উত্তরঃ বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগে অর্থাৎ ৬৫০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যকার সময়ে সাহিত্যিক নিদর্শন হিসেবে তেমন কিছু একটা পাওয়া যায় না। একমাত্র চর্যাপদই এ সময়ের প্রকৃত সাহিত্য দলিল। মহামহােপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কর্তৃক নেপালের রাজগ্রন্থশালা থেকে আবিষ্কৃত এবং বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সাহায্যে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘হাজার বছরের পুরান বাংলা ভাষার বৌদ্ধগান ও দোহা’ গ্রন্থে চব্বিশ জন বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যের রচিত ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ের’ সাতচল্লিশটি অখণ্ড গান চর্যাপদ নামে পরিচিত। চর্যাপদে বৌদ্ধধর্মের সহজযান সম্প্রদায়ের গৃঢ় সাধনপ্রণালী ও দর্শনতত্ত্ব রূপকে আভাসে ইংগিতে ব্যক্ত হয়েছে। প্রাচীন বাংলা ভাষায় রচিত এ পদগুলাের যেমন সাহিত্যিক মূল্য রয়েছে, তেমনি প্রাচীন বাঙালি সমাজের চিত্রও এতে সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত।
বাংলা সাহিত্য বিষয়ক যেসব নিদর্শন এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে সেগুলাের মধ্যে ‘চর্যাপদ’, ‘শূন্যপুরান’, ‘সেক শুভােদয়া’ সবিশেষ উল্লেখযােগ্য। এছাড়া বিভিন্ন সংস্কৃত গ্রন্থের টীকাভাষ্যে কিছু কিছু বাংলা কবিতার ছত্র পাওয়া যায়। এর মধ্যে বিশেষ করে উল্লেখযােগ্য চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ের টীকাভাষ্যের কয়েকটি বাংলা কবিতার ছত্র, চতুরাভরণ নামক সংস্কৃত গ্রন্থে বাংলা অপভ্রংশ মিশ্রিত কয়েকটি ছড়া, ‘বিমুগ্ধ মুখমগুণ’ সংস্কৃত গ্রন্থে সংকলিত কয়েকটি বাংলা শব্দ ইত্যাদি। ‘সেক শুভােদয়া’ লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি হলায়ুধ মিশ্রের রচনা। এ গ্রন্থের প্রথম দিকে কয়েকটি বাংলা গান ও চর্যার উল্লেখ আছে। মুণিদত্তের টীকাভাষ্যে মীননাথের কবিতার চার ছত্র উদ্ধৃত, যা বাঙলা সাহিত্যের নিদর্শন হিসেবে মূল্যবান। ভুসুকুপা-এর ‘চতুরাভরণ’ গ্রন্থে দু’চারটি বাঙলা পদ আছে।
দীনেশচন্দ্র সেন ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ গ্রন্থে প্রাচীন বাংলার কিছু শব্দের উল্লেখ করেছেন সেগুলাে ‘দেশী নামমালা’, ‘টীকাসর্বস্ব’, ‘চৈনিক অভিধান’, ‘তাম্রশাসন লিপি ইত্যাদি গ্রন্থে পাওয়া যায়। ‘টীকাসর্বস্ব’ গ্রন্থে প্রায় তিনশ বাংলা শব্দ রয়েছে। ৭ম ও ৮ম শতকে সংকলিত চৈনিক অভিধানে কতকগুলাে বাংলা শব্দ আছে যা বাংলার আদি শব্দ বলে স্বীকৃত।
‘ময়নামতির গান’, ‘গােপীচন্দ্রের সন্ন্যাস’, ‘ব্রতকথা’, ‘রূপকথা’ ইত্যাদি প্রাচীন যুগের রচনা। ডাক ও খনার বচন, নাথগীতিকা প্রভৃতি লােক সাহিত্য বাংলা সাহিত্যের প্রাথমিক যুগেও ছিল। রামাই পণ্ডিতের ‘শূন্যপুরাণ’ যার বিষয়বস্তু হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলমানের দ্বন্দ্ব নিরসন, এটি প্রাচীন যুগের শেষপাদে রচিত বলে অনুমান করা হয়। প্রাচীনতা ও যথার্থ সাহিত্যকর্ম হিসেবে একমাত্র চর্যাপদই প্রাচীন যুগের বাংলা সাহিত্যের নিদর্শন হিসেবে গণ্য হবার যােগ্য।
Leave a comment