উপন্যাসে সমাজ-বাস্তবতার ক্ষেত্রটি বাস্তবতা থেকে স্বতন্ত্র। বাস্তবতার ধারণা উনিশ শতকের উপন্যাসে পাওয়া যায়। এই বাস্তবতা ঘটনাস্রোতের নিছক প্রতিবিম্ব নয়। এই ধরনের বাস্তবতার মধ্যে জীবনের বিশ্বাস্য চিত্রই শুধু ফুটে ওঠেনি, ফুটেছে লেখকের সমাজদৃষ্টি। ‘সমাজ বাস্তবতা’-কথাটি বাস্তবতার ধারণার থেকে অল্পবিস্তর স্বতন্ত্র। এখানে সমাজের রূপায়ণই সমাজ বাস্তবতা নয়, সমাজের পরিবর্তনের যে ইঙ্গিত সাহিত্যে বর্তমান, তাই সমাজ-বাস্তবতার বিষয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আধুনিক বাংলা সাহিত্যে বাস্তবতার প্রতিনিধি। বাস্তবতার মধ্যে জীবনচিত্র অঙ্কনের যে প্রবণতা বিদ্যমান, তা মানিকের সাহিত্যে ‘দিবারাত্রির কাব্য’ বা ‘জননী’ থেকেই ছিল। কিন্তু ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ বা ‘পদ্মানদীর মাঝি’-র বাস্তবতা ‘দিবারাত্রির কাব্যের’ বাস্তবতা থেকে আলাদা। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ বাস্তবধর্মী উপন্যাস, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এখানে ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা’ সমাজ পরিবর্তনের অঙ্গীকার, সংগ্রাম বা হতাশাজয়ী আশাবাদের কথা বর্ণিত হয়নি। সমাজ-বাস্তবতা সমাজসত্যের রূপায়ণ, সেখানে সমাজ পরিবর্তনের ইঙ্গিতও বর্তমান, কিন্তু ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা’ কথাসাহিত্যের দিকপাল গোকী-বর্ণিত বাস্তবতার নতুন পর্যায়। এই পর্যায়ের বাস্তবতায় আছে সংগ্রাম ও বিপ্লবের চেতনা। জীবনের বাস্তবতার অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সন্ধানী যাত্রী। ‘দিবারাত্রির কাব্য’-র এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক অন্তর্দ্বন্দ্বের চিত্র। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’-য় এক অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে লড়াই। এই লড়াই পরবর্তীকালে সংগ্রামী মানুষের প্রতিরোধের কাহিনী হয়ে উঠেছে—‘চিহ্ন’, ‘সর্বজনীন’, ‘চিন্তামণি’, ‘আরোগ্য’, ‘মাশুল’ প্রভৃতি উপন্যাসে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যে নানা পর্যায় আছে। সমালোচকগণ সেই পর্যায়গুলি নানা ভাগে বিভক্ত করেছেন। ফ্রয়েডীয় অনুসন্ধিৎসা থেকে মার্ক্সীয় মননে বৈজ্ঞানিক উত্তরণ মানিক সাহিত্যের এক নতুন ভাবপন্থা।
একজন সমালোচক বলেছেন: বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিনির্ভর বাস্তবতার তন্নিষ্ঠ শিল্পীরূপেই বাংলা কথাসাহিত্যে মানিকের বিশেষ প্রতিষ্ঠা। আনুষ্ঠানিকভাবে বিজ্ঞানের ছাত্র বলেই কেবল নয়, তাঁর মননে প্রত্যয়ে এক-কথায় তার সমগ্র সত্তায় বৈজ্ঞানিক বিচারসহ বাস্তবতার চেতনা বিশেষ তাৎপর্য লাভ করেছিল সন্দেহ নাই। তাই অল্প বয়স থেকেই তাঁর যুক্তিনিষ্ঠ জিজ্ঞাসু মন খুঁজতে পূর্বসূরীদের সাহিত্যে, গল্প, উপন্যাসে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি। আর সেখানে তা না পেয়ে তাঁর বিক্ষুব্ধ শিল্পীসত্তা মনে মনে প্রবল প্রতিবাদ করেছে সমকালীন সাহিত্যের বিরুদ্ধে। আর সেই ক্ষেত্রে এই ধারণাই স্পষ্ট জোরালো হয়ে উঠেছে তার মনে যে বিজ্ঞান প্রভাবিত মন উপন্যাস লেখার জন্য অপরিহার্যরূপে প্রয়োজন।” এই বিজ্ঞানমুখী বাস্তবতা আধুনিক বাস্তবতার উৎসমুখ। মানিকের জীবনচেতনা জীবনের অস্পষ্ট রহস্যলোককে যেমন সন্ধান করেছে, তেমনি জীবনের বাস্তবভূমিকেও উচ্ছল করে তুলেছে। উপন্যাসে সমাজ-বাস্তবতার মধ্যে মানুষের সংগ্রামের কাহিনীও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বলে এই বাস্তবতা কেবল বহির্পটের বাস্তবতা নয়, অন্তর্পটের বাস্তবতা। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’-য় নরনারীর মনের চিত্র পরিস্ফুট হয়েছে তার সমগ্র আলো-আধারির মধ্য দিয়ে। এই চরিত্রের অন্তরলোকের নানা স্তর, নানা সূক্ষ্ম জটিলতা এখানে ধরা পড়েছে।
‘পুতুল নাচের ইতিকথা’-য় শশী চরিত্রই উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দু। গাওদিয়ার গ্রাম পরিবেশের সমাজ-চিত্র এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু। শশীকে কেন্দ্র করে গ্রামের নানা চরিত্রের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা উপন্যাসে প্রাধান্য পেয়েছে। গ্রামের মানুষের সুখদুঃখ, রোগ-ব্যাধি, সংস্কার ও বেদনা, বিশ্বাস ও অবিশ্বাস, বিবাহ ও স্বপ্নভঙ্গ সবই নানা আয়তনের মধ্যে রূপ নিয়েছে। গোপাল-শশী সম্পর্কের দ্বন্দ্ব ও সংঘাত, যামিনী কবিরাজ ও সেনদিদির সম্পর্কের সংঘাত। যামিনী কবিরাজের কবিরাজীতে বিশ্বাস ও এ্যালোপ্যাথি-শাস্ত্রে অবিশ্বাস, এই দুই শাস্ত্রের চিকিৎসার দ্বন্দ্বের পশ্চাতে নরনারীর হৃদয়াবেগের দ্বন্দ্ব, মতিকে কেন্দ্র করে নানা ঘটনার আবির্ভাব, আকস্মিকভাবে কুমুদের আবির্ভাব, প্রবীর বেশে অভিনয়, গ্রামের যাত্রার চিত্র, যাত্রার আসরে ধনী-দরিদ্রের শ্রেণীবৈষম্য, কুমুদকে কেন্দ্র করে মতির উন্মাদনা, বিন্দুর নাটকীয় ও উত্তেজনাকর পরিবেশে বিবাহ, নন্দলালের সঙ্গে গ্রামত্যাগের ঘটনা ও শহরে গিয়ে ঘৃণ্য জীবনযাপন এসবই গ্রামজীবনের সমাজবাস্তবের এক একটি নিপুণ আলেখ্য। প্রত্যেকটি চিত্র বাস্তবধর্মী ও বাস্তবধর্মী চিত্রের মধ্যে গ্রামসমাজের রূপচিত্র অঙ্কিত হয়ে আছে।
গ্রামসমাজের দুঃখকষ্টপূর্ণ জীবনযাত্রার মধ্যে কেউ স্থির হয়ে বসে নেই। সকলেই উন্নততর জীবনযাত্রায় উত্তীর্ণ হতে চায়। মতির জন্য পাত্র দেখতে গিয়ে হারু ঘোষ অপঘাতে মরে—এই দিয়ে উপন্যাসের শুরু। এ সম্পর্কে লেখক ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে “গ্রামে কি মতির পাত্র মিলিত না? হারুর ছিল উচ্চাশা। ছেলেবেলায় হারু স্কুলে পড়িয়াছিল। বড়ো হইয়া হারু বড়লোক হইয়াছিল। তারপর গরীব হইয়া পড়িলেও মনটা হারুর বিশেষ বদলায় নাই। গাওদিয়ার গোপ সমাজ পরিহাস করিয়া তাহাকে বলিত ভদ্দরলোক।” এই ভদ্দরলোক হবার প্রবণতা গ্রামসমাজের বর্ণাশ্রম ধর্মের গভীরে আছে মানুষের শ্রেণী-উত্তরণের প্রবণতা। এই পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাই উপন্যাসের সমাজ-বাস্তব। শশী মানুষের দুঃখে কাতর হয়—সেক্ষেত্রে বৈষয়িক বুদ্ধি বা স্বার্থপরতা প্রধান হয়ে ওঠে না। এ ব্যাপারে অবশ্য শশীর ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের প্রাধান্যই প্রধান, ‘সেনদিদি অসুস্থ হয়ে পড়লে “শশী প্রাণ দিয়া সেনদিদির চিকিৎসা ও সেবা আরম্ভ করিল। অন্য রোগীরা তাহাকে ডাকিয়া পায় না। শুধু সেনদিদির ব্যবস্থা করিতে হইলে শশী হয়তো চারদিকে তাকানোর সময় পাইত। …..চিকিৎসা আরম্ভ করিয়া এ বাড়িতে গোপালের এবং ও বাড়িতে যামিনীর উপদেশ, সমালোচনা ও বাধাদানের বহরে সে বিপন্ন ও বিব্রত হইয়া রহিল। ব্যাপারটা যত রহস্যময় হোক, শশী একা সেনদিদির তিনটি যমের সঙ্গে লড়াই করিতে লাগিল।” সেনদিদির স্বামী যামিনীর সঙ্গে শশীর মত ও পথের বিরোধ, সেনদিদির মতো অসামান্য সুন্দরী স্ত্রী’র প্রতি অবহেলা এবং সেই স্ত্রীর ব্যাধি নিরাময়ের জন্য শশীর অত্যধিক উৎসাহ সবই সেকালের গ্রামবাংলার সমাজমনস্তত্ত্ব চিত্র। সেনদিদির চিকিৎসাকে কেন্দ্র করে গোপালের সঙ্গে তার মতান্তর ও মনাত্তর মনস্তাত্ত্বিক কারণসঙ্গত হলেও বাস্তব জীবনে স্বাভাবিক ঘটনা।
গাওদিয়ার সমাজে ধর্ম ও উৎসব গ্রামজীবনের আর এক বাস্তবধর্মী দিক। লেখক এই বাস্তব ঘটনাকে সমাজবাস্তবের আলোকে কেমন করে ব্যাখ্যা করেছেন, তার বর্ণনা পাওয়া যায় গ্রামের পূজার উৎসব উপলক্ষে যাত্রার বর্ণনায়। গ্রামসমাজে উৎসব জমিদার কেন্দ্রিক। জমিদারের বাড়ির মেয়েদের উৎসবের অনুষ্ঠানগুলিতে বিশেষ করে যাত্রার আসরে আলাদা সমাদর, আলাদা সম্মান। গাওদিয়ার দরিদ্র গ্রামবাসীর উৎসবের মেলা জাঁকজমক সবই অসামান্য। “উৎসব সহজ নয়, গ্রামের জমিদার শীতলবাবুর বাড়ি তিনদিন যাত্রা, পুতুলনাচ, বাজি পোড়ানো, সাতগাঁয় মেলা—পূজা তো আছেই। গ্রামবাসীদের ঝিমানো জীবনপ্রবাহে হঠাৎ প্রবল উত্তেজনা সঞ্চার হইয়াছে। কেবল শশী এবার সেনদিদিকে লইয়া বড়ো ব্যস্ত।” গ্রামে বিনোদিনী অপেরা পার্টি এসেছে, চারিদিকে হৈ-চৈ। এই যাত্রাদলে শশীকে অবাক করে এসে দেখা দেয় কুমুদ। প্রবীরের বেশে এসে মঞ্চে দাঁড়িয়ে মতির হৃদয়হরণ করে। গ্রামীণ যাত্রার বর্ণনা যুক্ত হয় হৃদয়াবেগের এক বিরাট অধ্যায়ে। সমাজের চিত্র থেকে জীবনের চিত্রে রূপান্তরিত হয় এই উপন্যাসে। গ্রামের পর্দাপ্রথা চেনা মানুষের জন্য শিথিল। কিন্তু কুমুদের পথে এই পর্দাপ্রথা ভেদ করে শশীর সংসারে ঘরোয়া হয়ে উঠতে পারেনি। এটাও সামাজিক জীবনের চিত্র। যাত্রার বর্ণনাতে এই বাস্তবধর্মিতার প্রাচুর্য লক্ষ্য করা যায়। যাত্রার আসরে চিকের আড়ালে মহিলাদের আসন। আসরে মহিলাদের মধ্যে ঠেলাঠেলি, গালাগালি সবই অনুপুঙ্খভাবে লেখক বর্ণনা করেছেন। মতি কুসুমের সঙ্গে এই আসরে এসে কতখানি নাস্তানাবুদ হয়েছে এখানে তার বর্ণনা লক্ষণীয়। কুসুম মতির হয়ে চরণ দত্তর স্ত্রীকে যথেষ্ট রুঢ় ভাষায় কথা বলেছে। তবু এত লোক, এত আলো, এত শব্দ দেখে সকলকে নেশার মতো পেয়ে বসেছে। কনসার্ট-ঐক্যতান এসব শুনলে উত্তেজনা হয়। যাত্রার আসরে শীতলবাবুদের বাড়ির মেয়েদের গায়ের জামা, বোম্বাই শাড়ি সব গ্রামের মধ্যবিত্ত ঘরের মতির চোখে কৌতূহলোদ্দীপক হয়ে ওঠে। যাত্রার আসরে শীতলবাবুর পুত্রবধূ মতিকে দেখে শশী ডাক্তারের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা জিজ্ঞাসা করে। হারু ঘোষের মেয়েকে শীতলবাবু-বিমলবাবুর পরিবারের মেয়েদের মধ্যে গুঁজে দেওয়ার জন্য তারা অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠে। মতির সরল মনে শীতলবাবু বিমলবাবুর বাড়ির মেয়েদের ব্যবহার অভিনব বলে মনে হয়েছে। তার যাত্রা দেখার উৎসাহ নষ্ট হয়ে গেছে। তবু তার মনে হয়েছে “কি সুন্দর ওই মেয়ে মানুষগুলি। এক-একজন যেন এক একটি ছবি।” গ্রামবাংলার যাত্রার আসরে সমাজের শ্রেণীবৈষম্যের বাস্তবচিত্র সুস্পষ্টভাবে অঙ্কিত হয়েছে।” এই বর্ণনাই এই উপন্যাসের সমাজ-বাস্তবের চিত্র।
গ্রামের জমিদার শীতলবাবু-বিমলবাবু সেকালে জমিদারের মতো সম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও ধর্মকর্মের ওপর আগ্রহী। শীতলবাবু কেমন লোক, নন্দলালের প্রশ্নের উত্তরে শশী বলে “খুব ধর্মচর্চা করেন।” সেকালে জমিদারের স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে ধর্মকর্মের আচার-আচরণের যোগ কত গভীর এসব থেকে বোঝা যায়। অর্থবান নন্দলাল বিন্দুকে বাপের বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়ে গোপালকে বা শশীকে শাস্তি দেয়নি। তার উঠতি ধনৈশ্বর্যের অর্থদন্ত তাকে তার যথার্থ পারিবারিক বেষ্টনী থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। শশী নন্দলালকে নিতে আসে জমিদারের গাড়ি নিয়ে। নন্দলাল জমিদার সম্পর্কে কৌতূহলী হয়। কিন্তু শশীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে শ্বশুরবাড়িতে যাবার সময় পায় না। শশী-নন্দলালের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ব্যবধান যে কতখানি তীব্র নন্দলালের অমানবিক ব্যবহারে তা বোঝা যায়। “মোটরে চড়ার অভ্যাস নন্দলালের আছে, শশী তো চাপে গোরুর গাড়ি।” এই উক্তির মধ্যে গ্রামসমাজ ও শহরের সমাজের দুই গোত্রের মানুষের মধ্যে শ্রেণীগত ব্যবধান লেখক ব্যাখ্যা করেছেন।
গ্রামের পটভূমিতে শশীর অবস্থা অবহেলার যোগ্য নয়। তবু শশীর বাঁচার ইচ্ছায় ক্লান্তি আসে। সে অবিরাম রোগীর ডাকে সাড়া দিয়ে অর্থ উপার্জন যেমন করে, তেমন লোকের সেবাও করে। কিন্তু তার বাড়িতে ক্ষেমি ও কুন্দর অভিযোগের শেষ নেই। দরিদ্রের ভাগ্যে শুধু রোগভোগ ও মৃত্যু। এতেই তাদের জীবনের আনন্দ। “রোগে ভুগিয়া অকারণে মরিয়া এরা বড় আনন্দে থাকে। স্ফূর্তি নয়, — আনন্দ, শান্ত স্তিমিত একটা সুখ। স্বাস্থ্যের সঙ্গে প্রচুর জীবনীশক্তির সঙ্গে ওদের জীবনের একান্ত অসামঞ্জস্য। ওরা প্রত্যেকে রুগ্ন অনুভূতির আড়ত। সঙ্কীর্ণ সীমার মধ্যে ওদের মনে বিস্ময়কর ভাঙা-গড়া চলে। পৃথিবীতে ওরা অস্বাস্থ্যকর জলাভূমির কবিতা : ভাপসা গন্ধ, আবছা কুয়াশা, শ্যামল শৈবাল, বিষাক্ত ব্যাঙের ছাতা, কলমি ফুল। সতেজ উত্তপ্ত জীবন ওদের সহিবে না। গ্রামের দরিদ্র মানুষের সম্পর্কে লেখকের মন্তব্য অর্থবহ।
গাওদিয়ার গ্রাম্যজীবনে হাসিকান্না, সুখদুঃখ সমান্তরাল ধারায় প্রবাহিত হয়ে যায়। এই আবর্তের মধ্যে সমাজের যে বাস্তব রূপ ফুটে ওঠে তা জীবনপ্রেমের ও জীবন অপ্রেমের। “গ্রাম্য জীবনে আবার শশীর বিতৃয়া আসিয়াছে। মাঝখানে কিছুদিন সে যেন এখানে বাস করিয়াছিল অন্যমনস্কের মতো।” বাসুদেব বাড়ুয্যে গ্রামের মানুষ, জমিজমা নেই। সে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ম্যালেরিয়ায় ভুগে দেশে থাকতে আর কে চায়—গ্রাম জুড়ে এখানে ওখানে পোড়ো ভিটা খাঁ-খাঁ করে। বাড়ুয্যে কাকার দুটো ছেলে কৃতী, তবু শশীর ডাক্তারী পরিষেবার দক্ষিণা সে বাকী রাখে। এদের কাণ্ড দেশে শশী তীব্র ভাষায় গালাগালি দিতে ইচ্ছা করে। সে কটু আনন্দের নিবিড় স্বাদ পায়। গ্রামের মানুষের সঙ্গে এইসব সম্পর্কগত বিন্যাস ও জটিলতাই উপন্যাসের সমাজ-বাস্তবের চালচিত্র।
গ্রামবাংলার দুঃখ-দারিদ্র্য ও বাস্তবজীবনের নানা সংঘাতকে কাহিনীর মধ্যে জীবন্ত করে ফুটিয়ে তোলার দুঃসাহসিকতায় মানিক অদ্বিতীয়। এক্ষেত্রে তিনি আধুনিক কথাসাহিত্যের পথিকৃৎ। এই দিক থেকে তিনি বাস্তবতার পথিকৃৎ ও সমাজ-বাস্তবধর্মী উপন্যাসের একজন কৃতী স্রষ্টা।
Leave a comment