বাউলদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার পরিচয় দাও
অথবা, বাউলগানগুলো অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাস্তব দলিল – বিশ্লেষণ কর
উত্তর : প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালির জীবনচেতনায় [জা. বি. ২০১৪/ সমন্বয়ধর্মী ধর্মবোধের পরিচয় মেলে। এই সমন্বয়বাদের চমৎকার প্রকাশ মেলে বাউল দর্শনে। একতারা, খঞ্জনী, ঢোল, করতাল প্রভৃতি বাজিয়ে মরমীয়া তত্ত্বমূলক ঘরছাড়া একদল মানুষ সংগীত পরিবেশন করে বেড়ায়, সমাজে এরা বাউল নামে পরিচিত। এদের পরিবেশিত গান ‘বাউল গান’ নামে পরিচিত। মানবজীবনের গূঢ়তত্ত্ব সহজ সরল ভাষায় সংগীতের মাধ্যমে প্রচার ও বিভিন্ন সাধন ভজনের দ্বারা পরম স্বরূপকে হৃদয়ে উপলব্ধি করাই বাউল সম্প্রদায়ের প্রধান লক্ষ্য। বাউল সম্প্রদায় তাদের রচিত গানে এই সাধনতত্ত্বের ইঙ্গিতময় প্রচার করেন। বাংলাদেশের বাউল সম্প্রদায়ের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং পরিচিত বাউল হচ্ছেন লালন শাহ্। লালন প্রচারিত আদর্শ বাউল সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশেষ স্থান করে আছে। লালন শাহ্ তাঁর গানের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক চেতনার পরিচয় দিয়েছেন। এ জন্য তাঁর গানগুলো বেশ জনপ্রিয়। আলোচ্য প্রবন্ধে বাউল গানের অসাম্প্রদায়িক চেতনা তুলে ধরার প্রয়াস পাব।
আঠারো উনিশ শতকে একদল রহস্যবাদী সাধক বাউল নামে পরিচিতি লাভ করে। তারা এই নামে একটি সম্প্রদায় বা গোষ্ঠী গড়ে তুলেছিলেন। এরা বিশেষ কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্ত নন। বাউলরা মুখে মুখে এক ধরনের গান রচনা করে সেগুলো সুর করে গেয়ে তাদের জীবনদর্শন ও সাধনতত্ত্বের কথা প্রকাশ করেছেন। মধ্যযুগে বাউলদের রচিত এসব গান বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, বাউল গান থেকে স্বদেশের চিত্তের একটা ঐতিহাসিক পরিচয় পাওয়া যায়। বাউল মতবাদ হিন্দু মুসলমান উভয়কেই একত্রিত করেছে, কাউকে আঘাত করেনি। আর উভয় সম্প্রদায়কে একত্রিত করার পেছনে মূল প্রেরণা জুগিয়েছে বাউল গানগুলোর অসাম্প্রদায়িক চেতনা। বাউলগানে বিশেষভাবে উঠে এসেছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা। বাউলরা উদার ও মানবতার সেবায় নিষ্ঠাবান। তাদের গানে মানবতার জয়গান এবং অধ্যাত্ম প্রেমচেতনার উৎসারণ লক্ষণীয়। বাউলদের গানে যে মতাদর্শ প্রতিফলিত হয়েছে, তা মূলত সর্বমানবতাবাদী চেতনা। তাই মসজিদ-মন্দির-গীর্জা নিয়ে বাউলদের কোনো সংকীর্ণতা নেই।
বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উপাসনালয়কে উপেক্ষা করে তাই বাউলকণ্ঠে ভেসে ওঠে:
“তোমার পথ ঢেকেছে মন্দিরে মসজিদে।
তোমার ডাক শুনে সাঁই চলতে না পাই
রুইখা দাঁড়ায় গুরুতে মুরশেদে ॥”
বাউলদের মধ্যে যেমন ধর্মীয় ভেদজ্ঞান নেই তেমনি তারা জাত বা সম্প্রদায় গোষ্ঠী বিভাজনেও বিশ্বাস করে না। জাতিভেদের। ঊর্ধ্বে উঠে তাই লালন সাঁই বলেন-
“জাতের কিরূপ, দেখলাম এ নজরে।
সুন্নত দিলে হয় মুসলমান
নারী লোকের কি হয় বিধান?
বামন চিনি পৈতায় প্রমাণ
বামনী চিনি কি প্রকারে ॥”
বাউলদের কাছে মানবজীবনের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ তারা মনে করেন, অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার পর মানবজন্ম ঘটে। তাছাড়া পৃথিবীতে যত সৃষ্টি আছে তার মধ্যে মানুষ শ্রেষ্ঠ তাই বাউলদের ধারণা সৃষ্টি-জগতের সকল প্রাণীসহ ফেরেশতারা বা দেব-দেবীরা পর্যন্ত মানবভজনা করে। বাউলরা তাই ধর্মের নীতিকথা তুলে মানুষে মানুষে বিভেদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। বাউলদের গানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা নানাভাবে ব্যক্ত হয়েছে। ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী প্রভৃতি বিভাজনের পরিবর্তে বাউলদের নিকট মানবধর্ম বড়ো ধর্ম। মানুষ সম্পর্কে বাউলদের ধারণা অনেক উঁচু মানের। সুতরাং মানুষের জাতি-ধর্ম না খুঁজে বাউলরা মানুষের মনুষত্বের আরাধনা করেছেন। নিম্নোক্ত বাউলগানে উঠে এসেছে জাতি-ধর্মের ঐক্যের বিষয়টি:
“রাম কি রহিম সে কোন জন,
মাটি কি পবন জল কি হুতাশন,
শুধাইলে তার অন্বেষণ
মূর্খ দেখে কেউ বলে না ।।”
বাউল সম্রাট লালনের গানের অসাম্প্রদায়িক চেতনা বাঙালির মনে বিশেষভাবে দাগ কাটে। তিনি নিজে ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী। তাঁর কাছে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকল ধর্মের মানুষ আসত দীক্ষা নিতে। তিনি মনে করেন এই জগৎ সংসার কেবল একটি কৃত্রিম ব্যাপার যা শুধু মানুষে মানুষে ভেদাভেদ সৃষ্টি করে। তিনি সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজতে বলেছেন মানুষের মাঝে। ঈশ্বর মানুষরূপেই মানুষের মধ্যে বিরাজ করেন। তাই লালনের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে:
“এই মানুষে সেই মানুষ আছে
আমার হইল কি ভ্রান্তি মন
আমি বাইরে খুঁজি ঘরের ধন।”
বাউলরা ধর্মীয় দৃষ্টিতে মানবগোষ্ঠীকে বিভক্ত করেননি। বাউলরা জাত ভেদাভেদহীন বিশ্বমানবতাবাদী দর্শনে বিশ্বাসী। বাউল সম্প্রদায় মনে করেন-
‘যিনি আল্লাহ তিনিই ঈশ্বর-ভগবান।’
সতেরো আঠারো শতকে বৈষ্ণব মতাদর্শ সমাজে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। এরা বাউল সম্প্রদায়কে তাদের মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত করেছিল। মুসলমান সুফি সাধকদের অনেকেই ইসলাম ধর্মের নিয়মাবলি যথাযথ পালন করেন না। তারা সমাজে ‘বে- শরা পন্থি’ নামে পরিচিত। সমাজের এসব নিন্দিত লোকজনও বাউলদের উদার মতবাদের আশ্রয় গ্রহণ করেন। কারণ, বাউল | সম্প্রদায় বিশেষ কোনো সম্প্রদায়ভুক্ত নন বলে তারা সকল ধর্মের লোকজনকেই আশ্রয় দিয়েছেন। উল্লেখ্য বাউল মতাদর্শে ইসলামি সুফিতত্ত্বের কিছু বিষয়াদি যেমন আছে, তেমনি, চৈতন্যদেব প্রচারিত বৈষ্ণবতত্ত্বের প্রভাবও আছে। বাউল সম্প্রদায় চৈতন্যদেবকেও ভক্তি করে। এসব সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষেরা মনের মানুষ সন্ধান করে। বাউলগানে এই মনের মানুষের বিষয়টি উঠে এসেছে বিভিন্নভাবে। লালন বলেন:
“এই মানুষ আছে রে মন
যারে বলে মানুষ রতন
ডুবে দেখ দেখি মন তারে
কিরূপ লীলাময়। “
মনের মানুষের সন্ধান করা বাউল সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের প্রধান লক্ষ্য। বাউল সম্প্রদায়ের মানুষ পূজা অর্চনা, নামাজ রোজা কিংবা মসজিদ-মন্দির-গীর্জা, গয়া-কাশী-কাবা কোনো কিছু নিয়েই বাড়াবাড়ি করেন না। অর্থাৎ ধর্মের প্রথাগত কোনো প্রবন্ধে। বিষয়াদি তারা পালন করেন না। বাউলদের মধ্যে মূলত সকল ধর্মের একটি মিলন পরিলক্ষিত হয়। এজন্য বাউলরা সহজেই বৈষ্ণব বা হিন্দু ধর্ম কিংবা মুসলিম সুফি মতবাদ ঘেঁষা শব্দাদি ব্যবহার করতে পারেন। তারা নির্দিষ্ট কোনো ধর্ম পালন করেন না। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তারা স্বাধীন মতামতে বিশ্বাসী। তাদের কাছে সকল ধর্মের মানুষ সমান। অর্থাৎ তাদের কাছে মানুষই হলো আরাধনার প্রধান বিষয়। মনুষ্যত্বই তাদের প্রধান অবলম্বন। মানবতাবাদের চেয়ে তাদের কাছে আর কোনো বড়ো ধর্ম নেই। তাই বাউলরা সর্বদাই অসাম্প্রদায়িক। বাউলগানেও সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকশিত হয়েছে। বাউলগানের এই অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিশেষত বাঙালির মনকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে। অর্ধ-শিক্ষিত, অশিক্ষিত বাউল সম্প্রদায় বাংলায় অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার প্রচার করেছেন গানের কথায় ও সুরে। সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করলে বুঝা যায়, বাউল সম্প্রদায়ের গানে ব্যক্ত, বক্তব্য প্রকৃত প্রস্তাবে বাঙালির ঐতিহ্য। অন্যভাবে বললে বলা যায় যে, বাঙালি সংস্কৃতির অঙ্গ হচ্ছে বাউলদের মতাদর্শ। কারণ বাঙালি জাতি মিলেমিশে থাকার সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করে। আর বাঙালির এই মিলেমিশে থাকার সংস্কৃতি তথা অসাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির প্রেরণার উৎসারণ ভূমি হলো বাউলগানগুলো।
Leave a comment