ষিপ্ত হয়।
বুদ্ধাবতার রূপে আপনার পরিচয় দিয়ে রামানন্দ ঘােষ যে রামায়ণ রচনা করেন, তার লঙ্কাকাণ্ড পর্যন্ত অংশের সন্ধান পাওয়া যায়। এছাড়া গঙ্গারাম দত্ত একখানি সুবৃহৎ রামায়ণ পাঁচালী রচনা করেছিলেন। কুচবিহার রাজ নারা যে। রচনা করেন, তা অনেকখানি মূলানুগ ছিল।
২। অদ্ভুত রামায়ণ: বিষয়গত অভিনবত্বের জন্যই সম্ভবতঃ অদ্ভুত রামায়ণ এক কালে খুবই উপাদেয় বিবেচিত হতাে এবং এই কারণেই চৈতন্যোত্তর কালে বহু কবিই রামায়ণ অনুবাদ করেছিলেন। অদ্ভুত রামায়ণও বাল্মীকি রচিত বলে প্রচারিত হলেও এটি বহু পরবর্তীকালের রচনা। এতে ২৭টি সর্গ এবং ১৩৬০টি শ্লোক রয়েছে। রাবণের কন্যা সীতা এবং সীতার হস্তেই সহস্ৰস্কন্ধ রাবণের মৃত্যু—এটিই গ্রন্থের মূল বিষয়। রামচন্দ্রকে এই রামায়ণে ব্রহ্মারূপে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।
নিত্যানন্দ আচার্য অদ্ভুত রামায়ণের সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত কবি। তাঁর রামায়ণ ‘অদ্ভুতাচার্য রামায়ণ এবং তিনি অভ্ভূতাচার্য নামেই বিশেষ পরিচিত। তিনি আত্মবিবরণীতে রঘুপতির স্বপ্নাদেশে এই কাব্য রচনা করেন বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি অধ্যাত্মরামায়ণ’এবং অন্যান্য সূত্র থেকেও তার কাব্যের উপাদান সংগ্রহ করেন। বাঙালীচেতনার সার্বিক আদর্শের মহিমাঙ্কনে তিনি বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।
জগদ্রাম এবং রামপ্রসাদ রায় নামক পিতাপুত্র এক যােগে অদ্ভুত আশ্চর্য রামায়ণ রচনা করেন। এই সুবৃহৎ গ্রন্থে পুঙ্করকাণ্ড’ নামে একটি অতিরিক্ত কাণ্ড এবং ‘রামারাস সংযােজিত হয়েছে। অধ্যাত্মারামায়ণ’ থেকেও কিছু কিছু উপাদান সংগ্রহ করেছেন বলে তারা স্বীকৃতি জানিয়েছেন।
মাণিকগঞ্জের রামশঙ্কর দত্ত রায় ‘অদ্ভুত আচার্য উপাধি গ্রহণ করলেও স্বীকার করেছেন যে তিনি বাল্মীকি রামায়ণ, যােগবাশিষ্ঠ রামায়ণ, অদ্ভুত রামায়ণ, মহাভারত এবং পুরাণ থেকে বিভিন্ন উপাদান সংগ্রহ করে তার গ্রন্থটি রচনা করেছেন।
৩। অধ্যাত্ম রামায়ণ: বেদব্যাসের নামে প্রচারিত হলেও এটি বহু পরবর্তীকালের রচনা। এতে মূল কাহিনীই সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছে। এতে মহাদেব পার্বতীর নিকট রাম কাহিনী এবং রামতত্ত্ব বিবৃত করেছেন। শাক্তধর্মের প্রভাব এখানে উল্লেখযােগ্য। গ্রন্থের নাম থেকেই বােঝা যায় যে গ্রন্থটি তত্ত্বপ্রধান।
৪। যােগবাশিষ্ঠ রামায়ণ: এটিও বাল্মীকির নামে প্রচারিত, কিন্তু বস্তুতঃ বহু পরবর্তীকালের রচনা। বাল্মীকি রামায়ণকে মূল গ্রন্থের পূর্বখণ্ডপে পরিচয় দিয়ে এটিকে তার পর খণ্ড বলা হয়েছে। রামচন্দ্রের মনে বৈরাগ্যোদয় হ’লে বশিষ্ঠ তাকে নানা তত্ত্ব উপদেশের সাহায্যে সংসার ধর্মে আগ্রহী করে তােলেন— বিভিন্ন তাত্ত্বিক ও দার্শনিক আলােচনার সাহায্যে এ বিষয়টিকেই গ্রন্থের প্রধান উপজীব্য করে তােলা হয়েছে।
বিভিন্ন রামায়ণেই প্রয়ােজনমতাে শেষােক্ত গ্রন্থ দু’টি থেকে প্রয়ােজনীয় উপাদান আহরণ করা হয়েছে।
Leave a comment