ভূমিকা : রাজশেখর বসুর হাস্যরসাত্মক গল্পের মধ্যে একটা স্বতঃ উৎসারিত প্রাচুর্য ও অনাবিল বিশুদ্ধি আছে, তাঁর রসিকতার প্রক্রিয়ায় ঘোলাটে হয়নি। সূর্যকিরোজ্জল নির্ঝরের ন্যায় অনুজ, সাবলীল নৃত্য ভঙ্গে হাসির ঝিকিমিকি ছড়াতে ছড়াতে বয়ে চলে। রাজশেখর বসু অপরের পরিকল্পনার উপর সূক্ষ্ম জাল রচনা করেননি। তাঁর রসিকতা কেবল আহরণমূলক নয়, অপরের ভাবভঙ্গী বিকৃতিমূলক অনুকরণের উপর খ্যাতি নির্ভর করে না। অবশ্য এই সমস্ত উপাদান তার মধ্যেও অল্প পরিমাণে আছে, কিন্তু এগুলি তার সমস্ত রচনায় গৌণ স্থান অধিকার করে আছে।

রাজশেখর বসুর মৌলিক পরিকল্পনার উদাহরণস্বরূপ গল্পগুলির মধ্যে যেমন—’সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড-এ যৌথ কারবার প্রণালীর অভিনব প্রয়োগ, ধর্মক্ষেত্রে ব্যবসাদারী বুদ্ধির প্রবর্তনের মধ্যে যে তীব্র অসঙ্গতি আছে। তাই হাস্যরসের উপাদান। ‘বিরিঞ্চি বাবা’ যদিও মৌলিকতার দাবী করতে পারেন না। তবুও বিশেষ নতুন আধ্যাত্মিক শক্তির দাবী রেখেছে। ‘ভুশণ্ডীর মাঠে’ গল্পে ভৌতিক জগতে এমন একটা দিক চিত্রিত হয়েছে। যার হাস্যকর অসঙ্গতি আমাদের কৌতুক বোধকে প্রবলভাবে উদ্ভিক্ত করে। উল্টোপুরাণ গল্পটিতে দেখানো হয়েছে—যদি কোন রাজনৈতিক ভূমিকম্পে ইংরাজ ও ভারতবাসীর আপেক্ষিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়, তাহলে সে বিসদৃশ ব্যাপারের সংঘটন হবে তার পরিস্থিতি বর্ণিত হয়েছে।

অন্যান্য গল্পগুলির মধ্যে হাস্যরস যথেষ্ঠ পরিমাণে থাকলেও তার কেন্দ্রস্থ ভাব ঐক্য খুব সুপরিস্ফুট নয়। যেমন—‘লম্বকর্ণ’ গল্পে মৌলিক ভাব অপেক্ষা পারিপার্শ্বিক অবস্থার সরস বর্ণনাই অধিকতর কৌতূহলোদ্দীপক। ‘কচি সংসদ’ এ রেলগাড়ির দ্রুতগতির বর্ণনায় সাধারণত নির্জীব ও মন্থর গতি বাংলা ভাষার মধ্যে চমৎকার গতিবেগ সঞ্চার হয়েছেন। ‘মহাবিদ্যাতে’ মহাবিদ্যা লাভের জন্য বিভিন্ন শ্রেণীর ব্যক্তিবর্গের আগ্রহ আশানুরূপ বিচিত্র সুরে ধ্বনিত হয়ে ওঠেনি। ‘দক্ষিণ রায়’ গল্পটির গাঁথিনী যেন এমন দুর্বল, ‘স্বয়ংবরাতে’ উদ্ভট খেয়াল বাস্তবতার মাধ্যাকর্ষণ অগ্রাহ্য করে একেবারে কল্পনারাজ্যে উধাও হয়ে গেছে। ‘জাসলী’ গল্পে—তপস্বী জীবনের সাধারণ গতি ও আদর্শের ব্যঙ্গাত্মক বর্ণনা।

রাজশেখর বসুর পৌরাণিক গল্পগুলিতে কোথাও তিনি স্বর্গীয় ব্যাপারকে মানবিক মানদণ্ডে কোথাও বা মানবিক ঘটনাকে স্বর্গীয় মানদণ্ডে মেপে উভয়ক্ষেত্রেই অসঙ্গতির হাস্যকরতা আবিষ্কার করেছে। যেমন—‘ভূশন্ডির মাঠ’ এ হিন্দুধর্মের জন্মান্তর বাদ ও পাতিব্রত্যের আদর্শ প্রেতলোকে এক তুমুল বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। ‘হনুমানের স্বপ্ন’ এ হনুমানের বীরত্ব তার বিবাহ বিভ্রাট থেকে রক্ষা করতে পারেনি, ‘ভারতের ঝুমঝুমি’তে পুরাণ প্রসিদ্ধ ব্যক্তিরা আধুনিক সমস্যার জালে জড়িয়ে একেবারে নাজেহাল। ‘প্রেমচক্রে’ ঋষিকুমারেরা মানব প্রেমের কুখ্যাত ত্রিভুজে আবদ্ধ হয়েছে। ‘দশকরণের বামপ্রস্থ’ এ দেবতার বরে মানুষের অতিরিক্ত শক্তিলাভ কেমন করে তার সুখের পরিবর্তে অস্বস্তির কারণ তার কৌতুকাবহ অনুকরণ। ভীমগীতা ও তৃতীয় দ্যুৎ সভা’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

এছাড়া মাঝে মাঝে অমরবৃন্দ আধুনিক সমাজের অসহনীয় ক্লেশ নিবারণের জন্য মর্ভাভূমিতে অবতীর্ণ হয়ে সমাধানের উপায় চিন্তা করতে মিলিত হয়েছে। যেমন রামরাজ্য, অবিধাতা, গন্ধমাদন বৈঠক, বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

আবার মানব যেখানে দেবতার সাহায্য প্রার্থী হয়েছে বা পরলৌকিক রহস্য ভেদ করবার চেষ্টা করেছে সেখানেও হাসির লহর ছুটেছে। যেমন— বিরিঞ্চিবাবা, ধুস্তরী মায়া, বদন চৌধুরীর লোকসভা, যদু ডাক্তারের পেসেন্ট, ষষ্ঠীর কৃপায় উল্লেখ্যনীয়।

অবশ্য লেখক যে সর্বদা কল্পনার উদ্ভট ধূম্রলোকে বিচরণ করেছেন তাই নয়, বহু স্থানে তিনি অতি প্রাকৃত স্পর্শহীন বস্তুর জীবনে অবতরণ করে তার অন্তর্নিহিত উপাস্য অসঙ্গতিগুলি আবিষ্কার ও উপভোগ করেছেন। যেমন—শ্রীশ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড, চিকিৎসা সংকট, গড্ডলিকা, লম্বকর্ণ, হনুমানের স্বপ্ন, কজ্জলীর কবি সংসদ, রাজভোগ, লক্ষ্মীর বাহন, সিদ্ধিনাথের প্রলাপ, অক্রুর সংবাদ, রটত্তীকুমার বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

উপসংহার : পরিশেষে বলতে হয় যে রাজশেখর বসুর হাস্যরসের প্রধান উপাদান হাস্যজনক পরিস্থিতির উদ্ভাবন নৈপুণ্য। উত্তর প্রত্যুত্তরমূলক রসিকতার প্রাধান্য তাঁর রচনায় নেই। তিনি হাস্য রসিকের দৃষ্টিকে নিয়ে জীবনের অসামঞ্জস্যপূর্ণ খণ্ডাংশগুলি দেখে তাদের মধ্যে হাস্য প্রবাহ ছুটিয়েছেন, তিনি জানেন, যে, রসিকতার প্রকৃত উৎস শাণিত তীক্ষ্ণাগ্র বাক্য পরম্পরা সংযোগে নয়। সংসারের অধিকাংশ ব্যক্তি unconscious humorist অজ্ঞাতসারে হাস্যরস সৃষ্টি করে। তারা খুব গম্ভীরভাবে একনিষ্ঠ একাগ্রতার সঙ্গে নিজ নিজ জীবন নীতি ব্যাখ্যা করে অপরে তার মধ্যে উপহাস্যতার সন্ধান পেয়ে তাকে হাসির খোরাকে পরিণত করে। এই লক্ষণটি রাজশেখর বসুর মধ্যে সুপরিস্ফুট।