রবীন্দ্র-যুগের মনস্বীদের অন্যতম রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী (১৮৬৪-১৯১৯ খ্রীঃ)। তার বিদ্যাবত্তার জন্যই প্রধানতঃ শ্রুতকীর্তি হলেও তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রবন্ধ ভাণ্ডারকে যে নানাভাবেই সমৃদ্ধ করে তুলেছিলেন, তার পরিচয় পাওয়া যায় তার রচনাবলীর প্রাচুর্য ও বৈচিত্র্য থেকে। রামেন্দ্রসুন্দর রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় এম. এ-পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে অধ্যাপনায় ব্রতী হন এবং অধ্যক্ষরূপে অবসর গ্রহণ করেন। শিক্ষাপ্রসারে যেমন তিনি অগ্রণীর ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন, তেমনি সমাজের কল্যাণকর অনুষ্ঠানে তথা সামগ্রিকভাবে দেশসেবায়ও ছিলেন নিবেদিত-প্রাণ সমাজসংস্কারে, জাতিভেদ-প্রথার উচ্ছেদসাধনে, সাহিত্য পরিষৎ প্রতিষ্ঠায় কিংবা বঙ্গ-ভঙ্গ-বিরােধী আন্দোলনে তার ভূমিকার কথা সমকালে বিশেষভাবেই স্বীকৃতি লাভ করেছিল। সর্বোপরি তার সাহিত্যপ্রেমের পরিচয়টি সমকালকে অতিক্রম করেও যুগান্তরের স্পর্শ লাভ করেছে। রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ বন্ধু রামেন্দ্রসুন্দর বিজ্ঞানের ছাত্র-অধ্যাপক হলেও সাহিত্যক্ষেত্রেই যে সমধিক কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন, এ সত্য অস্বীকার করবার উপায় নেই। তবে নিরালম্ব-সাহিত্য বিষয়ে তার বিশেষ উৎসাহ ছিল না, জ্ঞানের বাহন রূপে তিনি সাহিত্যকে ব্যবহার করেছেন। তবে সে জ্ঞান শুধু বিজ্ঞান-বিষয়ক নয়, বহুব্যাপ্ত বিষয়েই ছিল তার অধিকার এবং ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, এমন কি বেদ-বেদান্ত প্রভৃতি বিষয়েও তিনি নানা প্রবন্ধ বা গ্রন্থ রচনা করেছেন।
রামেন্দ্রসুন্দরের ব্যক্তিগত জীবনচর্চা এবং অপরাপর গুণসমূহের সমাহার করে অধ্যাপক অসিত বন্দোপাধ্যায় তার সম্বন্ধে যথার্থই মন্তব্য করেছেন ঃ “..এত বড় জ্ঞানতাপস মহামনীষী, ক্রান্তদর্শী অথচ শিশুসরল ব্যক্তি আর এ দেশে জন্মাবেন কিনা জানি না, প্রাচীন ভারতের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি ও হেলিনিক (গ্রীক) বিশ্বের প্লেটো সক্রেটিসের যথার্থ আত্মার দোসর হচ্ছেন উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আবির্ভূত রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী।…বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের দুর্বলতা ঘােচাতে, চিন্তার সামগ্রীকে উচ্চতর পর্যায়ে তুলে ধরতে এবং সমস্ত জাতির মােধর্মের আমূল রূপান্তরের জন্য রামেন্দ্রসুন্দর যা’ করে গেছেন তার মূল্য বুঝবে আগামীকালের বাঙ্গালী সমাজ। আজকের এই ভ্রষ্টতার দিনে তাঁকে অন্য গ্রহ থেকে নিক্ষিপ্ত বিচিত্র জীব বলেই মনে হবে।”
রামেন্দ্রসুন্দরের প্রথম গ্রন্থ ‘প্রকৃতি’ ১৮৯৬ খ্রীঃ প্রকাশিত হলেও তিনি ১৮৮৪ খ্রীঃ ‘নবজীবন’ পত্রিকায় ‘মহাশক্তি’ নামক প্রবন্ধ রচনার মধ্য দিয়েই সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেন। সমকালীন বহু সাময়িক পত্রিকাতেই তিনি প্রবন্ধ-রচনাসূত্রে যুক্ত ছিলেন। তার অপরাপর গ্রন্থসমূহের মধ্যে রয়েছে ‘জিজ্ঞাসা’ (১৯০৪), ‘বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা’ (১৯০৬), ‘মায়াপুরী’ (১৯১১), ‘কর্মকথা’ (১৯১৩), ‘চরিতকথা’ (১৯১৩), ‘বিচিত্র প্রসঙ্গ’ (১৯১৪), ‘শব্দকথা’ (১৯১৭), ‘বিচিত্র জগৎ’ (১৯২০), ‘যজ্ঞকথা’ (১৯২০), ‘নানাকথা’ (১৯২৪) ও ‘জগকথা’ (১৯২৬)। এ ছাড়া তিনি ১৯১১ খ্রীঃ ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণে’র অনুবাদ রচনা করেছিলেন।
রামেন্দ্রসুন্দর মূলতঃ ছিলেন প্রাবন্ধিক, সৃজনশীল সাহিত্য সৃষ্টির ব্যাপারে তার তেমন কোন ঔৎসুক্যের পরিচয় পাওয়া যায় নি। প্রবন্ধের বিষয়ও খুব সরল সহজ ছিল না। জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শনই তার আলােচনায় প্রধান স্থান অধিকার করেছিল কাজেই তার রচনা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুষ্প্রবেশ্য-এরকম একটা অভিযোেগ বহু প্রচলিত। কিন্তু এর জন্য রামেন্দ্রসুন্দরের ‘রচনাকে দায়ী করা সঙ্গত নয়, বিষয়ের কাঠিন্যই রচনাকে কিঞ্চিৎ পাঠক-বিমুখ করে তুলেছে। ‘রচনার ভাষা হবে বিষয়ানুগামিনী’- বঙ্কিমের এই অভিমতকে তিনি শিরােধার্য করেছিলেন। রামেন্দ্রসুন্দর ভাষা বিষয়ে নিজেও অভিমত প্রকাশ করেছেন, “…যে অংশের উদ্দেশ্য লােকশিক্ষা, তাহা লৌকিক ভাষার নিকটবর্তী হইবে; এবং যে অংশের উদ্দেশ্য শিক্ষিতের জন্য রসসৃষ্টি, অথবা অভিজ্ঞের সহিত জ্ঞানালােচনা, তাহাও লৌকিক ভাষা হইতে দূরবর্তী হইবে। ইহা সাধারণ নিয়ম”– রামেন্দ্রসুন্দর স্বয়ংও এই নিয়মের বাইরে যান নি; তাঁর রচনার বিষয় প্রধানতঃ জ্ঞানালােচনা বলেই তার ভাষা লৌকিক ভাষা থেকে কিছুটা দূরবর্তী, কিন্তু যখন তিনি বঙ্গভঙ্গ উপলক্ষে লােকশিক্ষার প্রয়ােজনে ‘বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা’ রচনা করেন, তখন তিনি লৌকিক ভাষা তথা চলিত ভাষারই শরণ নিয়েছিলেন। স্মরণ রাখা প্রয়ােজন, তখনও সাহিত্যক্ষেত্রে প্রমথ চৌধুরীর আবির্ভাব ঘটেনি।
রামেন্দ্রসুন্দর তার প্রথম গ্রন্থ ‘প্রকৃতি’তে যে সমস্ত প্রবন্ধ সঙ্কলন করেছেন, তাদের সব কটিই বিজ্ঞান-বিষয়ক। ‘সৌরজগতের উৎপত্তি’, ‘আকাশ-তরঙ্গ’, ‘পৃথিবীর বয়স’, ‘প্রকৃতির মূর্তি’, ‘প্রলয়’ প্রভৃতি প্রবন্ধে জীববিদ্যা, ভূবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতি বিজ্ঞান-বিষয়ই আলােচিত হয়েছে। রামেন্দ্রসুন্দর এ সমস্ত প্রবন্ধে কোন মৌলিক তত্ত্বের অবতারণা না করলেও কতকগুলি প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বকে সহজ সরল ভাষায় সাধারণ পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। তার ‘বিচিত্র জগৎ’ নামক অপর একটি প্রবন্ধ সঙ্কলন গ্রন্থেও তিনি বিজ্ঞান-বিষয়ক বিভিন্ন তত্ত্বের অবতারণা করেছেন ‘বিজ্ঞানবিদ্যায় বাহ্যজগৎ’, ‘ব্যবহারিক ও প্রতিভাসিক জগৎ’, ‘বাত্ময় জগৎ’, ‘জড় জগৎ’ প্রভৃতি প্রবন্ধে “জীব ও জড়ের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং চেতন-বস্তুর চারিত্র্য-বৈশিষ্ট্য তথা স্বরূপ ধর্ম বিষয়ে আলােচনার উপরই সমধিক গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছে।” অপরিণত-মনস্ক পাঠকদের পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন-আদি বিজ্ঞান বিষয়ে কিছু প্রাথমিক জ্ঞান দানের উদ্দেশ্যে মনীষী রামেন্দ্রসুন্দর ৭৫টি প্রবন্ধের সঙ্কলন রূপে ‘জগৎকথা’ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।
রামেন্দ্রসুন্দরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি জিজ্ঞাসা’। এতে ‘সুখ না দুঃখ’, ‘জগতের অস্তিত্ব’, ‘আত্মার অবিনাশিতা’, ‘এক না দুই?’, ‘মুক্তি’ প্রভৃতি প্রবন্ধে যেমন জটিল দার্শনিক, মতবাদের প্রতিফলন ঘটেছে, তেমনি নন্দনতত্ত্ব-বিষয়ক আলােচনাও রয়েছে সৌন্দর্যতত্ত্ব, সৌন্দর্যবৃদ্ধি প্রবন্ধে যদিও তিনি সৌন্দর্যের পশ্চাতে ডারুইনের নির্বাচনতত্ত্বের সন্ধান পেয়েছেন।আবার এই গ্রন্থেই তিনি ‘সত্য’, ‘অতিপ্রাকৃত’, ‘মাধ্যাকর্ষণ, ‘নিয়মের রাজত্ব’ প্রভৃতি বিজ্ঞান-বিষয়ক আলােচনায়ও প্রবৃত্ত হয়েছেন। বস্তুতঃ বিষয়-বৈচিত্র্য এবং ভাষার প্রসাদগুণে এই প্রবন্ধ গ্রন্থটি সৃজনধর্মী সাহিত্যে উন্নীত হয়েছে।
দেশহিতব্রতী রামেন্দ্রসুন্দর এতদ্দেশীয় যুবকদের চরিত্র-গঠনে সহায়তা দানের উদ্দেশ্যে ‘চরিতকথা’ গ্রন্থে দেশ-বিদেশের কিছু মনীষীর জীবনচিত্র উপস্থাপিত করেছেন। ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’, ‘বঙ্কিমচন্দ্র’, ‘মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ’, ‘হর্মান হেলমহােলজ’ প্রভৃতির চরিত্র চিত্রণে তিনি অনুপম সার্থকতার পরিচয় দিয়েছেন। তার ‘বিচিত্র জগৎ’ গ্রন্থে বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য, ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব-আদি বহু বিচিত্র বিষয় একত্রীকৃত হয়েছে। গ্রন্থটির বিষয়-বক্তা রামেন্দ্রসুন্দর হলেও অনুলিপিকর বিপিনবিহারী গুপ্ত তার নিজের ভাষায় তা রচনা করেন।
ভাষা-শিক্ষা-সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়ে রামেন্দ্রসুন্দর যে একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন,তার নিশ্চিত প্রমাণ তার ‘শব্দকথা’ গ্রন্থটি। এতে ‘ধ্বনিবিচার’, ‘বাংলা ব্যাকরণ’, ‘বৈজ্ঞানিক পরিভাষা’ প্রভৃতি প্রবন্ধে অতিশয় গুরুপাক বিষয়কেও তিনি সহজপাচ্য অবস্থায় দাঁড় করিয়েছেন। ‘নানাকথা’ গ্রন্থে ‘ইংরেজী শিক্ষার পরিণাম’, ‘সাহিত্যকথা’, ‘শিক্ষাপ্রণালী’, ‘অরণ্যে রােদন’, ‘মহাকাব্যের লক্ষণ’ প্রভৃতি প্রবন্ধে তিনি একাধারে পাণ্ডিত্য ও রসবেত্তার পরিচয় দিয়েছেন।
আমাদের প্রাচীন শাস্ত্র বিষয়ে রামেন্দ্রসুন্দর শুধু কৌতূহলীই ছিলেন না, এ বিষয়ে তিনি অসাধারণ পারঙ্গমত্বও লাভ করেছিলেন। ‘যজ্ঞকথা’ গ্রন্থে বৈদিক যাগযজ্ঞের বিস্তৃত বিবরণ দান করে তিনি এ কালের পাঠকদের সম্মুখে প্রাচীন যুগের চিত্রকে সুস্পষ্ট করে তুলেছিলেন। ‘কর্মকথা’ গ্রন্থের বিভিন্ন প্রবন্ধের সাহায্যে তিনি সামাজিক ক্রিয়াকর্মের বিচিত্র ভূমিকার যেমন পরিচয় দিয়েছেন, তেমনি গীতার কর্মযােগ ও জ্ঞানযােগের মধ্যে সমন্বয়ের সূত্রও দেখিয়ে দিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে তাঁর ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণে’র অনুবাদের কথাও বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।
রোমেন্দ্রসুন্দরের একটি মহৎ কীর্তি ‘বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা’। এটি চলিত ভাষায় রচিত এবং একটি সৃজনধর্মী রচনা। তবে এটুকুই এর বৈশিষ্ট্য নয়, এর সঙ্গে রামেন্দ্রসুন্দরের দেশপ্রাণতার একটি অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক রয়েছে। বঙ্গভঙ্গের দিন, ঐ অপকর্মের প্রতিবাদে রামেন্দ্রসুন্দর-পরিকল্পিত বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রত অনুষ্ঠিত ও ব্রতকথা পাঠান্তে রাখীবন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এই ব্রতকথায় রবীন্দ্রনাথের প্রখ্যাত ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল’ গানটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এই ব্রতকথার মধ্য দিয়ে লেখক জাতি ও সম্প্রদায়গত সংহতি-রক্ষায় উদ্যোগী হয়েছিলেন।
Leave a comment