বাঙলা গদ্যসাহিত্যের ইতিহাসে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বিশিষ্ট ও অনন্য স্থানের অধিকারী। ছাত্রজীবনেই তিনি প্রতিবেশী বঙ্কিমচন্দ্রের সংস্পর্শে আসার সুযােগ লাভ করেন। পুরাবৃত্ত চর্চায় রাজেন্দ্রলাল মিত্রের কাছেই তার দীক্ষা, রাজেন্দ্রলালের প্রভাবে তার কঠোর পরিশ্রমের ফলেই ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক ইতিহাস রচনার বহু মূল্যবান তথ্য আবিষ্কৃত হয়েছে।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বঙ্কিমচন্দ্র-সম্পাদিত বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার অন্যতম প্রধান লেখক ছিলেন। ১৮৭৬ থেকে ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে লেখা তার বহু প্রবন্ধ বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। বঙ্কিম যুগের লেখকদের মধ্যে তার মত এত বিচিত্র বিষয় নিয়ে এমন বিপুল সংখ্যক প্রবন্ধ আর কোনও লেখক রচনা করেননি। সাধারণত গবেষণামূলক প্রবন্ধ পাণ্ডিত্য ও তথ্যের ভারে নীরস, আড়ষ্ট এবং সাধারণ পাঠকদের কাছে দুরুহ হয়ে থাকে। শাস্ত্রীমশাইয়ের প্রবন্ধগুলি এই ত্রুটি থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত। তার কারণ, প্রথমত, ইতিহাস তাঁর কাছে শুধু সন তারিখের হিসেব ও তথ্য-সংগ্রহ ছিল না, একটি যুগের জীবনাচরণের বহু বিচিত্র দিক, সাধারণ মানুষদের জীবনবােধ ও জীবনযাত্রা, তাদের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য প্রভৃতির মধ্যেই তিনি ইতিহাসের প্রাণবন্ত রূপ সন্ধান করতেন। দ্বিতীয়ত, নিজের পাণ্ডিত্যের উচ্চচূড়ায় বিচ্ছিন্ন না হয়ে থেকে সাধারণ পাঠকদের কাছে পৌছােবার ঐকান্তিক আগ্রহে সাধুভাযার কাঠামোতেই কথ্যভাষার আশ্চর্য রকমের সজীব বাছন্দের ব্যবহার। তাঁর প্রবন্ধগুলির অন্তরঙ্গ আলাপচারিতার ভাষার সহজ সরল সৌন্দর্য, স্বচ্ছতােয়া নদীর মত তার গতি এবং তার প্রসন্ন কৌতৃকবােধ সমস্ত প্রবন্ধগুলিকে যেভাবে হার্দ্য ও রমণীয় করে তুলেছে বাঙলা গদ্য সাহিত্যে তার তুলনা নেই।

প্রাবন্ধিক হরপ্রসাদের বিশিষ্টতা নির্দেশ করে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেনঃ “শাস্ত্রী মহাশয় বাঙলা ভাষায় একজন প্রধান নিবন্ধকার ছিলেন। তিনি কেবল ইতিহাস ও সাহিত্য লইয়াই নহে, উপরন্তু আধুনিক বাঙালির জীবনের ছােটো খাটো নানা সমস্যা লইয়াও আলােচনা করিয়াছেন। তাহার প্রবন্ধের মধ্যে লক্ষণীয় তাহার বিচারশৈলীর যৌক্তিকতা,তাহার রচনাভঙ্গির। সাবলীলতা এবং মধ্যে মধ্যে হাস্যরসের অবতারণায় তাঁহার রােচকতা এবং সর্বোপরি, তাহার ভাষার প্রাঞ্জলতা। শাস্ত্রী মহাশয়ের ভাষা বাঙলার এক অপূর্ব সম্পদ। যতই গভীর বিষয় হােক না কেন, প্রকাশভঙ্গি এমনই স্বচ্ছ, সহজ ও সর্বজনবােধ্য হওয়া উচিত যাহার বক্তব্য অনায়াসে যথাসম্ভব সকল শ্রেণীর পাঠকের কাছেই পৌছিতে পারে। শাস্ত্রী মহাশয়ের নিজের রচিত প্রবন্ধগুলির মধ্যে এই প্রসাদগুণ ও প্রাঞ্জলতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তাঁহার লেখায় এই যে সহজভাবে প্রকটিত, হইত তাহার পিছনে ছিল সহজভাবে কথা-প্রসঙ্গে বক্তব্য পরিস্ফুট করিয়া তুলিবার তাহার অসামান্য শক্তি।”

বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবর্তনায় হরপ্রসাদ বঙ্গদশর্শনে প্রবন্ধ-রচনায় প্রবৃত্ত হলেও পরে ‘আর্য দর্শন’, ‘নব্যভারত’, ‘সাহিত্য’, ‘নারায়ণ’, ‘মানসী ও মর্মবাণী’ এবং ‘সাহিত্য পরিষৎ’ পত্রিকায় নিয়মিত প্রবন্ধ রচনা করতেন। তাঁর রচিত প্রথম প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘ভারত মহিমা’ (১৮৮১) বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯০২ খ্রীষ্টাব্দে, ‘মেঘদূত’ কাব্যের ভাবানুবাদরূপে তিনি ‘মেঘদূত ব্যাখ্যা’ রচনা করেন। ‘বাল্মীকির জয়’ হরপ্রসাদ-রচিত এক পৌরাণিক রূপক আখ্যায়িকা। তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় ‘প্রাচীন বাঙলার গৌরব’ এবং ‘বৌদ্ধধর্ম’। তাঁর রচিত ইংরাজি বাংলা অসংখ্য প্রবন্ধ সাময়িকপত্রের পৃষ্ঠায় এখনাে আত্মগােপন করে রয়েছে। তার এই প্রবন্ধগুলি সঙ্কলনের প্রচেষ্টা সাম্প্রতিক কালে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

‘বেনের মেয়ে’ (১৯২২) ও ‘কাঞ্চনমালা’ (১৯১৬) উপন্যাসে হরপ্রসাদ তার সৃষ্টিশীল সাহিত্যিক প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। বেনের মেয়ে সম্পর্কে ডাঃ সুকুমার সেনের মন্তব্য স্মরণীয় ঃ “হরপ্রসাদের শেষের দিকে লেখার রচনাভঙ্গি বেশ সরল, লঘু ও দ্রুতগতি হইয়াছে। ইহার প্রকৃষ্ট নিদর্শন মেলে ইহার শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালা রচনা ‘বেনের মেয়ে’ নামক ঐতিহাসিক আখ্যাচিত্রে। ‘বেনের মেয়ে’ বইটির পাত্র-পাত্রী প্রায় সবই কাল্পনিক হইলেও পরিবেশ জমাটভাবে ঐতিহাসিক। খ্রীষ্টীয় দশম-একাদশ শতাব্দীতে পশ্চিমবঙ্গে সপ্তগ্রামের এক ধনী বৌদ্ধ পরিবারের চিত্র এবং স্থানীয় উৎসবাদির উজ্জ্বল বর্ণনা ইহাতে আছে। এই অজ্ঞাত যুগের দৃশ্য এমন জ্বলন্তভাবে যথাযথরূপে প্রত্যক্ষ চিত্রিত করা রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া অপর কোন বাঙ্গালী সাহিত্যিকের রচনায় দেখি নাই। বাঙ্গালা সাহিত্যের ও বাঙ্গালা গদ্যভঙ্গির ইতিহাসে বেনের মেয়ের একটি বিশেষ স্থান আছে।”