বাংলা ছােটোগল্পের জগতে নরেন্দ্রনাথ মিত্র প্রথম শ্রেণীর স্রষ্টা। তার লেখনীর জাদুতে সৃষ্টি হয়েছে এক একটি নক্ষত্রোপম ছছাটোগল্প। চলমান জীবনের বিচিত্র রূপ ও ছােটো ছােটো আনন্দ বেদনার আলােছায়া তার গল্পে উঠে এসেছে। তার কলমের পিছনে ছিল যুগপৎ সহৃদয় মন ও সতত সক্রিয় মস্তিষ্ক। ইচ্ছাপূরণের গল্প তিনি লেখন নি, হতাশার গল্পও নয়। নীতিবাক্য প্রচারের কোনাে উদ্দেশ্যও তার ছিল না। জীবনের নিত্যদিনের সুখ-দুঃখের নানা রূপ তার গল্পে মুক্তাবিন্দুর মতাে ঔজ্জ্বল্য নিয়ে উপস্থিত।

নরেন্দ্রনাথের জন্ম ১৯১৬তে। অর্থাৎ তার বাল্যাবস্থাতেই কল্লোল-কালিকলম-প্রগতি-যুগের সাহিত্য প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। সেই নতুন ভাবধারার কথাসাহিত্যিক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, শৈলজানন্দ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, জগদীশ প্রমুখেরা। বাস্তবের রূঢ়তা ও রুক্ষতা তাদের গল্পে-উপন্যাসে নির্মোহ ভঙ্গিতে উপস্থাপিত। তার কিছু পরবর্তীকালে আরাে কয়েকজন কথা-সাহিত্যিকের আবির্ভাব, যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আলােড়নে আলােড়িত, নাগরিক সভ্যতার কঠিন সত্যকে দেখে এবং চিনে তারা সভ্যতার স্বরূপ সম্বন্ধে আরাে বেশি নির্মোহ। কথাশিল্পী নরেন্দ্রনাথ মিত্র (১৯১৬-১৯৭৫) এই যুগের প্রতিনিধি।

ফরিদপুরের সদরদি গ্রামে তার জন্ম এবং সেখানেই তাঁর শৈশব অতিবাহিত। তাই গ্রামজীবন ও গ্রামের মানুষজন তার শৈশবাবধি পরিচিত। নরেন্দ্রনাথ লিখেছেন— ‘এই পটভূমি কখনাে জ্ঞাতসারে কি কখনাে অজ্ঞাতে আমার চিত্তভূমিকে এক বিশেষ ধরনের রূপবােধে উদ্বুদ্ধ করেছে।’ নরেন্দ্রনাথের পিতা মহেন্দ্রনাথের সাহিত্যানুরাগ শৈশব থেকেই তার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময়েই ‘আহ্বান’ ও ‘মুকুল’ নামে হাতে লেখা পত্রিকা প্রকাশ করেন তিনি। সাহিত্য রচনার শিক্ষানবিশী পর্বও এই সময়েই। ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে বন্ধু হিসাবে পান নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়কে। এই সময়েও ‘জয়যাত্রা’, ‘অভিসার’ প্রভৃতি হাতে লেখা মাসিক পত্রিকায় তার সাহিত্যচর্চা চলতে থাকে। ১৯৩৬-এ দেশ পত্রিকায় প্রথম ‘মুক’ নামে একটি কবিতা মুদ্রিত হয়। ঐ বছরেই দেশে প্রকাশিত হয় তার গল্প ‘মৃত্যু ও জীবন’।

গল্পকার হিসাবে নরেন্দ্রনাথ মিত্র ছিলেন স্বতন্ত্র। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের চলমান মিছিল যেন তার ছােটোগল্পগুলি। কিন্তু রুচিগত একটি রক্ষণশীলতা তার ছিল। তাই যৌনতা ও রাজনীতি তার গল্পে অপরিহার্য হয়ে ওঠেনি। রুচিশত এই স্বাতন্ত্র্য তিনি বরাবর রক্ষা করেছেন। সাহিত্যকে হুজুগের দাস করা তার স্বভাব ছিল না। মধ্যবিত্ত জীবন, ব্যক্তিগত জীবন ও পারিবারিক সম্পর্কের বাইরে গিয়ে তৎকালীন সাহিত্য প্রবাহের বশ্যতা করতে সৌখিন মজদুরী তিনি করেন নি। প্রখ্যাত সমালােচক সত্যেন্দ্রনাথ রায় নরেন্দ্রনাথ সম্পর্কে লিখেছেন— ‘একদিকে হৃদয়ের আর্দ্রতা, অন্যদিকে জীবনের রুক্ষতা, এই দুইয়ের টেনশনেই, এই দুইয়ের আর্তিতেই কঠিন আর কোমলের এই সংঘর্ষেই নরেন্দ্রনাথ।’

রবীন্দ্রোত্তর পর্বের বিশেষ মনােধর্ম অঙ্গীকার করে উনবিংশ শতকের ত্রিশ ও চল্লিশ দশকের বহু কথা-সাহিত্যিকের হাতে বাংলা ছােটগল্প সমৃদ্ধ হয়েছে। নরেন্দ্রনাথ সেই ধারারই অব্যবহিত পরে আবির্ভূত। চল্লিশ দশক থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত প্রায় চার দশক জুড়ে তার সাহিত্যের বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা।

নরেন্দ্রনাথ জীবনের অনেকটা পর্ব কাটিয়েছেন গ্রাম বাংলায়। তাই গ্রামবাংলা তার গল্পে ফিরে ফিরে এসেছে। ‘রস’, ‘বন্যা’, ‘ভুবন ডাক্তার’ প্রভৃতি গল্পে বাংলার সেই চিত্র চমৎকার ফুটেছে। নরেন্দ্রনাথের গল্পের গ্রাম-পরিবেশের বিশিষ্টতা এই যে, সময়ের সঙ্গে তা নিয়ত পরিবর্তনশীল। বিভূতিভূষণের গ্রাম-পরিবেশ যেমন নিশ্চিন্দিপুরকে বরাবর আঁকড়ে থাকে, বা তারাশংকর বীরভূমের মাটিকে ছাড়তে পারেন না, নরেন্দ্রনাথের গ্রাম পরিবেশ তেমন নয় ‘পুনশ্চ’ গল্পে দেখি যুদ্ধের সময় খাদ্যসংকটে জৈনুদ্দিনের ভালােবাসায় ঘাটতি পড়ে। যুদ্ধকালীন গ্রামের দৃশ্য নরেন্দ্রনাথের অনেকগুলি গল্পে এসেছে, যেমন দেখেছি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পে। ‘রসাভাস’ গল্পে যে নারী সন্তানকে বাঁচাবার জন্যে ভিক্ষে চাইতে পারে নি, সে নিজের বাঁচার জন্য চাল-চালানের ব্যবসা করে। মূল্যবোধের অপচয় কেমন করে ঘটে তা পদ্মমণির সংলাপে বােঝা যায়- ‘কোনাে লজ্জা করবেন না বাবু। মেয়ে কি ওতে মরবে না পচে যাবে?’ যুদ্ধ গােটা জীবনধারা ও মূল্যবােধকে কেমন করে বদলে দেয়, নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে নরেন্দ্রনাথ তা প্রকাশ করেছেন।

সমাজ-সচেতনতা আধুনিক ছােটগল্পকারের একটি প্রাথমিক লক্ষণ। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্পে এই সামাজিক বােধ অবশ্যই উপস্থিত, কিন্তু সুবােধ ঘােষের ‘সুন্দরম’ বা ‘ফসিল’ কিংবা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘হাড়’ বা ‘টোপে’র মতাে তা প্রখরভাবে আঘাত করে না। জগদীশ গুপ্তের মতাে প্রচলিত সংস্কারকে ও রুচিকে বিদীর্ণ করার ঝোক তাে নরেন্দ্রনাথে সম্পূর্ণই অনুপস্থিত। ১৩৫২তে প্রকাশিত ‘অসমতল’ গল্পগ্রন্থ থেকেই নরেন্দ্রনাথের সমাজ সচেতনতা লক্ষ্য করা যায়। যদিও তিনি কখনােই সমাজ-সংস্কারকের ভূমিকা নেন নি। ‘ছদ্মনাম’ গল্পে নমিতার বিবাহ হয় না, কারণ সে ব্রাহ্মণ ও তার ভালােবাসার পাত্র কায়স্থ। বিপরীত বিষয় ঘটে ‘অনন্যা’-তে। সেখানে সুমিতা যার সঙ্গে ঘর ছাড়ে, তার সঙ্গে জাতি ও সামাজিক অবস্থার কোনাে মিল নেই। ‘হেডমিস্ট্রেস’ গল্পে সুপ্রীতিকে শৈলেন ভালােবাসলেও সংসারের চেয়েও স্কুলকে হেডমিস্ট্রেস সুপ্রীতির মনােযােগর বিষয় বলে শৈলেন মানতে পারে না। উপার্জনশীলা নারীর আত্মচেতনতার প্রতি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরূপতা প্রকাশিত হয়েছে ‘অবতরণিকা’, ‘সেতার’ প্রভৃতি গল্পেও।

নরেন্দ্রনাথ ন্যাচারালিস্ট, বা বাস্তব, তাকে রঙিন করে বা গাঢ়তর রঙে আঁকার কোনাে বাসনা তার নেই। আশা বা নৈরাশ্য কোনাে দিকেই তার ঝোক পড়ে না। বরং নিয়ত পরিবর্তনশীল সমাজকে আঁকতে থাকেন নরেন্দ্রনাথ। ‘স্মারক’ গল্পে পুত্র বিদেশিনীকে বিবাহ করতে চাইলে অভিভাবকরা আপত্তি করেও পরে স্বীকার করে নেন। বিধবা রমণী একান্নবর্তী পরিবারে নিরাপদ হলেও ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের যুগে সে হয়ে ওঠে সংসারের বােঝা। এই ছবি দেখি সুদ গল্পে, যেখানে একটি চরিত্র বলে ‘সেদিন আর নেই মশাই। দেওর ভাসুর বিধবা ভাই-বউকে পুষবে, সেদিন আর নেই। এখন যার যার তার তার।’ সমাজ-মানসের এই পরিবর্তন আরাে ধরা পড়ে ‘মলাটের রং’ গল্পে, যেখানে বিধবা অঞ্জলিকে অবিবাহিত সহকর্মী বিবাহ করুক এই প্রত্যাশা দেখা গেছে অন্য সহকর্মীদের মধ্যে।

সামাজিক রাজনৈতিক কোনাে অবস্থা ও ব্যবস্থার প্রতি ক্রোধ বা ক্ষোভ স্পষ্টভাবে কখনাে প্রকাশ করেন নি নরেন্দ্রনাথ। তবে সমাজ-এ যে এখন অন্যায়ের সঙ্গে প্রায় সর্বদা আপােষকামী সে সত্য তার কাছে গোপন থাকে নি ‘চোরাবালি’ গল্পে পিতা অনাদি কন্যা রাণুর প্রতি গৌরাঙ্গের অশ্লীল ব্যবহার দেখে রাণুকে আড়াল করতে চাইতেন। কিন্তু গৌরাঙ্গের আর্থিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সেই বিরূপতা সহজেই কেটে গিয়ে অনাদিবাবু কন্যাকে তার হাতেই সমর্পণ করেন।

কথা সাহিত্য মানুষের জীবন কাহিনী। মানুষের জীবনের একটি অন্যতম দিক তার প্রেম। তাই ছােটোগল্পকার প্রেমের গল্পকে অস্বীকার করতে পারেন না। তাঁর গল্পে প্রেম কোনাে কোমলতার আবরণে আবৃত হয় নি। নিষ্ঠুরতাকে মধুরতর আবেগের প্রলেপ দেন নি। জাতিভেদ প্রথা ও বর্ণভিত্তিক সমাজে প্রেমের ব্যর্থতার রূপ প্রকাশিত হয়েছে ‘অনাগত’, ‘দ্বিতীয় অধ্যায়’, ‘স্বপ্নকমল’ ইত্যাদি গল্পে। বিধবা নারীর, ভালােবাসার ছবি আছে ‘যবনিকা’, ‘শাল’, ‘মহাশ্বেতা’, ‘মলাটের রং’ ইত্যাদি গল্পগুলিতে। তারাশংকরের ‘বেদেনী’ বা মানিকের ‘প্রাগৈতিহাসিক’ এর মত গল্প লেখা নরেন্দ্রনাথের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবু প্রেমের গল্প নরেন্দ্রনাথের প্রিয় বিষয়। তিনি স্বয়ং লিখেছেন— ‘নিজের স্বভাবকে দেখে নিয়ে, নিজের প্রবৃত্তি আর প্রবণতাকে স্বীকার করে আমি সারাজীবন শুধু ভালােবাসার গল্পই লিখেছি। সে ভালােবাসা হয়তো সংকীর্ণ অর্থে ভালােবাসা, সীমিত অর্থে ভালােবাসা। তবু তাে ভালােবাসা ছাড়া আর কিছু নয়।’

মনস্তাত্ত্বিক গল্পরচনার ক্ষেত্রেও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন গভীর জটিলতার সন্ধানী, নরেন্দ্রনাথ হয়তাে সেভাবে মনের তলদেশ পর্যন্ত মন্থন করতে পারেন। তবু আধুনিক মানুষের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা তাঁর গল্পেও আছে। ‘পরম্পরা’ গল্পে শিপ্রা পরিণত বয়স্ক প্রফুল্লবাবুকে নিজের অজান্তেই ভালােবেসেছিল। ঘটনা জটিলতর হয়, যখন প্রফুল্লবাবুর পুত্র এজন্য শিপ্রাকে তিরস্কার করতে এসে পিতার মতই শিপ্রার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে। প্রফুল্লবাবুর মৃত্যুর পর শিপ্রাও যেন সেই পুত্রটির পাশে তার পিতার ছায়া দেখে, ও সেই মনস্তাত্ত্বিক সর্পিলতাতেই সে তার কাছে আত্মসমর্পণ করে। ‘অপঘাত’ গল্পের নায়ক পুষ্পেন্দুর যৌনবিকার নরেন্দ্রনাথের মনস্তাত্ত্বিক গল্পের মধ্যে একটি সাহসী দৃষ্টান্ত। পুষ্পেন্দু একযােগে সাঁওতাল মেয়েদের প্রতি এবং সহপাঠী বন্ধু সুদর্শনের প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করে। ‘ঘাম’, ‘সংক্রামক’, ‘পার্শ্বচর’ প্রভৃতি গল্পেও মনােবিকারের বিচিত্র ছবি আমরা পাই।

১৩৫২ বঙ্গাব্দে তার দুটি গল্পসংকলন প্রকাশিত হয়— ‘অসমতল’ এবং ‘হলদে বাড়ি’। তাঁর অন্যান্য গল্প-গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে ‘উদ্যোগপর্ব’, ‘কাঠগােলাপ’, ‘অনাগত’, ‘পালঙ্ক’, ‘চড়াই- উৎরাই’ ইত্যাদি।

নরেন্দ্রনাথ মিত্রের উপন্যাসের সংখ্যা আটত্রিশ। এ থেকেই বােঝা যায় ছােটোগল্পের মতাে উপন্যাসের ক্ষেত্রেও তার কলম ছিল গতিশীল। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দ্বীপপুঞ্জ’ প্রকাশিত হয় ১৩৪৯ বঙ্গাব্দে ‘দেশ’ পত্রিকায়। যদিও নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ছােটগল্প ও উপন্যাসের পারিপার্শ্বিক প্রায় এক, তবু তার উপন্যাসের প্রেক্ষাপট বহু বিস্তৃত। ‘দ্বীপপুঞ্জ’ উপন্যাসের মূল চরিত্র মঙ্গলা হলেও বহুমানুষের চালচিত্রে সেখানে মূর্ত হয় বাংলার গ্রাম। ‘রূপমঞ্জরী’ (১৩৫৩-৫৪) উপন্যাসে ঢুলি সম্প্রদায়ের জীবনচিত্র বিস্তৃতভাবে বর্ণিত। ‘রূপমঞ্জরী’-র কেন্দ্রীয় চরিত্র গগন ঢুলি। ঢুলি সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের সংকটটিই উপন্যাসের প্রতিপাদ্য। পাশাপাশি ভুইমালী সম্প্রদায়ের কথাও উপন্যাসে এসেছে। তাদের কাজ মাটির ভিত গাঁথা, বাঁশ-বেত-শােলার কাজ করা। কিন্তু দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে এদের জাতি-ব্যবসা সংকটের সম্মুখীন। তাই জাত-ব্যবসা ছেড়ে তাদের কেউ কেউ চলে যায় অন্য বৃত্তিতে।

‘অক্ষরে অক্ষরে’, ‘দূরভাষিণী’, ‘চেনামহল’ ইত্যাদি উপন্যাসগুলি নারীব্যক্তিত্ব ও সংকটকে রূপায়িত করেছে। ধনীপুত্র সরিতের কাছে উমিলা প্রত্যাখ্যাত হয়ে মুদ্রণকর্মী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। আর্থিক স্বনির্ভরতাকে সুন্দর করে। তখন সরিৎ ধরা দেয়। কিন্তু উর্মিলা বােঝে সরিতের কাছে নারীর কর্মীরূপ মূল্যহীন। দেহের রূপই তার কাম্য। দ্বিতীয়বার প্রত্যাখ্যাত হয়ে উর্মিলা তার কর্মজীবনে একনিষ্ঠ হয় ও নারীর এই আত্ম-প্রতিষ্ঠা মূল্য পায় অন্য এক পুরুষ হেমস্তর কাছে। ‘দূরভাষিণী’ গল্পের নায়িকা বীণা টেলিফোন অপারেটর। চাকুরীজীবী রমণীর ব্যক্তিত্ব ও অভিভাবকের সঙ্গে তার দ্বন্দ্বময় সম্পর্ক এই উপন্যাসটিরও বিষয়।

‘সূর্যসাক্ষী’ উপন্যাসে ছাপাখানা, টেলিফোন অফিস, শ্রমিক ইউনিয়ন প্রভৃতি বহির্বিষয়ক উপকরণের বদলে নরেন্দ্রনাথ নর-নারীর সম্পর্ক ও মানব মনের জটিল রহস্য বা অন্তর্লোককেই বিষয় হিসাবে গ্রহণ করেছেন। এই উপন্যাসের মূল চরিত্র অধ্যাপক শশাঙ্ক পাণ্ডিত্যে ও ব্যক্তিত্বে আকর্ষণীয়। কিন্তু নারী সঙ্গের মােহ থাকলেও কোনাে বিশেষ নারীর প্রতি প্রগাঢ় আকর্ষণ তার হৃদয়ে লক্ষ্য-গােচর হয় না। শশাঙ্কর প্রতি অনুরক্ত মন্দিরার প্রতিও শশাঙ্ক কেবল নারীসঙ্গ সুখ ছাড়া অন্যতর কোনাে আকর্ষণ বা প্রেম অনুভব করে না। মন্দিরার বিবাহ হয় মিহিরের সঙ্গে। কিন্তু মন্দিরা স্বামীর প্রতি বিতৃষ্ণই থেকে যায়। তাকে সে শশাঙ্কের প্রতি আকর্ষণের কথা জানায় এবং শেষ পর্যন্ত গৃহত্যাগ করে শশাঙ্কর কাছে চলে আসে। শশাঙ্ক মন্দিরাকে গ্রহণ করে না। মিহির বিবাহ-বিচ্ছেদের মামলা আনলে আদালতে শশাঙ্কর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ শারীরিক সম্পর্কের অসত্য ভাষণের মধ্য দিয়ে মন্দিরা তার উদগ্র কামনাকে সত্য প্রতিপন্ন করতে চায়। ‘সূর্যসাক্ষী’ উপন্যাসে তীব্র প্যাশনের উদগ্র মুর্তি মন্দিরা চরিত্রের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত।

নরেন্দ্রনাথের অন্যান্য উল্লেখযােগ্য উপন্যাসগুলি হল ‘সঙ্গিনী’, ‘সুখ-দুঃখের ঢেউ’, ‘সহৃদয়া’ ইত্যাদি। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের কথা-সাহিত্যের উপকরণ সামান্য, তবু সহজ জীবনদৃষ্টি ও সহৃদয়তায় তিনি সেই সামান্যকেই অসামান্য শিল্পরূপ দান করতে পেরেছেন। সমকালীন সাহিত্যিক সন্তোষকুমার ঘােষ নরেন্দ্রনাথ সম্পর্কে লিখেছেন- ‘এত মাপা এলাকায় চলাফেরা, এত অল্পস্বল্প উপকরণ, তবু তাই দিয়েই বাংলার গল্প সাহিত্যে তিনি ঘটিয়েছেন অসাধ্যসাধন।…বিস্তারের ঘাটতি পুষিয়ে গেছে নিতল গভীরতায়।’