কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী হলেন মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের একজন শ্রেষ্ঠ কবি। তাঁর দেবতার মহিমা বর্ণিত হয়েছে। তিনি ঔপনাসিক প্রতিভার অধিকরী সমালোচকের দৃষ্টিতে কবি মুকুন্দরাম। প্রসঙ্গক্রমে ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়-এর মন্তব্যে গলা মিলিয়ে বলতে হয়।–“দক্ষ ঔপনাসিকের অধিকাংশ গুণই তাঁর মধ্যে বর্তমান ছিল। এ যুগে জন্মগ্রহণ করিলে তিনি যে একজন কবি না হইয়া ঔপন্যাসিক হইতেন তাহাতে সংশয় মাত্র নাই।”

মুকুন্দরাম তাঁর কাব্যকে কাব্যকে ‘অভয়া মঙ্গল’ নামে ভূষিত করছেন। কিন্তু বারেবারেই বলেছেন-

“দিবা নিশি তুয়া সেবি রচিল মুকুন্দ কবি নৌতুনমঙ্গল অভিলাষে।।”

যে কাব্যকে আমরা চণ্ডীমঙ্গল রূপে জানি। নৌতুন মঙ্গল নামে অভিহিত করার কারণ কী? একটা প্রচলিত কাহিনিকে কাব্যরূপ দেবার পরও কেন তার নাম দেওয়া হল নৌতুন মঙ্গল? তার মধ্যে কি নতুনত্ব আছে। কবি যে তাঁর কাব্যে অভিনবত্ব সৃষ্টি করে ‘নূতন’ নাম দিয়েছেন এই নূতনত্বটাই তাঁর ঔপন্যাসিক ধর্ম। এ প্রসঙ্গে ক্ষুদিরাম বসু বলেছেন—“কবি কঙ্কনের কবিত্ব প্লট ও কাহিনি সৃষ্টিতে নয় কিছুটা সামঞ্জস্য বিধানে হতে পার কিন্তু তার আশ্চর্য নৈপুণ্য হল বর্ণনা শক্তি। কি সমাজ কি ব্যক্তি, ঘটনা, কি চরিত্রের বর্ণনা, সর্বত্রই তিনি সংক্ষিপ্ততার মধ্যবর্তী।”

কয়েকটি মাত্র বিষয়ে কয়টি মাত্র কথা তিনি এমনভাবে উল্লেখ করতেন যাতে না বলা কথা আপনা থেকেই প্রকাশ পেত।

উপন্যাসের ধর্ম হল একটা নিটোল কাহিনিবৃত্তি গঠন করা। সম্ভবত উনিশ শতকের মাঝামাঝি পাশ্চাত্য অনুকরণে দেশে উপন্যাসের আবির্ভাব ঘটে। উপন্যাসের কাহিনি ধারা কয়েকটা চরিত্রের কার্যকলাপ বর্ণনার মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণতা অর্জন করে। মুকুন্দরামের চণ্ডীমণ্ডলে সে সম্পূর্ণতা আছে। তাতে দেব ও মনুষ্য নামে দুটি খণ্ড। দেবখণ্ডে সংসারে অভাব অনটনের হাত থেকে রেহাই পেতে শিব-পার্বতী মর্তে পূজা প্রচার করবেন নিজেদের। সুকৌশলে ইন্দ্র পুত্র নীলাম্বর ও তাঁর স্ত্রী ছায়াকে মর্ত্যে কালকেতু ও ফুল্লরা রূপে পাঠিয়েছেন পূজা প্রচারের মাধ্যম হিসাবে। এরাই নরখণ্ডের মনুষ্য। তবে স্বর্গ বা দেব খণ্ডের চিত্রাবলী সংসার জীবনের ও দুঃখ-দারিদ্র, অভাব-অনটন ও বাঙালী পরিবারের জীবনকেই মনে করিয়ে দেয়। দেবীকে মাতৃরূপে এবং মধ্যবিত্ত বাঙালীর গৃহিণীরূপে উপস্থাপিত করায় ‘নূতন মঙ্গল’ এর অভিধায় চণ্ডীমঙ্গল ভূষিত হয়েছে।

উপন্যাসের দ্বিতীয় ও অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল চরিত্র পরিকল্পনা। কবিকঙ্কন যে খল চরিত্র (ভাঁড়ু দত্ত, মুরারি শীল) সৃষ্টি করেছেন সেখানে ঔপন্যাসিক চেতনা প্রতিভাত হয়েছে। ভাঁড়ু দত্ত চরিত্রটি কবির মৌলিক সৃষ্টি না হলেও কবি চরিত্রটি সৃষ্টিতে সম্পূর্ণতা দান করেছেন। এ প্রসঙ্গে প্রমথনাথ বিশী বলেছেন—“এই সবচেয়ে গ্রাম্য ব্যক্তিটি সাহিত্যিক গ্রাম্যতা দোষের ঊর্ধ্বে উঠিয়াছে।” অর্থাৎ নিজের চালচলন, কথাবার্তা আচার আচরণ সাময়িকের জন্য দর্শক, পাঠককূলের কাছে বিরাগ ভাজন হয়ে উঠলেও ভাঁড়ু দত্ত মুকুন্দরামের অন্যন্য সৃষ্টি। অনূরূপ মুরারি শীল ব্যবসায়িকরূপে চিহ্নিত হয়ে সামঞ্জস্যতা রক্ষা করেছে। তার চরিত্রের আসল গুণ সুযোগ সন্ধানী ও কূট কৌশলী। এছাড়া এ কাব্যের মুখ্যচরিত্র ফুল্লরা। রবীন্দ্রনাথ যাকে বাস্তবানুগ (নারী) চরিত্ররূপে স্বীকার করেছিলেন তার মধ্যে নারী মনস্তত্ত্বের অপূর্ব জ্ঞানের পরিচয় পেয়ে ষোড়শী রমণী রূপিনী দূর্গার সঙ্গে কথোপকথন কালে তা প্রকাশ পেয়েছে। এছাড়া তার বারমাস্যাতেও দারিদ্র্যেপূর্ণ গৃহবধূর কর্তব্যপরায়ণতা প্রকাশ পেয়েছে। এছাড়া কালকেতুর ভোজন ও শয়ন দৃশ্যে চোখ দিলে একটু কৌতুক ও বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়। কিন্তু তার বীরত্ব ও সবুদ্ধি, কর্মকুশলতা ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যথেষ্টই প্রসংশার যোগ্য।

উপন্যাসের অন্যতম শর্ত হল বাস্তব সত্যের কঠিন ভূমির উপর দাঁড়িয়ে কাহিনিও চরিত্রের বর্ণনা, দান মুকুন্দরাম তাঁর কাব্যে সে নীতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। পশু শিকারে চতুর কালকেতু মৃগয়ার পেছনে ছুটে ক্ষুধার্ত দুঃখার্ত হয়ে বাড়ী ফেরার বর্ণনা সত্যি অপূর্ব। কালকেতুর ভয়ে পশুগণ দেবীর কাছে ক্রন্দন করোছে। কবির উদার মানবিকতার স্পর্শে পশুগুলি যেন মানুষের ভূমিকা নিয়ে বাস্তব জীবনের স্বরূপ উদ্ঘাটন করেছে।

সামাজিক অভিজ্ঞতাই ঔপন্যাসিকের বিশিষ্ট গুণ। মুকুন্দরাম তাঁর কাব্যে এ গুণ অটুট রেখেছিলেন। মুরারি শীল, ভাঁড়ু দত্ত তার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলি একাধারে যেমন জীবস্ত তেমন বাস্তব এবং ঘটনাপ্রবাহ সাবলীল ভঙ্গিমার সামঞ্জস্য লাভ করেছে। গ্রন্থ উৎপত্তির কারণ, হর গৌরীর সংসার যাত্রা, পশুদেরকাতর ক্রন্দন, ফুল্লরার বারমাস্যা, গুজরাট নগর পত্তন, কালকেতুর অঙ্গুরী বিক্রয় ইত্যাদি বর্ণনায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন কবি।

অবশেষে বলা যায়, ‘কালকেতু উপাখ্যান’ মধ্যযুগীয় মঙ্গল সাহিত্যের অপূর্ব সৃষ্টি। কবি তাঁর কাব্যের মধ্যে জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, দুঃখ-দারিদ্র-কৌতুক নিতান্ত বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রকাশ করেছেন। তাই তো আশুতোষ বাবুর ভাষায় বলতে হয়—“যে কবি এতখানি রসিক তিনি প্রত্যক্ষ জীবনকে অতিক্রম করিয়া বহুদূর অগ্রসর হইতে পারেন নাই, সেজন্য তাঁহার কাব্য লঘুভার কল্পনার পক্ষবিহারী না হইয়া বাস্তবজীবনের গুরুভারে মন্থর গামী হইয়াছে।

এই বাস্তব জীবনের গুরুভার ঔপন্যাসিকের মূল হাতিয়ার। কবি মুকুন্দরাম তাই মধ্যযুগীয় কবিকুলের মধ্যে এই হাতিয়ারধারী প্রথম সৈনিক।