প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর ইংল্যান্ডের রাক্ষসীবেলায় ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে একটি ছোটো কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হল, নাম ‘ওয়েস্ট ল্যাণ্ড’ (The Waste Land)। মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত মানুষের আশা ভরসাহীন মানসিকতার এক অপূর্ব কাব্যরূপ। তারপর থেকেই ওয়েস্ট ল্যান্ড’ ও এলিয়ট প্রায় সমোচ্চারিত নাম। এই কাব্যটিই এলিয়টের প্রথম কাব্য নয়। তাঁর কাব্যজীবনের হাতেখড়ি ছোটোকাল থেকেই ১৯১৯ সালে ‘প্রুফ্রক এন্ড আদার অবজারভেশন’ এবং পরবর্তী ১৯১৯ ও ১৯২০ সালে ‘পোয়েমস’ নাম দিয়ে দুখানি কবিতাগ্রন্থ বেরিয়ে গেছে। কবি হিসেবে এলিয়ট প্রতিষ্ঠিতও হয়েছেন। সেই প্রতিষ্ঠার সঙ্গে দিগ্বিজয়ী খ্যাতি যুক্ত হল তাঁর ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’ কাব্য প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই।

শুধু কি ইংলণ্ড! বাংলার বুকেও এলিয়টের পরিচয় ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’ এবং সে পরিচয় আকস্মিকতার মধ্য দিয়ে। কলেজস্ট্রীটের ফুটপাতে বিষ্ণু দে ও সুধীন্দ্রনাথ একদা পথ চলতি আবিষ্কার করলেন একখণ্ড পোড়ো জমি—এলিয়টের ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’। তারপর তাঁদের বিস্মিত বিমুগ্ধতার মধ্য দিয়েই এই বামনাকার কাব্যটি বাংলার জল, স্থল, আকাশে তার অধিকার বিস্তৃত করল। বাংলার বুকে ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’ তথা এলিয়টের বিজয় অভিযান শুরু হল। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ওপর এলিয়টের এই প্রভাব দুরন্ত প্রভাব।

এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘তীর্থযাত্রী’ কবিতাটির কথা মনে পড়বে। এলিয়টের ‘জার্নি অব দ্য মেজাই’ ( Journey of the Magi) কবিতাটির রবীন্দ্রনাথ কৃত অনুবাদ ‘তীর্থযাত্রী’। বাংলায় পরবর্তী কবিদের ওপর এলিয়টের প্রভাব বহু বিস্তৃত। কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সমর সেন প্রমুখ কবিদের লেখায় এলিয়টের রচনার ছায়া পড়েছে। কল্লোলিত কবিকুলের মধ্যে কবি বিষ্ণু দে-র ওপর প্রভাবই সমধিক।

‘রূপদক্ষ সুশোভন’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর ভাবমণ্ডল থেকে বেরিয়ে আসার যে সজ্ঞান প্রচেষ্টা আমরা কল্লোলীয় কবিগোষ্ঠীর যাত্রা শুরুর আগে থেকেই পাই, এলিয়ট কাব্য ও কাব্য-ভাবনা সেখানে অনেকটা সহায়ক হয়ে উঠেছিল।

এলিয়ট দেখেছিলেন এ জগতে প্রেম অভিশপ্ত, তাঁর প্রুফ্রক (Prufrock) জীবনকে কফির চামচের সঙ্গে তুলনা করেছে। সে কেবলই বৃদ্ধ হয় নিজেকে সাজায়, কিন্তু প্রেম মেলে না।

অমিয় চক্রবর্তী যখন ‘চেতন স্যাকরার’ সন্ধ্যায় নাগরিক ধূসরিমার ছবি আঁকেন, তখন মনে পড়ে এলিয়টের প্রথমদিকের কবিতা ‘দ্য প্রেলুড’-এর সূচনায় অদ্ভুত বা অসম্ভব মূর্তি (grotesque) কল্পনা। অবশ্য এ আঁধার বাহা নয়, মানসিক। তাই বিষ্ণু দে’র মতে সন্ধ্যার বাষ্পগন্ধ যেন সুচতুর এক স্পঞ্জ যা শুষে নেয় মানসিক সুচেতনা। জীবনানন্দ, সমর সেনের কবিতায় পাই ভীড়, ব্রীজ, সন্ধ্যা, মৃত্যুর নতুন মাত্রা।

জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে-র কাব্যে রয়েছে এক খোঁজার চেষ্টা, রয়েছে ক্লান্তির সুর। এ রীতি এলিয়ট পাঠেরই ফলশ্রুতি। এলিয়ট দেখেছিলেন, সমস্ত পৃথিবীটাই হাসপাতাল (the whole earth is our hospital)। জীবনানন্দও দেখেছিলেন পৃথিবীর গভীরে গভীরতম অসুখ। এলিয়টের কাঁটাঝোপের উপমা আধুনিক কবিদের কাছে এক বহুল ব্যবহৃত উপমা।

এলিয়টের মীথপ্রিয়তা সর্বজনবিদিত। মীথের অজস্র ব্যবহার দেখা যায় সুধীন্দ্রনাথ বা বিষ্ণু দে-র কবিতায়। এলিয়টের কাব্যে ঘুরে ফিরে আসে ভাঙাচোরা থামের চিত্রকল্প। “Sunlight on a broken column জীবনানন্দের নিগ্ন নির্জন হাত’ কবিতায় অপরূপ খিলান ও গম্বুজের বেদনাময় রেখা স্মরণীয়।

এলিয়ট প্রচুর অর্থহীন শব্দ দ্বারা ভাব-ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছেন। তাঁর ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’ কাব্যে আমরা এরকম ব্যবহার দেখতে পাব। ‘কল্লোল’ যুগের কবিদের মধ্যে এই প্রবণতা বিশেষ না থাকলেও বর্তমান কবিদের এরকম শব্দ ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। এর দ্বারা এই কথাই বলা যায় যে আজও বাংলা সাহিত্যে আধুনিক কবিদের ওপর এলিয়টের প্রভাব রয়েছে।

অবশ্য একটা কথা বলা দরকার। এলিয়ট তাঁর কাব্যে ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এর হতাশার মধ্যেও যে ইতিবাচক দিক খুঁজে পেয়েছিলেন তাই তাঁকে আধ্যাত্মিক আলোকের দিকে নিয়ে গেছে। কিন্তু এলিয়েট-এর এই উত্তরণ বা পরিবর্তন তাঁর ভাবনায় আলোকিত কবিরা কেউই মেনে নিতে পারেন নি। জীবনানন্দের উত্তরণ মানবিক প্রেম ও প্রজ্ঞায়, সমর সেন ও বিষ্ণু দে সাম্যবাদে। সুধীন্দ্রনাথ মালার্মেকে। গান্ধীর মৃত্যু, দেশবিভাগ, উদ্বাস্তুপ্রবাহের মধ্যে আধুনিকতা পেয়েছিল নতুন মাত্রা।

বিষ্ণু দে তাঁর এলিয়টের কবিতা অনুবাদের ভূমিকায় বলেছিলেন, তাঁরা এলিয়টের কাছে ত্রিবিধ ঋণে বন্ধ। এক : আত্মসচেতনতা, দুইঃ নেতির সংযম এবং তিন : নৈর্ব্যক্তিকতা। বিষ্ণু দে-র মতে এলিয়টের dissociation এবং unified sensibility, objective correlative, tradition প্রভৃতি তত্ত্ব বঙ্গীয় সাহিত্যিকদের ধ্রুব প্রেরণা হতে পারে।

জীবনানন্দের ‘কবিতার কথা’য় বারবার শোনা গেল এলিয়টের কণ্ঠ। জীবনানন্দ বলছেন, “কাব্যের অস্থিতে থাকবে ইতিহাস চেতনা, মর্মে প্রচ্ছন্ন থাকবে কালজ্ঞান…….. ইতিহাস চেতনা আমার কাব্যে এক নবসঙ্গতিসাধক অপরিহার্য সত্যের মত।”

বিষ্ণু দে-র ‘সাহিত্যের দেশ বিদেশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘উত্তর রৈবিক বাংলা কাব্য, বুদ্ধদেব বসুর ‘প্রবন্ধ সংগ্রহে আলোচিত হলেন এলিয়ট। এদের কাব্য বিশ্লেষণ পদ্ধতিতেও এলিয়ট উপস্থিত।

বাংলা কাব্যনাট্য চর্চার ক্ষেত্রে এলিয়টের প্রভাব খুব বেশি নয়। এলিয়টের আগেই রবীন্দ্রনাথের কাব্যনাট্য ও নাট্যকাব্য চর্চা আরম্ভ হয়। তবু এক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসুর ‘তপস্বী ও তরঙ্গিনী’, ‘কালসন্ধ্যা’ প্রভৃতি নাটকে এলিয়টের ‘মার্ডার ইন দ্য ক্যাথিড্রাল’ নাটকের প্রভাব দেখা যায়।

বাংলা সাহিত্যে এলিয়ট ভাবনার জোয়ার আজ স্তিমিত হলেও এখনও একেবারে বন্ধ হয় নি। এলিয়টের প্রবন্ধাবলী ও এলিয়ট সম্পর্কিত আলোচনার ধারা আজও চলিষ্ণু। এলিয়টের ‘ক্রাইটেরিয়ান’ পত্রিকা এককালে ‘পরিচয়’ ও ‘কবিতা’ পত্রিকার দিশারী হয়েছিল। আজও ‘সাহিত্যপত্র’, ‘কবি ও কবিতা’, ‘কবিতাযু’ প্রভৃতি পত্রিকায় এলিয়ট সংখ্যা প্রকাশিত হচ্ছে। বাংলা এলিয়টের কাব্যানুবাদ সুপ্রচুর হয়েছে। ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’ কাব্যেরই অনুবাদ হয়েছে একাধিক।

এককালে এলিয়ট-চর্চা বাংলা সাহিত্যে ঐতিহাসিক প্রয়োজন মিটিয়েছে। আজকের সামাজিক বাস্তবতা অনেকটা বদলে গেছে। আজ কিন্তু মানুষ আরও রূঢ় ও অনিকেত। আর সেইজন্যই আজও এলিয়ট ফুরিয়ে যায় নি।