মাত্র তিরিশ বৎসরের স্বল্পায়ু জীবনে (১৮৪০-৭০ খ্রীঃ) কালীপ্রসন্ন সিংহ উনবিংশ শতাব্দীর বাঙলার সাংস্কৃতিক জীবনের নবরূপ-নির্মাণে যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন আমাদের শ্ৰদ্ধার সঙ্গেই তা স্মরণ করতে হয়। কালীপ্রসন্ন যখন চতুর্দশবর্ষীয় তরুণ তখনই তিনি ১৫৮৩ খ্রীষ্টাব্দে বাংলা সাহিত্যচর্চার জন্য যে সভা প্রতিষ্ঠা করেন, সেটিই পরে ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভার রূপ নেয়। সমাজসেবা তার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলেও মূল উদ্দেশ্য ছিল বাঙলা সাহিত্যের চর্চা এবং সাহিত্যিকদের বিভিন্ন উপায়ে উৎসাহ দান। কালীপ্রসন্ন সিংহ নিজের রচিত কবিতা প্রবন্ধাদি এখানে পাঠ করতেন। প্যারীচাঁদ মিত্র, কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য, কৃষ্ণদাস পাল প্রমুখ সাহিত্যিক ও মনীষীরা এই সভার সভ্যরূপে তার আলােচনায় অংশগ্রহণ করতেন। সেকালের বিখ্যাত ইংরেজ শিক্ষাবিদেরাও কেউ কেউ আমন্ত্রিত হয়ে এই সভায় ইংরেজি সাহিত্য-সম্বন্ধে ভাষণ দিতেন। সভার মুখপত্র ‘বিদ্যোৎসাহিনী পত্রিকা সদস্যদের রচনা নিয়ে প্রতি মাসে প্রকাশিত হত। বিদ্যোৎসাহিনী সভার সম্পাদক কালীপ্রসন্ন সিংহের উদ্যোগে ১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দের ১২ই ফেব্রুয়ারী সভার একটি অনুষ্ঠানে ‘অমিত্রাক্ষর ছন্দ’ প্রবর্তনের জন্য মাইকেল মধুসূদন দত্তকে সম্বর্ধনা জানানো হয়। নীলদর্পণ’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশের জন্য পাদ্রী জেমস লঙ যখন দণ্ডিত হন তখন বিচারকক্ষে তার জরিমানার এক হাজার টাকা কালীপ্রসন্নই দিয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর তাঁকে গভীরভাবে স্নেহ করতেন। কালীপ্রসন্ন ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভা’র পক্ষ থেকে তার সমাজ-সংস্কার আন্দোলনে সর্ববিধ উপায়ে সাহায্য দান করেছিলেন।

বিদ্যোৎসাহিনী সভার উদ্যোগ ১৮৫৬ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতায় ‘বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গমঞ্চ স্থাপিত হয়েছিল। এই রঙ্গমঞ্চে রামনারায়ণ তর্করত্নের বেণীসংহার নাটক’, কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘বিক্রমােৰ্ব্বশী’ নাটক ও সাবিত্রী-সত্যবান নাটক অভিনীত হয়।

কালীপ্রসন্ন তাঁর ‘হুতােম প্যাচার নকশা’ (১৮৬১) জন্যই বাঙলা গদ্যসাহিত্যের ইতিহাসে বিশিষ্ট স্থান লাভ করেছেন। অবশ্য সাম্প্রতিককালে কেউ কেউ এই অভিমত প্রকাশ করেছেন যে এটি তার রচনা নয়, ভুবনচন্দ্র মুখােপাধ্যায়ের। এই অভিমতের প্রতিবাদও কেউ কেউ করেছেন। যতদিন না এই সম্পর্কে সুনিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, ততদিন কালীপ্রসন্ন সিংহকেই ‘হুতােম পাচার নকশা’র লেখকরূপে স্বীকার করতে হবে। কালীপ্রসন্ন এই নকশা প্যারীচাঁদ মিত্রের আলালের ঘরের দুলাল কে অনুসরণ করেছিলেন। কিন্তু এটিকে কোনক্রমেই আলালের অনুকরণ বলা চলে না। বিষয়ে এবং রচনারীতিতে এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন জাতীয় গ্রন্থ। এর নিজস্বতা নানাদিক থেকেই লক্ষণীয়। অধ্যাপক পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য এ বিষয়ে লিখেছেন, “সত্য বটে তার পূর্বেই ভবানীচরণ এবং বিশেষভাবে প্যারীচাদ সাধুভাষার শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু তারা কেউ কথ্য ভাষাকে সাহিত্যে স্থান দিতে পারেন নি। বাঙলা সাহিত্যে এটি হুতােমের একক কৃতিত্ব। আলালী ভাষায় প্রচুর দেশি-বিদেশি শব্দ এবং মৌখিক বাঙলার কিছু কিছু পরিমাণ বাগধারা অন্তর্ভুক্ত হলেও তার কাঠামােটি ছিল সাধুরীতির। এ-ছাড়া রবীন্দ্র-পূর্ববর্তী সকল লেখকের রচনাতেই সাধুরীতি এবং চলিত রীতির মিশ্রণ দোষ দেখা যায়, কালী প্রসন্নের ভাষা এদিক থেকে নিষ্কলঙ্ক। ‘হুতােম প্যাচার নকশা’ একবারেই কথ্যভাষা এমন কি কথ্যভাষার শ্বাসাঘাতটি পর্যন্ত তার রচনায় ধরা পড়েছে এই কথ্যচালে যেমন লঘুতা আছে, তেমনি প্রয়ােজনে যথাযথ গুরুত্বও আরােপিত হয়েছে।”

‘আলালের ঘরের দুলাল’-এর সঙ্গে ‘হুতােম পাচার নকশা’র আর একটি বড় পার্থক্য এই প্রথমােক্তটি একটি মূল ব্যক্তি বা কাহিনীকে অবলম্বন করে উপন্যাসাকারে রচিত, পক্ষান্তরে হুতােমের নক্সা একেবারে খাঁটি নক্সা বা চিত্র-এতে খণ্ড-বিচ্ছিন্ন আকারে বিভিন্ন চিত্র অঙ্কন করা হয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীতে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য বিস্তারের সূত্রে একশ্রেণীর বাঙালী দেওয়ান, মুৎসুদ্দি, বেনিয়ান প্রভৃতির কাজে বিপুল ধনসম্পত্তি লাভ করেছিল। তাদের শিক্ষাদীক্ষাহীন বংশধরদের ভােগবিলাস, উচ্ছঙ্খলতা, কুৎসিত আমােদপ্রমােদ ইত্যাদির ব্যঙ্গাত্মক রেখাচিত্রই কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁর ‘হুতােম প্যচার নকশা’ য় অঙ্কিত করেছেন। ‘বাবু’ নামে অভিহিত এই ধনীসন্তানদের ভােগবিলাস ও আমােদপ্রমােদের পংকিল জীবনযাত্রা সে যুগের কিছু সংখ্যক নাটক ও নকশার উপজীব্য হয়েছিল। আধুনিক সমাজ-সচেতনতাপ্রসূত তীক্ষ্ম বিদ্রুপে, সমাজের পর্যবেক্ষণে এবং বাস্তবচিত্রণ দক্ষতায় তাদের মধ্যে ‘হুতােম প্যাচার নকশা শ্রেষ্ঠত্ব অবিসংবাদিত। কলকাতার রাস্তাঘাট, বিভিন্ন উৎসবপার্বণ, বড় মানুষদের বিকৃতরুচি ইত্যাদির চিত্র এত বাস্তব ও জীবন্ত যে ‘হুতােম পাচার নকশা’কে সমকালীন কলকাতার সমাজের দলিলরূপে গ্রহণ করা হয়।

কালীপ্রসন্ন সিংহ সাতজন পণ্ডিতের সাহায্যে দীর্ঘদিনের পরিশ্রমে (১৮৬০-৬৬) বেদব্যাসের মহাভারতের সম্পূর্ণ অনুবাদ প্রকাশ করেছিলেন। একজন কুড়ি বছর পার হওয়া যুবকের পক্ষে এই মহাভারতের অনুবাদ-কর্মে আত্মনিয়ােগ কতখানি দুরূহ ছিল, তা বুঝতে পারলেই কালীপ্রসন্নের মনীষা ও প্রতিভার অসাধারণত্ব অনুধাবন করা যাবে। বিদ্যাসাগর মহাভারতের অনুবাদের কাজে হাত দিয়েছিলেন, কিন্তু কালীপ্রসন্ন সিংহ অনুবাদের দায়িত্ব গ্রহণ করলে তাতে ক্ষান্ত হন। বিদ্যাসাগরের প্রেরণায়ই কালীপ্রসন্ন এই কঠিন শ্রমসাধ্য বিরাট কাজে অগ্রসর হন। বিদ্যাসাগর এই গ্রন্থ রচনায় তাকে সর্বপ্রকারে সাহায্য করেন। বাঙলায় অনূদিত মহাভারতের তিন হাজার কপি ছাপা হয়েছিল, এই বই বিনামূল্যে বিতরণ করে তিনি বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে তার অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও অনুরাগের পরিচয় দেন।