অথবা, বাউল সাধক লালনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও

উত্তর : লালন ফকিরের জীবন সম্পর্কে সঠিক তথ্য ইতিহাসে না থাকায় কিংবা তিনি নিজেও জাত-ধর্ম-বর্ণ সম্পর্কে সঠিক পরিচয় না দেওয়ায় তাঁর পরিচয় সম্পর্কে পণ্ডিতগণের মধ্যে মতপার্থক্য লক্ষ করা যায়। কেউ বলেন তিনি হিন্দু আবার কেউবা তাঁকে মুসলিম বলে আখ্যায়িত করেছেন। ফকির লালনের জন্মস্থান নিয়েও বিভ্রাট আছে। তাঁর জন্মস্থান হিসেবে সিলেট, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ প্রভৃতি অঞ্চলের নাম এসেছে। তবে লালনের প্রথম জীবনীকার বসন্ত কুমার পাল একটা বিষয় সম্পর্কে স্পষ্ট জানিয়েছেন, সাঁইজী হিন্দু কি মুসলিম তিনি তা জানেন না। তবে তিনি বিভিন্ন পরিচিত লোকের নিকট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে জানিয়েছিলেন ফকির লালন জন্মগতভাবে কায়স্থ পরিবারের সন্তান। আজ থেকে প্রায় একশ’ বছর আগে ‘হিতকরী’ পত্রিকায় ১৩৩২ সালে বসন্ত কুমার পাল রচিত প্রবন্ধে তিনি লালন ফকিরকে ‘কায়স্থকুলের পদ্মাবতীর সন্তান হিসেবে উল্লেখ করেন। ফরিদপুরের সাহিত্য সমিতির সম্পাদক অবনীমোহন চক্রবর্তী এ তথ্যের সত্যতা নির্ণয়ের জন্য কবি জসীম উদ্দীনকে ক্ষেত্র সমীক্ষায় পাঠিয়েছিলেন। কবি জসীম উদ্দীন বসন্ত কুমার পালের তথ্যের সত্যতা খুঁজে পাননি।

লালনের গান থেকে জানা যায়, তিনি এতিম ছিলেন। তাঁর জন্মের পূর্বে পিতা এবং জন্মের অল্পদিন পরে মাতা পরলোক গমন করেন। ফলে শিশুকালে তিনি অসহায় অবস্থায় সিরাজ শাহের আশ্রয় লাভ করেন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে সিরাজ শাহও পৃথিবী ত্যাগ করেন। অনেক গবেষকের ধারণা তিনি মুসলিম সন্তান ছিলেন। তাঁর পিতার নাম দরিবুল্লাহ দেওয়ান, মাতা আমেনা খাতুন এবং গোলাম কাদের ছিল তাঁর দাদার নাম। ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুণ্ডু থানার হরিশপুর গ্রামে তাঁর জন্ম। তবে তিনি নিকটবর্তী কুষ্টিয়া জেলার ছেউড়িয়ায় আস্তানা নির্মাণ করেন, সেখানেই তাঁর মাজার। লোলন শাহের ইহলোক ত্যাগালে এবং ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর বাউনিয়া পাে তাছাড়াও জানা যায়, তিনি বাউল সাধনায় সিদ্ধি লাভের পর ঘোড়ায় চড়ে দেশ বিদেশে ধর্ম প্রচার করে বেড়িয়েছেন।

তিনি মানুষকে সহজপথে দীক্ষা দিতেন। আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার, কুরআন, হাদিস, তফসির হোসেনী, মসনবি কালাম, উপনিষদ, গীতী, বৈষ্ণব-দর্শন প্রভৃতি জ্ঞানের সার্থক ব্যবহার করে তিনি ধর্ম প্রচার ও ধর্ম সংস্কার করেন। ফলে বহুসংখ্যক মুসলমান ও অল্প সংখ্যক হিন্দু তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। অন্যকথায়, হাজার হাজার বা লক্ষ লক্ষ ব্যক্তি তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে শান্তির ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। লালন। শাহের শিষ্য হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ ছিল এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই। ধর্ম সাধনায় সিদ্ধি লাভ করে লালন শাহ্ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমন্বিত দর্শন প্রচার করেন। ফলে হিন্দু-মুসলিম-খ্রিষ্টান, বৈষ্ণব, মরমী, সহজিয়া ইত্যাদি মতবাদে বিশ্বাসী লোকজন তাঁর আস্তানায় যাতায়াত করতো এবং অধ্যাত্মপিপাসা নিবৃত্ত করতো। লালন ফকির নির্দিষ্ট কোনো ধর্ম- মত বা জাতি-বর্ণে বিশ্বাস করতেন না। বরং তিনি সকল ধর্মের সমন্বিত একটি মতবাদ তাঁর গানে প্রচার করেছেন। ফলে সকল ধর্মের লোকজনই তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তাই লালন শাহকে নির্দিষ্ট কোনো ধর্মীয় পরিচয়ের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ না করাই শ্রেয়। লালন শাহ্ বাউল সম্রাট নামে সবার নিকট পরিচিত।