ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ (জন্ম ১৮৬৩, মৃত্যু ১৯২৭) একাধারে বিজ্ঞানের ছাত্র ও অধ্যাপক এবং সাহিত্যিক। সাহিত্যিক পরিচয়টিই মুখ্য। তিনি বিখ্যাত নাট্যকার।

তাঁহার কৌলিক উপাধি বন্দ্যোপাধ্যায়। নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ-পুত্র, রসায়নশাস্ত্রে এম. এ ডিগ্রী লাভ করেন জেনারেল এসেম্রীজ্ ইন্‌স্টিটিউশনে (বর্তমান স্কটিশ চার্চ কলেজ) কেমিষ্ট্রির অধ্যাপকরূপে নিযুক্ত হন। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি অধ্যাপনার কাজ ছেড়ে নাটক রচনাতেই আত্মনিয়োগ করেন। স্বদেশী আন্দোলনের যুগে (১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে) দেশাত্মবোধের প্রেরণায় যে জাতীয় মহাবিদ্যালয় (Bengal National College) প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহার অধ্যাপকবর্গের তালিকায় ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের নামও দেখা যায়। তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদেরও বিশিষ্ট সভ্য ছিলেন এবং এক সময় এই পরিষদের সহকারী সভাপতিও নিযুক্ত হয়েছিলেন।

ক্ষীরোদপ্রসাদ ভারতীয় ধর্মজগৎ হতেও বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। তাঁহার সহকর্মী বন্ধু অধ্যাপক মন্মথ মোহন বসু বলেছেন—“আধ্যাত্মিক শক্তিতে বিশ্বাস ক্ষিরোদপ্রসাদের জন্মগত ছিল। তিনি এক তান্ত্রিক সাধকের বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। তাঁহার এই পূর্বপুরুষের অলৌকিক শক্তি সম্বন্ধে নানা গল্প শুনা যায় …….. তাঁহাদের বংশ ব্রাহ্মণের গুরুবংশ, তাঁহার সুশিক্ষিত শাস্ত্রজ্ঞ পিতা ছিলেন স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ বহু নিষ্ঠাবান্ ব্রাহ্মণের দীক্ষাগুরু।” (বাংলা নাটকের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ)।

ক্ষীরোদপ্রসাদ শ্রীশ্রীমা সারদাদেবীর নিকট হতে দীক্ষা গ্রহণ করেন। ঠাকুর রামকৃষ্ণের উদার ধর্মবোধ ও স্বামী বিবেকানন্দের বলিষ্ঠ কর্মযোগ তাঁর জীবনে প্রভাব বিস্তার করেছে। রামকৃষ্ণ মিশনের পূজ্যপাদ স্বামী সারদানন্দ ও স্বামী শিবানন্দ মহারাজদের সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গ যোগ ছিল। ক্ষীরোদপ্রসাদের ‘ভীষ্ম’ নাটক স্বামী সারদানন্দ ও ‘নর-নারায়ণ’ স্বামী শিবানন্দের নামে উৎসর্গীকৃত। শ্রীঅরবিন্দের বিপ্লবী মতবাদ এবং দিব্যজীবনের ভাবধারাতেও তিনি অনুপ্রাণিত ছিলেন। ধর্মের অলৌকিক রহস্যের প্রতিও তাঁহার তীব্র আকর্ষণ ছিল। তিনি থিয়োসফিক্যাল সোসাইটিরও একজন বিশিষ্ট সভ্য ছিলেন এবং ‘অলৌকিক রহস্য’ নামে একটি মাসিকপত্রও প্রকাশ করেছেন।

ক্ষীরোদপ্রসাদের জীবনের এইসকল বিবরণ হতে তাঁর ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। তিনি একই সঙ্গে ছিলেন রসায়নশাস্ত্র ও রসশাস্ত্রবিদ। তাঁর ভিতর বিজ্ঞানের যুক্তি, বিশ্লেষণ প্রণালি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ পদ্ধতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সাহিত্যিক কল্পনা, সৌন্দর্য ও রসবোধ। ফলে ক্ষীরোদপ্রসাদের কল্পনা কক্ষচ্যুত হয়নি, তা ভৌম আকর্ষণকেও লঙ্ঘন করেনি। বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি ও সাহিত্যিক রুচি ও ধর্মের আবেগবিহ্বল ভক্তিবাদের কথা সংযমবোধের রেখা টেনে দিয়েছে। অলৌকিক রহস্যকে তিনি যথাসম্ভব গ্রহণ করেছেন যুক্তির মানদণ্ডে। নব্যযুগের মানবিকতাবোধ (Humanism) দ্বারা তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তাই বলে এ দেশীয় পৌরাণিক বিশ্বাসকেও তিনি অবজ্ঞা করেননি। সর্বোপরি ক্ষীরোদপ্রসাদ উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন বলিষ্ঠ জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে। সে জাতীয় চেতনার মূল ভিত্তি শক্তি, প্রেম ও ধর্ম। ক্ষীরোদপ্রসাদের সাহিত্য-কৃতি তাঁহার ব্যক্তি-মানসিকতার এই সকল চিহ্নে চিহ্নিত।

ক্ষীরোদপ্রসাদের সাহিত্যিক প্রতিভা বিশেষভাবে পরিস্ফুট হয়েছে তাঁর নাট্য নিবন্ধে। তিনি কিছু কাব্য-কবিতা ও উপন্যাসও রচনা করেছেন। কিন্তু নাট্যকার (Phaywrihte) রূপেই তাঁর খ্যাতি। তখন নাট্যজগতে অতুলকৃষ্ণ মিত্র ও রাজকৃষ্ণ রায়ের যুগ শেষ হয়ে এসেছে। নট-নাট্যকার রূপে গিরিশ-প্রতিভা তুঙ্গশীর্ষ স্পর্শ করেছে। নট-নাট্যকার নাট্যাচার্যরূপে রসরাজ অমৃতলাল বসুও তখন লব্ধপ্রতিষ্ঠ। হাসির গানের স্রষ্টা দ্বিজেন্দ্রলাল রায় মঞ্চনাট্য রচনার সবে হাত দিয়েছেন। সাধারণ রঙ্গালয়ের জন্য রচিত না হলেও রবীন্দ্রনাথের নাটকও তখন সাহিত্যক্ষেত্রে সকলে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ঠিক এই সময়েই অধ্যাপক ক্ষীরোদপ্রসাদ ‘ফুলশয্যা’ নাটক ঐতিহাসিক দৃশ্য কাব্যটি নিয়ে মঞ্চাভিনয়ের লক্ষ্যে অগ্রসর হয়েছেন। নাটকটি ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে ‘এমারেল্ড’ থিয়েটারে অভিনীত হন। তখন নট ও নাট্যচার্য ব্যতীত শুধু নাট্যকার রূপে সাধারণ রঙ্গালয়ে স্থান পাওয়া দুষ্কর ছিল। কারণ রঙ্গালয়ের সঙ্গে যোগহীন নাট্যকারের পক্ষে ‘রঙ্গালয়ের ব্যাকরণ’ জানা সম্ভব ছিল না, সে ব্যাকরণে অভিজ্ঞ ছিলেন রঙ্গালয়ের জন্য বাঁধাধরা নাট্যকার। কিন্তু ক্ষীরোদপ্রসাদ বাহিরে থেকে সেই দুর্লভ সুযোগ লাভ করেছিলেন। তাঁর বিশিষ্ট পৃষ্টপোষক ছিলেন তৎকালীন খ্যাতিনাম নট ও নাট্যাধ্যক্ষ অমরেন্দ্রনাথ দত্ত। ‘ক্লাসিক’ থিয়েটার তাঁরই সৃষ্টি। এই ক্লাসিক থিয়েটারেই ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে ক্ষীরোদপ্রসাদের ‘আলিবাবা’ অভিনীত হয় এবং নাট্যকার রূপে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। আলিবাবার মঞ্চসাফল্যে তখনকার মঞ্চাধ্যক্ষদের অনেকেই ক্ষীরোদপ্রসাদের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ক্ষীরোদপ্রসাদও উৎসাহিত হয়ে কয়েকখানি রঙ্গনাট্য গীতিনাট্য ও পূর্ণাঙ্গ নাটক রচনা করেন। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলেজের অধ্যাপনা ত্যাগ করে নাটক রচনাতেই আত্মনিয়োগ করেন। এই সময় তিনি স্টারের নট-নাট্যকার রসরাজ অমৃতলাল বসুর পোষকতা লাভ করেন এবং ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দেই ‘বঙ্গের প্রতাপাদিত্য’ ঐতিহাসিক নাটক রচনা করে বঙ্গ রঙ্গমঞ্চে দেশাত্মবোধের অগ্নিশিখা প্রজ্বলিত করে দেন। বঙ্গের ঐতিহাসিক পুরুষকে অবলম্বন করে দেশ প্রেমমূলক সার্থক নাটক রচনার কৃতিত্ব ক্ষীরোক্ষপ্রাসাদেরই। এর পূর্বে বাংলার ইতিহাস অবলম্বনে দুই একটি নাটক [ যেমন, হরলাল রায়ের ‘বঙ্গের সুখবাগান’ (১৮৭৪) এবং লক্ষ্মীনারায়ণ চক্রবর্তীর ‘নবাব সিরাজদ্দৌলা’ (১৮৭৬) ] রচিত হলেও, সেগুলি দেশাত্মবোধের সাড়া জাগাতে পারেনি। তাঁর ঐতিহাসিক নাটকগুলির ভিতর যুগধর্মে ও নাট্যধর্মে ‘আলমগীর’ উৎকৃষ্ট।

ক্ষীরোদপ্রসাদ নানা রসের নাটক রচনা করেছেন। গীতিরঙ্গ নাট্য নিয়ে তাঁর খ্যাতির সূচনা, প্রতিষ্ঠা বিশেষ করে ঐতিহাসিক নাটকে। ক্ষীরোদপ্রসাদের অন্তরঙ্গ ধর্মীয় চেতনার প্রকাশ ঘটেছে তাঁর পৌরাণিক নাটকগুলিতে। ক্ষীরোদপ্রসাদের ধর্ম অন্ধ আবেগ উচ্ছ্বাসের ধর্ম নয়। জ্ঞান-প্রহরায় সংযত বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে বিশ্লেষিত মানবধর্মজিজ্ঞাসাই তাঁর পৌরাণিক নাটকের বিশেষত্ব। যাত্রার অতি উচ্ছ্বসিত ভক্তির আবেগ, এমন কি নাট্যাচার্য্য গিরিশ ঘোষের আবেগোচ্ছল ভক্তির প্লাবন তাঁর নাটকে নেই। গ্রামীণ ভক্তিধর্মের স্রোেত হতেও পৌরাণিক নাটক মুক্ত। তবে প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসে তিনি আঘাত করেননি, যেমন করেছেন দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর ‘পাষাণী’ নাটকে। পৌরাণিক ধর্মকে তিনি উদ্ধার করেছেন মূল সংস্কৃত ধর্ম ও শাস্ত্রগ্রন্থ হতে এবং তাকে তিনি পরিবেশন করেছেন যুগধর্মের আলোকে। ফলে ক্ষীরোদপ্রসাদের পৌরাণিক নাটক তৎকালীন বিশিষ্ট সাহিত্যরথীদের ‘ঐতিহ্যঅবগাহন’ এর ধারা হতে বিচ্ছিন্ন হয়নি। বঙ্কিমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র যে পৌরাণিক বিশ্বাসকে নূতন মানবিকতার আলোকে ব্যাখ্যা করেছেন এবং রবীন্দ্রনাথ মহাভারতের চরিত্রগুলির যে তাৎপর্য অনুসন্ধান করেছেন, ক্ষীরোদপ্রসাদের পুরাণ-চিন্তা সেই ধারার সঙ্গে যোগসূত্র রক্ষা করেছে।

তাঁর পৌরাণিক নাটকের ভিতর ‘ভীষ্ম’ (১৯১৩) এবং ‘নরনারায়ণ’ (১৯২৬) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘নরনারায়ণ’ ক্ষীরোদপ্রসাদের শেষ রচনা এবং উহা তাঁহার প্রৌঢ় চিন্তার ফসল।