অথবা, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের বৈশিষ্ট্য সংক্ষেপে আলোচনা কর।

উত্তর: মুহম্মদ আব্দুল হাই ও আনোয়ার পাশা সম্পাদিত বড়ু চণ্ডীদাসের “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন” কাব্য মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বহন করে। ১৯০৯ সালে আবিষ্কৃত এবং ১৯১৬ সালে সম্পাদিত গ্রন্থটির রস আস্বাদন পাঠক নন্দিত। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল ধর্মই মুখ্য এবং মানুষ গৌণ। গ্রন্থটি বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যে তাৎপর্যময়।

১. এটি মধ্যযুগীয় ধর্মীয় আখ্যানভাগের মোড়কে একটি মানবীয় কাব্য।

২. “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন” কাব্যের ভাষা একেবারেই কবির নিজস্ব সৃষ্টি, যা কাব্যটিকে বিশিষ্ট তাৎপর্যমণ্ডিত করে তুলেছে।

৩. এ কাব্যে পৌরাণিক কৃষ্ণের আদলে গ্রাম্য বালক- বালিকার প্রেম কাহিনি শৃঙ্গার রসে বর্ণিত হয়েছে।

৪. কাব্যটিতে সহজসরল মর্মস্পর্শী ভাবঘন বিষয়াবলম্বনে রচিত হলেও পয়ার ছন্দের কোন নতুনত্ব সৃষ্টি হয়নি।

৫. কাব্যটির চরিত্র চিত্রায়ন এবং কাহিনি বিন্যাসে নাটকীয় গুণে সমৃদ্ধ।

সুতরাং “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন” কাব্য প্রাচীন যুগের চর্যাপদের ন্যায় মধ্যযুগের পাঠক রসের যে পারঙ্গমতার পরিচয় বহন করে তাই বাংলা সাহিত্যে বিরল মর্যাদার দাবিদার। এতেই পাঠক সমাজ নতুনত্বের স্বাদ আস্বাদন করে চলেছে।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের রচনাকাল: উত্তর: বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন” কাব্য একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। এটি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন। রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলাকে অবলম্বন করে এর কাহিনি আবর্তিত হয়েছে। কিন্তু রচনাকাল নিয়ে পণ্ডিতমহলে বেশ মতবিরোধের সৃষ্টি হয়েছে। পুঁথিতে প্রাপ্ত একটি চিরকুটের হিসাব অনুযায়ী পুঁথিখানি ১৬৮২ খ্রিষ্টাব্দে বনবিষ্ণুপুরের রাজগ্রন্থাগারে সংরক্ষিত ছিল। কিন্তু পুঁথিটি চিরকুট অপেক্ষা প্রাচীনতর। পুঁথিটির রচনাকালের সাথে লিপিকালের একটি সাযুজ্য রয়েছে। এ প্রসঙ্গে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন-“নানা প্রত্নলিপির সঙ্গে পুঁথির লিপির মিল দেখে মনে হয় এ পুঁথিটি চতুর্দশ শতাব্দীর লেখা।” “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন” কাব্যের পুঁথিতে তিনটি হাতের লেখা রয়েছে-

একটি প্রাচীন, একটি প্রাচীন লিপির অনুকরণ, তৃতীয়টি অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালের। এ প্রসঙ্গে সুকুমার সেন লিখেছেন-“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন (প্রাপ্ত) পুঁথি প্রাচীন নয় তবে ভাষায় প্রাচীনত্বের ছাপ আছে এবং কাব্যটির শিল্প অবশ্যই প্রাচীন।” ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লিখেছেন- “গ্রন্থটির লিপিকাল আনুমানিক ১৪০০ খ্রিষ্টাব্দে বড়ু চণ্ডীদাস ইহার পূর্বে বিদ্যমান ছিলেন।” ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন-“বইখানির ভাষা খুঁটিয়ে আলোচনা করে আমরা এই ধ্রুব বিশ্বাসে দাঁড়িয়েছি যে, এর ভাষা ১৪০০ বা ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দের এ ধারে কিছুতেই হতে পারে না। সুতরাং আলোচনা-সমালোচনা যাই হোক না কেন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের পুঁথিটি পঞ্চদশ শতাব্দীর সূচনাতে বা মাঝামাঝি যে কোনো সময়ে লেখা বলে ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিতমহল মনে করেন।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য অবলম্বনে তৎকালীন সমাজচিত্র:

সাহিত্য সমাজের দর্পণ। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য রাধাকৃষ্ণের প্রেমের উপাখ্যান হলেও এ কাব্যে তৎকালীন সমাজজীবনের খানিকটা আভাস মেলে। এ কাব্যে সমকালীন জীবনধারা এবং পল্লি জীবনের ছবি একেবারেই দুর্লক্ষ নয়। আমরা প্রাচীন বাংলার অশিক্ষিত গোপ পল্লির তথা অনভিজাত শ্রেণির জীবনযাত্রার বাস্তব চিত্র পাই এ কাব্যে। এ কাব্যে তৎকালীন সমাজের শিথিল যৌন জীবনের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। রাধা বিবাহিতা। তার স্বামীর নাম আইহন। সম্পর্কে রাধা কৃষ্ণের মাতুলানী। রাধার রূপে মুগ্ধ ভাগিনেয় কৃষ্ণ তার কাছে প্রেম নিবেদন করেছে। এখানে মাতুলানী ভাগিনেয়ের অসামাজিক সম্পর্ক বর্ণিত হয়েছে। বাল্যবিবাহ তৎকালীন সমাজে যে প্রচলিত ছিল রাধার বাল্যবিবাহে তা প্রমাণিত। তৎকালীন সমাজের লোকেরা পারিবারিক পরিমণ্ডলে বসবাস করতো। স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি, বৃদ্ধ বড়ায়ি প্রভৃতিকে কেন্দ্র করেই এরূপ পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছিল। তখনকার স্ত্রীলোকেরা ঘরের বাইরে বের হতো না। তবে গোপবংশের মেয়েরা দধি দুধের পসরা নিয়ে হাটে যেত। রাধা ছিল গোপ বালিকা বধূ। খেয়াঘাটে নদী পারাপারের জন্য কড়ির প্রয়োজন হতো। নৌকা তৈরির জন্য মিস্ত্রি, করাতি প্রভৃতি পেশার মানুষ ছিল। গ্রাম্য মেয়েরা দল বেঁধে নদী থেকে পানীয় জল আনত। তৎকালীন সমাজে নানা কুসংস্কার প্রচলিত ছিল। বিপদমুক্ত হতে দেবতার পূজা করতো। রোগ সারাতে ঝাড় ফুঁক, তুকতাক করতো এবং অশিক্ষিত লোকেরা অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতো। সমাজে চোর ডাকাতের বসতি ছিল। বিবাহের সময় ঘটকের মাধ্যমে ফুল-ফল-সন্দেশ পাঠানো হতো। এভাবে আমরা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে তৎকালীন সমাজব্যবস্থার যে পরিচয় পাই তা যেন বর্তমান সমাজব্যবস্থার অনুরূপ।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য কে, কিভাবে আবিষ্কার করেন:

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের প্রথম কাব্যগ্রন্থ “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন” কাব্য। এটি রাধাকৃষ্ণের প্রেমের উপাখ্যান। এটি আবিষ্কৃত হওয়ার পর মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ধারায় পূর্ণতা আসে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং পুঁথিশালার অধ্যক্ষ বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ সংবাদ পান যে, পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বনবিষ্ণুপুরের কাছে কাকিল্যা গ্রামে দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় নামক এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে হাতের লেখা কিছু পুরাতন পুঁথি আছে। এ সন্ধানের প্রেক্ষিতে তিনি ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে (১৩১৬ বঙ্গাব্দে) সেখানে যান এবং ঐ ব্রাহ্মণের গোয়াল ঘর থেকে তিনি অযত্নে রক্ষিত একরাশ পুঁথির সঙ্গে এ গ্রন্থটি পান। এ গ্রন্থের প্রথম দুটি এবং শেষ পৃষ্ঠা পাওয়া যায়নি। এভাবে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন” কাব্য আবিষ্কৃত হয়।