অথবা, বাউল গানের কাব্য সৌন্দর্য আলোচনা কর

অথবা, বাউলগানের শিল্পমূল্য বিচার কর

অথবা, বাউল গানের কাব্যমূল্য বিচার কর

উত্তর: বাউল বাংলার একটি মৌলিক ধর্মসম্প্রদায়ের সাধন সংগীত। তাঁদের অধ্যাত্ম সাধনার গূঢ়-গুহ্য পদ্ধতি কেবল দীক্ষিত শিষ্য সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচারের উদ্দেশ্যেই এ গানের আত্মপ্রকাশ। শিল্প সৃষ্টির সচেতন প্রয়াস এখানে অনুপস্থিত। কারণ বাউলগানগুলো আলোক প্রাপ্ত ও সুশিক্ষিত ব্যক্তিদের রচনা নয়। শিক্ষিত বা পণ্ডিত বলতে আমরা যা বুঝি, বাউলদের প্রায় কেউই তা নয়। বিশেষত মুসলমান বাউলদের মধ্যে শিক্ষা বা বিদ্যার এরূপ মাত্রা নেই বললেই চলে। ফলে এসব সরল, বিশ্বাসপ্রবণ, ধর্মপথের যাত্রী পল্লিবাসীদের রচনায় ভাবের পদবিন্যাস, ভাষার মার্জনা বা সচেতন অলংকরণের চেষ্টা নেই। তবু বাউলদের মধ্যে সাধারণত যারা অভিজ্ঞ ও গুরুস্থানীয় হওয়ার যোগ্য এবং যাদের মধ্যে সহজ কবিত্ব শক্তি আছে, তারাই ঐসব গান রচনা করেছেন। সাধারণ জ্ঞান, জগৎ ও জীবনের প্রতি সদাজাগ্রত দৃষ্টি, ক্রিয়া ও অভিজ্ঞতালব্ধ প্রত্যয়, বিষয়বস্তুর সম্যক, অবগতি, নিরন্তর আত্মবদ্ধ আবেগ ও ভাবাতিশয্য এবং সহজাত কবিত্ব শক্তি থাকার দরুন তারা মোটামুটি ভালোভাবেই তাদের বক্তব্য প্রকাশ করতে পেরেছে। তাদের ভাবানুভূতি স্বতঃউৎসারিতভাবে সেরূপ ধারণ করে প্রকাশ লাভ করেছে। তাই তাদের রচনার শেষরূপ একটি সহজাত কবিত্বের অনুপ্রেরণায় ভাব ছন্দোবদ্ধ আকারে বের হয়ে এসেছে, তার মধ্যে কোনো কৃত্রিমতা নেই। এ রচনায় উপমা বা রূপকের বিষয়গুলো তাদের চারদিকে দৃষ্ট প্রত্যক্ষ বস্তু হতে সংগৃহীত নিতান্ত আটপৌরে ভাষায়, সময় সময় আঞ্চলিক কথ্য ভাষায় তাদের ভাবানুভূতি রূপলাভ করেছে। এ বাউলগানগুলো তাদের ভাবানুভূতির অকপট রূপায়ণ। প্রকৃতির নিজস্ব সম্পদের মতো এ রচনা স্বাভাবিক সহজ সরল ও অযত্ন বর্ধিত। এ প্রসঙ্গে সমালোচক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তাঁর ‘বাংলার বাউল’ গ্রন্থে যে অভিমত পেশ করেছেন তা হলো:

“বাংলা সাহিত্যের উদ্যান কোণে এ জাতি গৌরবহীন বনফুল বিনম্র সৌন্দর্যে ফুটিয়া তাহার স্নিগ্ধ সৌরভ বিলাইতেছে। সাহিত্য যদি সমাজজীবনের দর্পণ হয়, তবে বাঙালি সমাজের এক কোণের একটি ধর্মসম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাস, অধ্যাত্ম চিন্তা, জগৎ ও জীবন সম্বন্ধীয় মনোভাব বিভিন্ন ভাবানুভূতি তাহাতে প্রতিফলিত হইয়াছে। …………………… এ ভাবানুভূতির মধ্যে যে কারুণ্য, যে মাধুর্য আছে, প্রকাশভঙ্গির মধ্যে যে অকপট সারল্যের সৌন্দর্য আছে তাহাই ইহাদের সাহিত্যাংশ। প্রাণের এমন সহজ সরল, অকপট, অভিব্যক্তিতে একটি মনোরম সাহিত্যরসের আস্বাদ আছে- ইহা একটি বিশিষ্ট সাহিত্যরস। একদিক দিয়া এ গানগুলো বাংলা সাহিত্যের একটি অনন্য সাধারণ ও স্বকীয় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সম্পদ।” [বাউলগানের রূপ ও সাহিত্যিক মূল্য]

বাউলগানের শিল্পগুণ ও কাব্যগুণ বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে আমরা প্রধানত লালনের গানের শিল্পগুণ অলোচনা করব। কেননা সব লালন ফকিরই বা লালন শাহই সর্বশ্রেষ্ঠ। কেবল সংখ্যায় নয় শিল্পগুণেও তাঁর গান বাউলসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। ভাব-ভাষা- ছন্দ-অলঙ্কার বিষয়ে এ গান উচ্চ শিল্পমানের পরিচায়ক এবং তা তর্কাতীতরূপে কাব্যগীতিতে উত্তীর্ণ। লালনের মতো একজন নিরক্ষর গ্রাম্য সাধক কবির গানগুলো ক্ষুদ, ক্ষুদ্র এক একটি ভাব যেন ফুলের মতো ফুটে উঠেছে। এ গানগুলো এক সময় এত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে বাংলার প্রায় সর্বত্রই গানগুলো ছড়িয়ে পড়েছিল।

নিচে লালনের গানে তথা বাউলগানে শিল্পের প্রসাধন কিভাবে সেই গানের সাহিত্য ও সৌন্দর্য প্রকাশ করেছে তা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো:

শব্দের জিয়ন কাঠি কবিতা কিংবা গানের শরীরে প্রাণ সঞ্চার করে থাকে। কুশলী শিল্পীর হাতে প্রচলিত শব্দ নতুন ব্যঞ্জনা ও তাৎপর্য লাভ করে। প্রয়োগ নৈপুণ্যে আটপৌরে শব্দও যে কিভাবে নতুন অর্থ ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠে লালনের গানে তার উদাহরণ বিদ্যমান। তিনি ছিলেন শব্দ-কুশলী ও শব্দ- সচেতন শিল্পী। তাঁর শব্দভাণ্ডার ব্যাপক ও বিশাল, বহু ভাষার মণিকাঞ্চনে বাঁধা ছিল সে ভাণ্ডার। তিনি ইচ্ছেমতো সেসব শব্দ তাঁর গানে ব্যবহার করেছেন। সকল ক্ষেত্রেই তা হয়েছে সুপ্রযুক্ত। তিনি বিভিন্ন ভাষার প্রচলিত শব্দ ছাড়াও বহু আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করেছেন। নতুন নতুন শব্দ তৈরিও করেছেন। নিচে যেসব শব্দ লালনের গানকে তথা বাউলগানকে আকর্ষণীয় ও শ্রীমণ্ডিত করে তুলেছে তার কয়েকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো:

ক. খাঁচার ভিতর অচিন পাখী কেমনে আসে যায়।

ধরতে পারলে মন-বেড়ী দিতাম তাহার পায়। পদ-(১৩)

খ . আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।।

গেলাম বেড়ে অগাধ পানি,

ও তার নাই কিনারা, নাই তরণী পারে।

মনে বাঞ্ছা করি

দেখবো তারি

আমি কেমনে সে গাঁয় যাই রে ।। (৫)

গ. কি কব সেই পড়শীর কথা

ও তার হস্ত-পদ-স্কন্ধ-মাথা নাই রে।

ঘ. সুন্নত দিলে হয়মুসলমান,

কেউ মালা, কেউ তসবি গলায়, (২০)

ঙ. তুমি হরদম নাম রাখবে স্থিতি

এখন ভুলে গিয়েছ তারে।।

চ. আপনে চোরা আপন বাড়ী,

আপনে সে লয় আপন বেড়ী,

লালন বলে, এ লাচাড়ি

কই না, থাকি চুপে চুপে ।। (২)

উদ্ধৃত পদগুলোতে তৎসম, তদ্ভব, প্রচলিত, আঞ্চলিক ও আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার আছে। এছাড়া এমন কতকগুলো শব্দবদ্ধ আছে যা একান্তই লালনের নিজস্ব সৃষ্টি। উপরিউক্ত দৃষ্টান্ত গুলো লক্ষ করলে বুঝা যায় বাংলা শব্দের সাথে লালন এসব শব্দের কি গভীর আত্মীয়তা যোগ ঘটিয়েছেন। লালনের এ শব্দ প্রয়োগের নৈপুণ্য সম্পর্কে সমালোচক আবু জাফর বলেছেন,

“শব্দ ব্যবহারে লালন যে অস্বাভাবিকরূপে দক্ষ ছিলেন, তাঁর ব্যবহৃত সব শব্দই যে বিপুল পরিমাণে ভাবগর্ভ ও বিদ্যুৎবাহী; এ বিষয়ে সকলে একমত হবেন। ………………….. শুধু শব্দের বিন্যাস নয়, আধুনিক নিয়মে অসংখ্য শব্দ এ লালনের স্পর্শেই নতুনভাবে অর্থ পেল, সঙ্কোচন প্রসারণে পেল নতুন আয়তন, কখনো কখনো নতুনভাবে নির্মিতও হলো শব্দ৷”

বাউলগানের রসগ্রাহী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনের গানের ছন্দ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করে এর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তিনি এ প্রসঙ্গে লালনের এ গানটি উদ্ধৃত করেছেন,

এমন মানব-জনম আর কি হবে।

মন যা করো ত্বরায় করো এই ভবে ।।

এ গানটি সম্পর্কে যে মন্তব্য রবীন্দ্রনাথ করেছেন তা হলো: “এই ছন্দের ভাষা একঘেয়ে নয়। ছোট বড় নানা ভাগে বাঁকে বাঁকে চলেছে। সাধু প্রসাধনে মেজে ঘষে এর শোভা বাড়ানো চলে, আশা করি এমন কথা বলার সাহস হবে না কারও। এ খাঁটি বাংলায় সকল রকম ছন্দেই সকল কাব্যই লেখা সম্ভব, এ আমার বিশ্বাস।” (ছন্দ)

লালন শাহের শব্দ ব্যবহার যেমন নিখুঁত তেমনি ছন্দের শাসন অত্যন্ত কঠোর। এ কঠোর ছন্দশাসন তাঁর গানকে কবিতায় উত্তীর্ণ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। লালন শাহের গান অলংকার ব্যবহারের দিক দিয়েও অনন্য সাধারণ। উপমা- রূপক-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্পের সুপ্রয়োগ সহজেই তাঁর গানে লক্ষণীয়। যেমন-

ক. জলে যেমন চাঁদ দেখা যায়

ধরতে গেলে হাতে কে পায়,

তেমনি সে থাকে সদায়

আলেকে ব’সো ।। (৬)

খ. রূপকের ব্যবহার-

লাগল ধুম প্রেমের থানাতে

মনচোরা পড়েছে ধরা রসিকের হাতে।

লালনের গানে অনেক প্রবাদ-প্রবচন আছে যা প্রয়োগ নৈপুণ্যে কাব্য গীতিতে অকর্ষণ সৃষ্টি করেছে। লালন তথা বাউল গীতিতে ব্যবহৃত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রবাদ-প্রবচন-সুভাষণ এখানে উল্লেখ করা হলো:

  1. হাতের কাছে হয় না খবর, কি দেখতে যাও দিল্লী লাহোর। (৩)
  2. আপনারে চিনলে পরে যায় অচেনারে চেনা। (১২)
  3. মনের ঘোরে হলাম চোখ থাকিতে কানা। (১২)
  4. কাক মারিতে কামান পাতা।

এছাড়া অনুপ্রাসের ব্যবহার লালনের গানকে বিশেষ ধ্বনি- ব্যঞ্জনায় সমৃদ্ধ করেছে। যেমন-

ক. গর্তে গেলে কূপজল কয়,

গঙ্গায় গেলে গঙ্গাজল হয়। (২০)

খ.. স্বরূপ-রূগের রূপের ভেলা

ত্রিজগতে করছে খেলা (৭)

এভাবে লালন শাহ তাঁর অতুলনীয় কবিত্ব গুণে বাউলগানকে সমৃদ্ধ করেছেন। বিশেষকরে তাঁর কয়েকটি গান শিল্প সৌন্দর্যমণ্ডিত এবং এগুলো বাংলা সাহিত্যের পর মূল্যবান সম্পদ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। যেমন-

  1. খাঁচার ভিতর অচিন পাখী কেমনে আসে যায়,
  2. বাড়ির কাছে আরশি নগর এক পড়শী বসত করে।
  3. সব লোবে কয় লালন কি জাত সংসারে লালন কয়, জেতের কি রূপ, দেখলাম না এ নজরে।
  4. আমার ঘরের চাবি পরের হাতে কেমনে খুলিয়া সে ধন দেখব চক্ষেতে।
  5. মিলন হবে কত দিনে আমার মনের মানুষেরি সনে।

বহুল উচ্চারিত তত্ত্বকথা ও সীমাবদ্ধ বিষয়ের অনুবর্তন সত্ত্বেও লালনের এ গানগুলো গতানুগতিকতাকে অতিক্রম করে নতুন ভাব ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করেছে। লালন ছাড়াও অন্যান্য বাউল রচয়িতাদের মধ্যে পদ্মলোচন, যাদুবিন্দু, পাঞ্জ শাহ প্রমুখ বিশেষ সুপরিচিত। তাঁর ও তাদের সহজ কবিত্ব শক্তি দ্বারা বাউলগানকে সমৃদ্ধ করেছেন। সর্বজন জ্ঞাত সাধারণ বিষয়ের উপমা ও রূপক প্রয়োগ করে তাঁরা কবিত্ব শক্তির নিদর্শন রেখেছে। দৃষ্টান্ত,

পদ্মলোচনের একটি পদ-

ওরে পোদা হলো কানা বেড়াল

দই বলে কাপাস খাচ্ছে।

কিংবা যাদুবিন্দুর গান-

এমন চাষা বুদ্ধি নাশা তুই

কেন দেখিল না আপনার ভূঁই।

তোর দেহ জমির পাকা ধান

দেহ লেগেছে ছটা বাবুই ।।

বাউল গোবিন্দদাসের পদ-

আমার ভিতর আমি কে তার

খবর রাখলি না

শুধু ‘আমি’ ‘আমি’ করে বেড়াও

সেই আমি বল কোন জনা ।৷

এভাবে বাউলগানে বাউল রচয়িতাগণ কেবল শুধু ধর্মসাধনার কথা প্রচার করেননি, এতে আছে সমস্ত জীবনের কথা। শুধু ভগবৎ তত্ত্ব বা ভক্তি নয়, শুধু প্রেম নয়, তার মধ্যে অখণ্ড জীবন, তার বিচিত্র আলোড়ন স্পন্দিত হয়েছে। অনেকের ধারণা, শুধু ভগবৎ তত্ত্ব নিয়েই বাউলদের কারবার, কিন্তু আসল ব্যাপার তা নয়, বাউল জীবনের দূত, তাদের একতারার একটি তার থেকে সেই বিচিত্র জীবন সংগীত মানুষের দ্বারে দ্বারে পরিবেশন করছে। বিষয়বস্তুর সীমাবদ্ধতা ধর্মতত্ত্ব ও সাধন প্রণালী বর্ণনার শুদ্ধতা সত্ত্বেও বাউলগানগুলোর মধ্যে সহজ কবিত্ব শক্তি ও সাহিত্যরসের বহু দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।

এ কারণেই বলা হয় বাউল গান এমন এক ঋদ্ধ সাহিত্য যা চিরায়ত সাহিত্যের পর্যায়ভুক্ত। এগুলোতে বিশেষ তত্ত্ব প্রোথিত থাকলেও শিল্পগুণে সমৃদ্ধ।