অথবা, বাউলগান বাঙালির শ্রেষ্ঠ মানস সম্পদ ও গর্বের বস্তু – এ উক্তি প্রসঙ্গে বাউলগানের সাহিত্যিক মূল্য আলোচনা কর

উত্তর : বাউলগান বাঙালির প্রাণের ও মনের গান। বাংলার আপামর জনসাধারণের এক উজ্জ্বল নিদর্শনস্বরূপ বিদ্যমান। বাউলগানের সাহিত্যিক মূল্যের চিরন্তন বাণী একক ও সমৃদ্ধির দাবিদার। মানুষ যেখানে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পায় কিংবা অনুসন্ধানের উৎস নির্মাণ করে মুগ্ধতা লাভ করে বাউলগান সেখানে আলোকবর্তিকার ন্যায় দীপ্তি ছড়ায়। এই বাউলগানের মূল বিষয়বস্তু একটি ধর্মতত্ত্ব এবং সেই ধর্মসাধনার ক্রিয়াকলাপ। বহুদিন ধরে বাউলগান ছিল অবহেলিত। রবীন্দ্রনাথসহ তার পরবর্তী গবেষকগণের বিশেষ প্রযত্নে বাউলগান বাঙালির প্রাণের সাহিত্যের মর্যাদা পেয়েছে। বাউলগানের মূল বিষয়বস্তু হলো ধর্মতত্ত্ব। এর পরিধি সংকীর্ণ, সীমিত ও বৈচিত্র্যহীন। তবুও ধর্মতত্ত্বকে বুঝাতে বাউলরা যেটুকু ব্যক্তিগত আবেগ, অনুভূতি ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছেন সেটুকুই এর সাহিত্যিক মূল্য। বাউলগানের সাহিত্যিক মূল্য নির্ধারণে আমরা এর পক্ষে বিপক্ষে সমালোচকদের মন্তব্য পর্যালোচনা করে বাউলগানের সাহিত্যিক মূল্যের মতামত যাচাই করব।

বাউলগানের সাহিত্যিক মূল্য : নিচে বাউলগানের সাহিত্যিক মূল্য আলোচনা করা হলো :

১. বাউলগান সাহিত্য হিসেবে এখনো অপাংক্তেয়। পণ্ডিতদের ধারণা এ গানে কোনো কাব্যগুণ বা সাহিত্যিক মূল্য নেই। তাই সাহিত্য অঙ্গনে বাউলগান স্থান লাভের অযোগ্য।

২. বাউলগানের উপযোগিতা ও সাহিত মূল্য সম্পর্কে সুধী সমাজের লোকদের আন্তরিকতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। কারণ এ বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা হয়নি।

৩. বাউলগান লোকসাহিত্যের অঙ্গ। লোকসাহিত্য সম্পর্কে সুধীজনের আন্তরিকতা নেই। শুধু মৌখিক আগ্রহ আছে। এসব গানের অভ্যন্তরীণ পরিচয়ের অভাবেই পণ্ডিতজনেরা এগুলোর সাহিত্য মূল্য সম্পর্কে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

৪. রবীন্দ্রনাথ বাউলগানকে সাহিত্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। বিভিন্ন বাউল ফকিরের মুখে বাউলগান শুনে তিনি এর গভীর তাৎপর্য ও কবিত্বের প্রতি আকৃষ্ট হন। বিশেষত বাউল আদর্শের সাথে তার মনের মিল হওয়াতে তিনি লালন ফকিরের অনেক বাউলগান সংগ্রহ করেন তবে কোনো কোনো বিদ্বানের মতে, “বাউলগানে যথেষ্ট রসবোধের অভাব রয়েছে এবং এটি গ্রাম্যতা দোষে দুষ্ট।”

৫. পল্লীকবি জসীমউদ্দীনও বাউলগানকে কাব্যগুণশূন্য বলে অভিহিত করেন। তাঁর মতে, পূর্ববঙ্গের অন্যান্য গানে যে পাণ্ডিত্য দেখা যায় তা লালনের গানে নেই। আমরা মনে করি কবির এ মন্তব্য সঠিক নয়।

৬. অপর একদল কাব্যরস পিপাসুর মতে, বাউলগান বাঙালির শ্রেষ্ঠ মানস সম্পদ ও গর্বের বিষয়বস্তু। ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেছেন, “বাউল ধর্মমত এবং তা অবলম্বন করে যে গীত সাহিত্য একদিন রচিত হয়েছিল তা আমাদের জাতীয় জীবনের এক চিরন্তন সঞ্চয়।

৭. ড. আহমদ শরীফ বলেছেন, “বাউল গুরুরা একাধারে কবি, দার্শনিক, ধর্মবেত্তা ও মরমি। তাই বাউলগান একাধারে ধর্মশাস্ত্র ও দর্শন, সাধন সংগীত, ভজনগান ও গীতিকা। সে গান বাঙালির প্রাণের কথা, মনীষার ফসল ও সংস্কৃতির সাক্ষ্য।

৮. সকল সাহিত্যের মতো লোকসাহিত্যেরও ভালোমন্দ ভেদ আছে। রবীন্দ্রনাথের মতে, কবিপ্রতিভা হতে প্রবাহিত রসধারা মন্দাকিনীর মতো অলক্ষ্য লোক থেকে নেমে আসে। তারপর একদল লোক আসে যারা খাল কেটে জল আনে, তারা মজুরি করে, তাদের হাতে এ ধারার গভীরতা ও বিশুদ্ধতা চলে যায়।

৯. হাস্যরসের উপমা, তুলনার দ্বারা আক্রান্ত, একই শব্দের পুনরাবৃত্তি, মৃত্যুভয়ের শাসনে মানুষকে বৈরাগী দলে টানার প্রবণতা বাউলদের বিশুদ্ধতা নষ্ট করেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থ বলেছেন, “অধিকাংশ আধুনিক বাউলগানের অমূল্যতা চলে গেছে, তা চলতি হাটের সন্তা দামের জিনিস হয়ে পথে পথে বিকাচ্ছে।”

১০. আধুনিক বাউলগানের একটি অংশ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের এই অভিমত বাউলগানে গ্রহণযোগ্য। বাউলগানের গোটা অংশ সম্পর্কে এ অভিমত গ্রহণযোগ্য নয়।

১১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্য এক জায়গায় বলেছেন, “এমন বাউলগান শুনেছি- ভাষার সরলতায়, ভাবের গভীরতায়, সুরের দরদে যার তুলনা মেলে না। তাতে যেমন জ্ঞানের তত্ত্ব তেমন কাব্য রচনা, তেমনি ভক্তির রস মিশেছে। লোকসাহিত্যের এমন অপূর্বতা অন্য কোথাও পাওয়া যায় বলে বিশ্বাস করিনে।

১২. এ রকম অপূর্বতা ও বাঁধিকেলের পুনরাবৃত্তি সমস্ত কাব্যধারাতেই বর্তমান। চর্যাপদ, বৈষ্ণব পদাবলী, মঙ্গলকাব্য, মহাকাব্য, গীতিকাব্য সর্বত্রই পাওয়া যায়। এখানেই তার সাহিত্য মূল্যের চিরন্তনতা।

১৩. বাউলগানের চিরন্তন সাহিত্য বৈভব খুঁজে পাওয়া যায়। এসব গান শুধু ধর্মসংগীত নয় জীবন সংগীত ও সামাজিক কবিতাও। সমাজজীবনের দুঃখ-বেদনা, আশা- নিরাশা উৎপীড়ন, অসূয়া থেকে মুক্তি লাভের আকাঙ্ক্ষায় বাউলগান সমৃদ্ধ।

উপসংহার: উপরিউক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, বাউলগানের ছন্দের বৈচিত্র্য, শক্তি ও সম্ভাবনার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন অনেকেই। বাউলগানের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বাউল গানের সাহিত্য মূল্য অন্যান্য সাহিত্যের তুলনায় কম নয়, বরং বেশিই। বাংলা সাহিত্যে বাউলগানের সাহিত্য মূল্য অপরিসীম।