সমগ্র নাটকে বাউলের একটি মাত্র গান ‘মুক্তধারা’ নাটকে অনিবার্য হয়ে উঠেছে কেন? আলোচনা করো।

বাউলের প্রতি ও বাউলগানের প্রতি রবীন্দ্রনাথের প্রবল অনুরাগের প্রমাণ তাঁর সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে ছড়িয়ে আছে। তিনি বাউলকে অনেক উচ্চে স্থান দিয়েছেন। বাউলের সহজিয়া তত্ত, মনের মানুষের অন্বেষণের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতাবাদের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। বাউলের গান, গানের সুরও রবীন্দ্রনাথকে যথেষ্ট আচ্ছন্ন করেছিল। তাঁর অনেক গানই বাউলের সুরানুসরণে রচনা করেছিলেন। বাউল তাঁর নাটকের মধ্যেও নানা ভাবে অবির্ভূত হয়েছে নানা উদ্দেশ্য সাধন করার অভিপ্রায়ে। ‘মুক্তধারা’ নাটকের মধ্যেও সেই রকমই বাউলের আবির্ভাব ও তার গানের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। সেই গান আবার বিশেষ কারণে ব্যবহৃত হয়েছে – যদিও নাটকটি ইংরেজিতে অনুবাদের সময় সেই গান ও বাউলের অংশ বর্জিত হয়েছিল। এই বর্জন করার মধ্যে মূল কারণ হতে পারে অনুবাদের সমস্যা অথবা বিদেশীরা বাউলের রস যথাযথ ভাবে নিতে পারবে না— এই ধারণা। ইংরেজি অনুবাদের সময় ভাষাত্তরের সমস্যার জন্যে এবং আবেগের তারতম্য হেতু তিনি স্বেচ্ছায় অনেক গানই বাদ দিতেন। ‘রাজা’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদের সময়ও একই কারণে অনেক গান অনুবাদে তিনি বিরত থেকেছেন। তাই আলোচ্য নাটকের ইংরেজি অনুবাদে বাউলের গানটি সংযুক্ত না হলেও, বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে গানটির ভূমিকা অপরিসীম। তা সে যাই হোক, ‘মুক্তধারা’ নাটকে সর্বমোট একুশটি গানের মধ্যে একটি মাত্র বাউলের গান যখন দেখতে পাওয়া যায়, তখন স্বাভাবিক ভাবেই মনে হনে হয় কবি নিশ্চয়ই বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য সাধনের উদ্দেশ্যে এই গানের ব্যবহার নাটকের মধ্যে করেছেন।

বলাবাহুল্য, ‘মুক্তধারা’ নাটকের সমগ্র নাটকে নানা উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে ব্যবহার করা হয়েছে। রবীন্দ্র-নাটকের মধ্যে বিশেষ করে সাংকেতিক নাটকের মধ্যে গান হচ্ছে রহস্যের দ্বারোদঘাটনের চাবিকাঠি। তাই সাংকেতিক পর্যায়ের নাটকের মর্মোদঘাটনের জন্যে নাটকের মধ্যে ব্যবহৃত গানগুলির ভাব ও অর্থ নিরূপণ করা নিতান্ত প্রয়োজন। সেই অনুসন্ধানী আলোকসম্পাত করলে আমরা দেখতে পাব, আলোচ্য নাটকের বাউলের গাওয়া একটি মাত্র গানে নিহিত আছে নাটকের ভবিষ্যৎ পরিণতির আভাস।

আলোচ্য নাটকে বাউলের গানটি ব্যবহার করা হয়েছে, সেই দৃশ্যে যেখানে যুবরাজ অভিজিৎকে সেনাপতি এসে রাজার আদেশে বন্দী করার জন্যে ডেকে নিয়ে গেল। এবং রাজকুমার সঞ্জয় তার অপেক্ষায় থাকবে বলে তাকে বিদায় জানাল সেই সময়। নাটকের উল্লিখিত অংশে আরো দেখা যায়, সঞ্জয়ও অভিজিতের সঙ্গে রাজশিবিরে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করলে, সেনাপতি বিজয়পাল জানালো, ‘মহারাজ তা ইচ্ছা করেন না’। অগত্যা, ‘আমি তবে এই পথেই অপেক্ষা করব’— বলে সঞ্জয় তাকে সাময়িক বিদায় জ্ঞাপন করল, সেই সময়ে বাউল গেয়ে ওঠে – 

“ও তো আর ফিরবে না রে, ফিরবে না আর, ফিরবে না রে।

ঝড়ের মুখে ভাসল তরী, কুলে আর ভিড়বে না রে।

কোন পাগলে নিল ডেকে,

কাঁদন গেল পিছে রেখে-

ওকে তোর বাহুর বাঁধন ঘিরবে না রে।”

যদিও উক্ত পরিবেশটি যখন পাঠকের সামনে ভেসে ওঠে, তখনও যুবরাজকে ঠিক বন্দী করার জন্যেই রাজা ডেকেছেন কিনা জানা যায় না। কিন্তু ছোট্ট এই গানের মধ্যে দিয়ে পাঠক ও শ্রোতাদের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দেওয়া হল যে, রাজকুমার সঞ্জয়, যুবরাজ অভিজিতের জন্যে যতই প্রতীক্ষায় থাকুক না কেন, তার সঙ্গে তার আর মিলন হবে না কোনোদিন। বাউল সেই বার্তা জানিয়েই মঞ্চে এসে গেয়ে যায় — ‘ওকে তোর বাহুর বাঁধন ঘিরবে না রে।”

এই অংশের আগে পর্যন্ত নাটকের মধ্যে অভিজিতকে হারানোর কোন আভাস পাওয়া যায় না। এমনকি নাট্য পরিণতির কোন আগাম সতর্কবার্তাও শোনা যায় না। যুবরাজ অভিজিৎ যে মরণ পণের খেলায় মেতে উঠেছিলেন তার ফলস্বরূপ তাঁকে রাজা বন্দী করবেন বা সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাবে, কিম্বা, মুক্তধারার বাঁধ একাই ভাঙবেন— এ সবের কোন ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। সেই ইঙ্গিত দিয়ে গেল বাউল তার গানের বাণীতে– ‘ও তো আর ফিরবে না রে, ফিরবে না আর, ফিরবে না রে’। ফিরবে না বলতে এমন মনে হতে পারতো যে রাজশিবিরে বা কারাগারে যাবৎজীবন বন্দী দশায় কাটাতে হবে অভিজিৎকে। কিন্তু তা যে হবে না, নিতান্ত বিচ্ছেদ জনিত ব্যথা ভারে সকলের মন আতুর হবে তার আভাসও দিতেই বাউল গানে গানে বলেছে – ‘কোন পাগলে নিল ডেকে, কাঁদন গেল পিছে রেখে’— নিজেকে আর সে রেখে যেতে পারলো না, তার জন্যে কেবল কান্নাই সে রেখে গেল, তাই জন্যেই কারো বাহুর বাঁধন তাকে ঘিরবে না।

আলোচ্য নাটকে গানের ডালি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে বৈরাগী ধনঞ্জয়। তার গানের মধ্যে নাটকের মর্মকথা যেমন অভিব্যক্ত, তেমনি শোনা গেছে তার আত্মপরিচয়, আবির্ভাবের কারণ। এবং অবশেষ পরিণতিতে ব্যক্তি অভিজিতের দেহাবসানের পর বিদেহী অভিজিতের পরিব্যাপ্তি-তত্ত্ব। কিন্তু সে পর্যন্ত পৌঁছানোর আগে, ধনঞ্জয়ের মঞ্চে আবির্ভাবের আগে, পাঠকের মানসিক প্রস্তুতির যেটুকু প্রয়োজন ছিল, সে প্রয়োজন সাধন করেছে বাউল— সমগ্র নাটকের মধ্যে এই একটি মাত্র গান দিয়ে। তাই আলোচ্য নাটকে বাউলের গানের ভূমিকা অপরিসীম।

আলোচ্য নাটকে একটি গান দুটি ভাগে বিভক্ত করে আটবার ব্যবহার করেছে ভৈরবপন্থীর দল। তারা কীর্তনের আবহে সমগ্র নাটকের মধ্যে সংকটের আভাস এবং সেখান থেকে পরিত্রাণের আশ্বাস যুগিয়েছে। তাদের গানের আবহে নাটকের বিমলানন্দ পরিণতির প্রতীক্ষার কথা আভাষিত। কিন্তু সে গানের আবহে বারে বারে এই আশ্বাসই ধ্বনিত হয়েছে যে, বরাভয় দেবাদিদেব শঙ্কর তাঁর কল্যাণ হস্তাবলেপে সমস্ত সংকট থেকে উদ্ধার করবেন, ‘মা ভৈঃ’। এমন কি সংলাপের মধ্যেও শোনানো হয়েছে ভৈরবের বরাভয় বার্তা— ‘ভৈরব মন্দিরের ত্রিশূলটাকে অস্তসূর্যের আলো আঁকড়ে রয়েছে যেন ডোববার ভয়ে’। কাজেই অস্তসূর্য যাকে আশ্রয় করে বাঁচতে চায় তিনি যে বিভূতির যন্ত্রর হাত থেকে রাজ্যবাসীকে বাঁচাবেন তাতে আর সন্দেহ কী! কিন্তু, বাস্তবতা যে অলৌকক গণ্ডীর ছায়া মাড়ায় না, পাঠক চিত্তে সে চিন্তা এনে দিয়েছে আলোচ্য বাউলের গান। এ গান না থাকলে পাঠকে চিত্ত নাট্য পরিণতির আভাস পেত না। অপিচ, পরিণতির জন্যে মানসিক প্রস্তুতির অবকাশও পেত না। আলোচ্য নাটকে বাউলের গানটি সেই অপরিসীম ভূমিকা পালন করেছে।