ভূমিকা: তিরিশের দশক আধুনিক বাংলা কবিতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। তিরিশের দশকের কবিরাই প্রথম রবীন্দ্র বিরোধী চেতনায় ঋদ্ধ হলেন। তারাই রবীন্দ্রবলয় থেকে বেরিয়ে এসে এক নতুন কাব্য ধারার সন্ধান দেন আধুনিক বাংলা কবিতায়। তাঁদের কাব্যে ব্যক্তির মনোজগত থেকে শুরু করে তাদের পারিবারিক সামাজিক জীবন চিহ্নিত করেন। এসময় পাঁচজন প্রতিভাধর কবি জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে- বাংলা কবিতায় বিশেষ অবদান রাখেন; এঁরা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘পঞ্চপাণ্ডব’ নামে পরিচিত। তাই আধুনিক বাংলা কবিতায় তিরিশের দশক এক স্বতন্ত্র ও অনন্য সময় হিসেবে বিবেচিত।

তিরিশের দশকে অসংখ্য কবির আবির্ভাব ঘটে। এদের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ। তিনি ছিলেন পঞ্চপাণ্ডবদের একজন। কবি জীবনানন্দ দাশ কবিতায় সূক্ষ্ম ও গভীর অনুভবের এক জগৎ তৈরি করেন। বিশেষকরে গ্রামবাংলার নিসর্গের যে ছবি তিনি এঁকেছেন, বাংলা সাহিত্যে তার তুলনা চলে না। সেই নিসর্গের সঙ্গে অনুভব ও বোধের বহুতর মাত্রা যুক্ত হয়ে তাঁর হাতে অনন্যসাধারণ কবিতাশিল্প রচিত হয়েছে। এই অসাধারণ কাব্যবৈশিষ্ট্যকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘চিত্ররূপময়’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। জীবনানন্দের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ: ‘ঝরাপালক’ (১৯২৮), ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ [১৯৩৬], ‘বনলতাসেন’ [১৯৪২], ‘মহাপৃথিবী’ (১৯৪৪), ‘সাতটি তারার তিমির’ [১৯৪৮), ‘রূপসী বাংলা’ (১৯৫৭), ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ [১৯৬১] প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তার কবিতার একটি বিশেষ দিক হলো প্রকৃতির ব্যবহার। উপমা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তিনি সর্বাশ্রেষ্ঠ। তাছাড়া ‘রূপসী বাংলার কবি’ জীবনানন্দ দাশের কবিতায় আর যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা হলো পুরাণের ব্যবহার, প্রেম চেতনা, ইতিহাস চেতনা, সৌন্দর্য চেতনা প্রভৃতি।

আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের [১৯০১-১৯৬০] একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। ত্রিশের দশকে যে পাঁচজন কবি বাংলা কবিতা রচনায় বিশেষ অবদান রেখেছিলেন তাঁদের মধ্যে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত অন্যতম। সুধীন্দ্রনাথের কবি মানস তাঁর ব্যক্তিমানসের নির্মাণ, তাঁর অধীত বিদ্যা, অর্জিত অভিজ্ঞতা ও অভীষ্ট সংকল্পের সংমিশ্রণ। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ ‘তন্বী’ [১৯৩০], ‘অর্কেস্ট্রা’ [১৯৩৫], ‘ক্রন্দসী’ [১৯৩৫), ‘উত্তর ফাল্গুনী’ [১৯৩৭], ‘সংবর্ত’ [১৯৫৬), ‘প্রতিধ্বনি’ এবং ‘দশমী’ [১৯৫৬]। ‘অর্কেস্ট্রা’ (১৯৩৫) সুধীন্দ্রনাথ দত্তের দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে বেশি সংস্কারকৃত কাব্যগ্রন্থ।

আধুনিক কবিদের মধ্যে সর্বাপ্রেক্ষা জটিল ও দ্বিধাবিভক্ত মনের অধিকারী কবি অমিয় চক্রবর্তী। দৃষ্টির জগৎ ও ধ্যানের জগৎ এদুটি বিষয় নিয়ে তার মধ্যে অন্তর্দৃষ্টি সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৩০ সাল পর্যন্ত তাঁর কবিতা প্রধানত রবীন্দ্রানুসরণ। উত্তর- তিরিশে তাঁর কবিতায় পালাবদল ঘটে। ১৯৩৫ সালে ‘খসড়া’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পরে তিনি অবিসংবাদিতভাবে আধুনিক কবিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হলেন। তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ ‘একমুঠো’ (১৯৩৯], ‘মাটির দেয়াল’ [১৯৪২), ‘অভিজ্ঞান বসন্ত’ [১৩৫০], পারাপার, পালা বদল, ঘরে ফেরার দিন ইত্যাদি অমিয় চক্রবর্তীর কাব্য।

আধুনিক বাংলা কাব্য আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচিত বুদ্ধদেব বসু [১৯০৮-১৯৭৪]। তিরিশের কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনি অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিলেন। তিনি শুধু কবি-নন- সাহিত্যসমালোচক এবং কবিদের স্রষ্টাও বটে। তিনি ‘কবিতা’ নামে সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদনা করতেন। তাঁর অন্যতম কাব্যগ্রন্থ’বন্দীর বন্দনা’ (১৯৩০), ‘পৃথিবীর প্রতি’ [১৯৩৩], ‘কঙ্কাবতী’ (১৯৪৩), ‘শীতের প্রার্থনা’, ‘বসন্তের উত্তর’, ‘নতুন পাতা’, ‘দময়ন্তী’, ‘দ্রৌপদীর শাড়ী’ ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য কাব্য।

তিরিশের যুগে বাংলা কবিতায় মৌলিক রচনা গুণে যারা খ্যাতি অর্জন করেন বিষ্ণু দে [১৯০৯-১৯৮২] তাঁদের মধ্যে অন্যতম। রবীন্দ্রনাথ থেকে বিষ্ণু দের কবিতার পার্থক্য সহজেই অনুভব করা যায় আর এটাই তার মৌলিকতা। বিষ্ণু দে এমন একজন কবি যিনি এলিয়টের কাছে ঋণী হয়েও মৌলিক প্রতিভা হিসেবে স্বীকৃত। তার কাব্যে মৌলিক প্রতিভার স্বাক্ষর রয়েছে। বিষ্ণু দে ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’ [১৯৩২], ‘চোরাবালি’ [১৯৩৮], ‘পূর্বলেখ’ (১৯৪০), ‘সন্দ্বীপের চর’ (১৯৪৭), ‘নাম রেখেছি কোমল গান্ধার’ [১৯৫০) ‘অন্বিষ্ট’ প্রভৃতি কাব্য গ্রন্থের রচয়িতা। তিনি মার্কস ধারার কবি। তাঁর অনেক কবিতায় রাজনৈতিক মতের এবং তির্যক ব্যঙ্গ দৃষ্টির প্রকাশ ঘটে।

আধুনিক বাংলা কাব্য সমৃদ্ধকরণে তিরিশের দশক একবিশেষ জায়গা দখল করে আছে। এ সময়ের কবিদের কবিতায় ব্যক্তির মনোবেদনার চিত্র সুন্দরভাবে অঙ্কিত হয়েছে। কোনো কোনো কবি মার্কসবাদের দিকে নজর দিয়েছেন। রবীন্দ্র-ঘরানা অতিক্রম করে নতুন কাব্যক্ষেত্রের সৃষ্টি হয়েছে তিরিশের দশকের কবিদের হাতেই। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে রবীন্দ্রোত্তর যুগে কবিতার এই বিপ্লব একদিকে যেমন অপরিহাযা ছিল- তেমনি তা আধুনিক নাগরিক জীবনের প্রয়োজনের সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। তাই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আধুনিক কবিতা-সৃষ্টিতে তিরিশের দশক বিশেষভাবে চিহ্নিত।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।