‘পদ্মাবতী’ নাটকে মধুসূদন গ্রীক পুরাণের ‘Apple of Discord’ উপাখ্যানকে ভারতীয় পটভূ মিকায় স্থাপন করেছেন। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, এই নাটকটিতে তিনি গ্রীক নাট্যাদর্শ অনসুরণ করেছেন। সৌন্দর্যের দ্বন্দ্বে শচী, রতি ও মুরজা (কুবের-পত্নী) রাজা ইন্দ্রনীলের সমীপে উপস্থিত হন যথার্থ বিচারের প্রত্যাশায়। ইন্দ্রনীল রতির সৌন্দর্য সর্বশ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা করলেন সুতরাং ইন্দ্রনীল রতির কৃপায় অপরূপ সুন্দরী পদ্মাবতীকে লাভ করলেন। কিন্তু শচীর আক্রোশে সংঘাত ও বিরহ। অবশ্য সবশেষে মধুসূদন মিলনান্তক পরিণতি টেনেছেন। নাটকটি সম্পূর্ণ রোমান্টিক ‘শর্মিষ্ঠা’র ন্যায় ‘পদ্মাবতী’রও প্লট খুবই শিথিল। ‘পদ্মাবতী’র দৃশ্যযোজনাও বেশ শিথিল।


‘কৃষ্ণকুমারী’ মধুসূদনের শ্রেষ্ঠ রচনা। এটি বাংলা নাট্যসাহিতের প্রথম সার্থক ট্র্যাজেডি। স্বাভাবিক ভাবেই মধুকবি শেকসপিয়ারের নাট্যাদর্শ অনুসরণ করেছেন। রাজপুত ইতিহাস থেকে তিনি আখ্যান ভাগ গ্রহণ করেছেন। উদয়পুরের রাজকন্যা অপরূপ সুন্দরী ‘কৃষ্ণকুমারী’কে লাভ করার জন্য জয়পুর-রাজ জয়সিংহ ও মেরু দেশাধিপতি মানসিংহের দ্বন্দ্ব নিয়ে নাটকটি পরিকল্পিত ‘কৃষ্ণকুমারী’-তে মদুসূদন দৈবশাসিত, মায়াময় সুখদুঃখে-ভরা, পৌরাণিক জগৎ থেকে ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠ, অমোঘ কার্যকারণ শৃঙ্খলায় গ্রথিত, দ্বন্দ্বময় রঙ্গভূমিতে নেমে এসেছেন। অন্যান্য নাটকে যে-বিপদের ঘনঘটা দৈবানুগ্রহে মুহূর্তে কেটে গিয়েছে এখানে তা ঘনীভূত হয়ে বজ্রনির্ঘোষে মানবভাগ্যকে অভিভূত করেছে। ‘কৃষ্ণকুমারী’র আখ্যান কাজেই ট্র্যাজেডির পরিণতি লাভ করেছে। রাজপুত-ইতিহাসের রাজন্যবর্গের আত্মকলহ ও পরস্পর রেষারেষির সঙ্গে গার্হস্থ্য জীবনের ছোটোখাট চক্রান্ত মিশে যে-সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে তাই শোকাবহ পরিণতি ঘটিয়েছে। ঘরের ছোটো আগুনেই রাজ্যব্যাপী বিরাট অগ্নিদাহের সৃষ্টি হয়েছে। ধনদাস—বিলাসবতী—মদনিকা নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ রক্ষা করতে রাষ্ট্রবিপ্লবের আয়োজন করেছে ও এক সরল, ফুলের মতো শুভ্রশুচি রাজকুমারীর আত্মনাশের কারণ হয়েছে।” * মধুসূদনের নাটকত্রয়ের মধ্যে ‘কৃষ্ণকুমারী’ সর্বশ্রেষ্ঠ। মধুসূদনের মৃত্যুর পর তাঁর প্রায় সম্পূর্ণ নাটক ‘মায়াকানন’ প্রকাশিত হয় ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে।


তিলোত্তমা সম্ভব কাব্য :

মধুসূদনের সর্বপ্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত আখ্যায়িকা কাব্য— ‘তিলোত্তমা সম্ভব কাব্য’ (১৮৬০)। মহাভারতের সুন্দ-উপসুন্দের উপাখ্যানের ভিত্তিতে এটি রচিত। কাব্যটি চারিটি সর্গে সমাপ্ত। পয়ারের বাঁধনমুক্ত বেগবান, শব্দঝঙ্কারময় ও ঐশ্বর্যশালী হয়ে বাংলা কাব্য অমিত্রাক্ষর ছন্দে প্রথম দেখা দিল। এর মুক্ত ও সাবলীল গতি সংস্কৃত শব্দতরঙ্গের আভিজাত্য লাভ করল। বস্তুত বাংলা ভাষা বীর ও করুণ রসসমৃদ্ধ কাব্যসৃষ্টির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হল। প্রথম পরীক্ষা বলে কাব্যটির প্রবহমানতায় কিছু ত্রুটি আছে।


মেঘনাদবধ কাব্য:

মধুসূদনের দ্বিতীয় এবং শ্রেষ্ঠ কাব্য ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্য প্রকাশিত হয় ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে। এটা কবির অবিস্মরণীয় কীর্তি। ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্যে’র অমিত্রাক্ষর ছন্দের ত্রুটি উত্তীর্ণতার নিরিখেও এর কলাসৌন্দর্য শ্রেষ্ঠ। মেঘনাদ বধের কাহিনি সংগৃহত হয়েছে রামায়ণের লঙ্কাকাণ্ড থেকে। কবির কৃতিত্ব চরিত্রসৃষ্টির আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গীতে। কবি এই কাব্যে ভারতীয় রামায়ণ সংস্কারে রাবণ মেঘনাদ প্রভৃতি চরিত্রগুলিকে বীরত্বব্যঞ্জক সৃষ্টিকৌশল বিপ্লবী করেছেন। দৃষ্টিভঙ্গীর এই মৌলিকতা মধুসূদনকে বিপ্লবী কবিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কবি আঙ্গিকে পাশ্চাত্য মহাকাব্যের অনুসরণ করেছেন। গ্রীক নিয়তিবাদ ও ভারতীয় কর্মফলবাদ, বীররস ও করুণরস, মহাকাব্যের নিষ্ঠুরতা ও গীতিকাব্যের রোমান্টিক ক্রন্দন কবির লেখনীতে এই কাব্যে রূপায়িত হয়েছে। মেঘনাদবধ কাব্যে মধুসূদন পূর্ণাঙ্গ মহাকাব্যের রূপদান করেছেন। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, মধুসূদন আমাদের রামায়ণ-সংস্কারে বৈপ্লবিক পরিবর্তন করতে প্রয়াসী হয়েছেন মেঘনাদবধ’ কাব্যে। আমাদের সংস্কারে যে রাবণ পাপাচারী, নারী-অপহারক, অনার্য রাক্ষসরাজ, মধুকবি তাঁকে মানুষরূপে সৃষ্টি করেছেন—এই রাবণ পিতা, আদর্শ যোদ্ধা, আদর্শ রাজা। ইন্দ্রজিতকে রামায়ণে মায়াবী যোদ্ধারূপে দেখানো হয়েছে, মধুসূদন তাঁকে মহাকাব্যের উপযুক্ত বীর চরিত্ররূপে সৃষ্টি করেছেন। নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে অস্ত্রহীন অবস্থায় পূজার শঙ্খঘণ্টা নিয়ে লক্ষ্মণের অধর্ম যুদ্ধে মেঘনাদ যে বীরত্বের পরিচয় দান করেন তা অবিস্মরণীয়। এই বীরের জন্য পাঠকের অসীম মমতা কবি আকর্ষণ করেছেন। রাবণের জীবন কবি নিয়তিপীড়িত ভাগ্যাহত মানুষের জীবন রূপে সৃষ্টি করেছেন ; প্রমীলাকে কবি ভারতীয় নারীর মাধুর্য ও পাশ্চাত্য নারীর বীর্যবত্তার সংমিশ্রণে সৃষ্টি করেছেন। বিভীষণ চরিত্রের ধর্মমহিমাসংস্কার মধুসূদন ধূলিসাৎ করেছেন মানবধর্ম দৃষ্টিতে। সরমা চরিত্রটি একাকিনী সীতার নিঃসঙ্গ সহচরীরূপ কবি আপন সহানুভূতির গভীরতায় সৃষ্টি করেছেন।

মধুসূদন ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যে একটি সুস্পষ্ট যুগমানসের অভিব্যক্তি করেছেন। ডক্টর শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় বলেন—“বাল্মীকি রামচন্দ্রকে নরচন্দ্রমারূপে উপস্থাপিত করেছেন ; কৃত্তিবাস এঁকে অবতাররূপে কল্পনা করে তাঁর উপর দেবত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছেন ও ভক্তিরসোচ্ছলতায় এঁকে অভিসিক্ত করে যুগপ্রয়োজনের দাবী মিটিয়েছেন। বাল্মীকি ও কৃত্তিবাস উভয়ের নিকটেই রাম রাবণের যুদ্ধ, ধর্ম ও অধর্ম, ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে সংগ্রাম; এই সংগ্রামে রাবণের প্রতি যে সহানুভূতি জাগতে পারে তা তাঁদের কল্পনাতীত ছিল। এই যুদ্ধ যে কোন দৃষ্টিভঙ্গীতে আততায়ীর বিরুদ্ধে জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের মর্যাদা ও ভাবাদর্শ লাভ করতে পারে, তাও তাঁরা মনে করেন নি। কিন্তু মধুসূদনের রচনায় যুগমানসের বিশেষ অভিলাষটি, যুগচেতনার কাম্যতম স্পন্দনটি স্ফুরিত হয়ে একে প্রকৃত মহাকাব্যের গৌরব দিয়েছে।” মধুসূদন এইখানেই যুগন্ধর। রবীন্দ্রনাথ ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের অন্তর্গত নবজীবনদৃষ্টি ও কাব্যসিদ্ধি সম্পর্কে বলেছেন—“মেঘনাদবধ কাব্যে কেবল ছন্দোবন্ধে ও রচনা প্রণালীতে নহে, তার ভিতরকার ভাব ও রসের মধ্যে একটি অপূর্ব পরিবর্তন দেখতে পাই। এ পরিবর্তন আত্মবিস্মৃত নয় এর মধ্যে একটা বিদ্রোহ আছে। কবি পয়ারের বেড়ি ভেঙেছেন এবং রাম-রাবণের সম্বন্ধে অনেকদিন থেকে আমাদের মনে যে একটি বাঁধাবাঁধি ভাব চলে আসছে স্পর্ধাপূর্বক তারও শাসন ভেঙেছেন। এই কাব্যে রাম-লক্ষ্মণের চেয়ে রাবণ ইন্দ্রজিৎ বড়ো হয়ে উঠেছে। যে ধর্মভীরুতা সবসময়ই কোনটা কতটুকু ভালো ও কতটুকু মন্দ, তা কেবলই অতি সূক্ষ্মভাবে ওজন করে চলে, তার ত্যাগ দৈন্য আত্মনিগ্রহ আধুনিক কবির হৃদয়কে আকর্ষণ করতে পারে নি। তিনি স্বতঃস্ফূর্ত শক্তির প্রচণ্ড লীলার মধ্যে আনন্দবোধ করেছেন। এই শক্তির চারদিকে প্রভূত ঐশ্বর্য; এর হর্মচূড়া মেঘের পথরোধ করেছে; এর রথ-রথি-অশ্ব গজে পৃথিবী কম্পপান; এ স্পর্ধা দ্বারা দেবতাদিগকে অভিভূত করে বায়ু-অগ্নি-ইন্দ্রকে আপনার দাসত্বে নিযুক্ত করেছে ; যা তার জন্য এই শক্তি শাস্ত্রের বা অস্ত্রের বা কোনো কিছুর বাধা মানতে সম্মত নয়। এতদিনের সঞ্চিত অভ্রভেদী ঐশ্বর্য চারদিকে ভাঙতে ভাঙতে ধুলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে, সামান্য ভিখারি রাঘবের সঙ্গে যুদ্ধে তার প্রাণের চেয়ে প্রিয় পুত্র, পৌত্র, আত্মীয় স্বজনেরা একটি একটি করে সকলেই মরছে তাদের জননীরা ধিক্কার দিয়ে কেঁদে যাচ্ছে, তবুও যে অটল শক্তি ভয়ংকর সর্বনাশের মাঝখানে বসেও কোনোমতেই হার মানতে চাইছে না, কবি সেই ধর্মবিদ্রোহী মহাদম্ভের পরাভবে সমুদ্রতীরের শ্মশানে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে কাব্যের উপসংহার করেছেন। যে শক্তি অতি সাবধানে সমস্তই মেনে চলে, তা যেন মনে মনে অবজ্ঞা করে, যে শক্তি স্পর্ধাভরে কিছুই মানতে চায় না, বিদায়কালে কাব্যলক্ষ্মী নিজের অশ্রুসিক্ত মালাখানি তারই গলায় পরিয়ে দিল।”


মধুকবির বিস্ময়কর কাব্য ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’ (১৮৬১)। বৈক্ষ্ণব পদাবলীর নায়িকা শ্রীরাধার অনস্ত বেদনা অবলম্বন করে কবি ‘মেঘনাদ বধ কাব্যের সমসময়ে এই কাব্যটি রচনা করেন। মহাকাব্যের বীর ও করুণরসের স্রোতপ্রবাহে মধুসূদনের গীতিকবিধর্মিতার সুরলহরী ইতিমধ্যেই পরিলক্ষিত হয়েছে। এই কাব্যে কবি তাঁর সম্যক প্রমাণ রক্ষা করলেন। কবি শ্রীরাধার বিরহ বেদনাদিগ্ধ অস্তরে আধুনিক নায়িকার বিরহবার্তা কিয়ৎপরিমাণে সংমিশ্রিত করেছেন। এই জন্যেই তাঁর নায়িকা বৈক্ষ্ণব শ্রীরাধা নহে, তিনি “Mrs. Radha’” এই কাব্যের প্রযুক্তিবন্ধন সম্পর্কে ডক্টর সুকুমার সেন মহাশয় বলেন—“ব্রজাঙ্গনার ছন্দে মধুসূদন যে স্বাধীনতা দেখিয়েছেন,—যতিসংখ্যায়, ছত্রসংখ্যায়, মিল এবং মাত্রাবৃত্তের ব্যবহারে—সে স্বাধীনতা অমিত্রাক্ষর পয়ার প্রবর্তনের অপেক্ষা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বাঙ্গালায় প্রথম ‘ওড়’ অর্থাৎ অসমচরণ লিরিক কবিতা বলেও ব্রজাঙ্গনার ঐতিহাসিক মূল্য আছে।”


‘দুর্গেশনন্দিনী’ ইতিহাসের পটভূমিকায় রচিত এবং ঘটনা ও চরিত্র সৃষ্টিতে অনেকাংশে বঙ্কিম ইতিহাসকে অনুসরণ করেছেন। ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে বঙ্গ-ওড়িষা প্রান্তাঞ্চলে মোগল-পাঠান সংগ্রামের ভিত্তিতে এটি বিরচিত। এই যুদ্ধ-বিগ্রহের বিপদসঙ্কুল ও অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে প্রেমের যে অতর্কিত উদ্ভব, দ্রুত পরিণতি ও সাফল্যের পথে নানা অভাবনীয় বাধা বিঘ্ন ঘটেছে তাই উপজীব্য। উপন্যাসের নায়ক জগৎসিংহ ঐতিহাসিক অপ্রসিদ্ধ পুরুষ কিন্তু বঙ্কিম তাকে আপন শক্তিতে জীবন্ত করে অঙ্কন করেছেন। এই বীরের চরিত্রে বঙ্কিম ক্ষাত্র-ধর্মের আদর্শ আরোপ করেছেন। বীরেন্দ্র সিংহের কন্যা তিলোত্তমা এবং কতলু খাঁর কন্যা আয়েষা তার প্রণয়াসক্তা। আয়েষার সুমহান আত্মত্যাগের দ্বারা ত্রিভুজপ্রেমের পরিণতি এসেছে। উপন্যাসটি কতটা রোমান্সধর্মী কিন্তু বাংলাসাহিত্যে ‘দুর্গেশনন্দিনী’র মূল্য ‘দুর্গেশনন্দিনী’-রূপে। বাংলা সাহিত্যের উপন্যাস-সৌধের এটাই প্রধান ও প্রাথমিক ভিত্তি।


‘মৃণালিনী’ বঙ্গদেশে তুর্কীবিজয়ের পটভূমিকায় রচিত। ইতিহাসের এই অধ্যায়ের সুনিশ্চিত ঐতিহাসিক উপাদানের অলভ্যতার জন্য বঙ্কিম অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কাল্পনিক ইতিহাস রচনা করেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর অগ্নিময়ী স্বাধীনতাস্পৃহার চিত্র এতে ব্যক্তিজীবনে প্রকাশিত হয়ে উঠেছে—সমগ্র জাতির হৃদয়ের স্পন্দনরূপ দেখানো সম্ভবপর হয় নি। বঙ্কিম বঙ্গ-পতনের পিছনে সম্ভাব্য কল্পিত বিশ্বাসঘাতকতা অবলম্বন করেই উপন্যাসটির ঘটনাপ্রবাহ নিয়ন্ত্রিত করেছেন। হেমচন্দ্র-মৃণালিনীর প্রেম ইহার সহিত সংমিশ্রিত। ডক্টর শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় এই প্রেমকে সুসার্থকভাবে বলেছেন—হেমচন্দ্র-মৃণালিনীর প্রেম সংস্কৃত সাহিত্যের অনুসরণে কল্পিত। পশুপতি মনোরমার প্রেম জটিল ও রহস্যময়। মনোরমার চরিত্রে বঙ্কিম দ্বৈতভাবের বিস্ময়কর প্রকাশ সম্ভবপর করে তুলেছেন। ‘মৃণালিনী’ উপন্যাসেই বঙ্কিমের স্বদেশপ্রীতির হৃদয় প্রথম উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে।


‘রাজসিংহ’ বঙ্কিমের সর্বশ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক উপন্যাস। বঙ্কিম এই উপন্যাসে ইতিহাসরসের সদাপ্রবাহে ঘটনা, চরিত্র ও আখ্যায়িকা নিয়ন্ত্রিত করেছেন। সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে ‘রাজসিংহে’র ন্যায় ঐতিহাসিক উপন্যাস দ্বিতীয় নেই। একদিকে রাজসিংহ ও রাজপুত জাতি অপরদিকে ঔরঙ্গজেব ও মোগল শক্তি—এই দুয়ের ঐতিহাসিক সংঘর্ষ ও যুদ্ধের ক্রমবিস্তারে বঙ্কিম উপন্যাসখানি নিয়ন্ত্রিত করেছেন। ইতিহাস-বহির্ভূত চরিত্র ও ঘটনার সংখ্যা ও গুরুত্ব যে পরিমাণে আছে তা মারাত্মক নয় এবং ঐতিহাসিক উপন্যাস রচয়িতার সম্পূর্ণ অধিকারে। ডক্টর শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় বলেন, ‘ইতিহাস-বহির্ভূত অংশ—জেবউন্নিসা—মবারক—দরিয়া ও মানিকলাল–নির্মলকুমারীর কাহিনি—ইতিহাসের বৃহত্তর আলোড়নের মধ্যে ব্যক্তিজীবনের রসে সমৃদ্ধ ও জীবনকে ইতিহাসের গতিবেগে চঞ্চল করেছে। এখানে ইতিহাসের আকস্মিকতা যেন জীবন নাটকের সুশৃঙ্খল পরিণতিতে বিধৃত হয়ে অর্থপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। বঙ্কিম এই উপন্যাসখানিতে যে ইতিহাসের মুগ্ধচিত্র অঙ্কন করেছেন তার তুলনা খুবই বিরল।


‘কপালকুণ্ডলা’ বঙ্কিমের শ্রেষ্ঠ রোমান্স। বঙ্কিম এই উপন্যাসখানিতে যেন একটি গবেষণা করেছেন। বিজন সৈকতপ্রাস্তের বনাশ্রয়ী কাপালিক আশ্রমে প্রতিপালিত কপালকুণ্ডলা সমাজের পারিবারিক জীবনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন নি। এই উপন্যাসে ইতিহাসে পরিমাণ খুবই সামান্য। কিন্তু তা সামান্য হলেও অসীম শক্তিসম্পন্ন এবং উপন্যাসের একটি বিশিষ্ট নিয়ামক হয়ে উঠেছে। বিশিষ্ট সমালোচকের উক্তি—“আবেগের যে স্পর্ধায় সেলিম মেহেরুন্নিসাকে পতিপাক্ষ হইতে ছিনাইয়া লইয়া আসিয়াছিল, সেলিম-প্রণয়িনী মতিবিবিও সেইজোরে পূর্বস্বামীকে সপত্নীবক্ষ হইতে কাড়িয়া লইতে প্রস্তুত। এ শক্তি সে আর কোথা হইতে পাইত না বলিয়াই উপন্যাসে ইতিহাসের অবতারণা।” ইতিহাসের সামান্য একটি তরঙ্গ এইভাবে সপ্তগ্রামের সামান্য গৃহপ্রাত্তে কল্লোল সৃষ্টি করল। ‘কপালকুণ্ডলা’র বৈশিষ্ট্য এর প্রযুক্তি-বন্ধন। এর ভাষা অসাধারণ। ‘—পথিক, তুমি কি পথ হারাইয়াছ?’—বাংলা সাহিত্যের ভাষা আন্দোলনে ইহা অবিস্মরণীয়। ‘দুর্গেশনন্দিনী’তে বঙ্কিমের ভাষা যে উত্তুঙ্গ গাম্ভীর্যে প্রবাহিত ‘কপালকুণ্ডলায়’ তাহা কাব্যধর্মে স্নিগ্ধ সুধাসিঞ্চিত। এই উপন্যাসে বঙ্কিম কবি হইয়া উঠিয়াছেন তাঁহার প্রযুক্তি সৌকর্যে।


‘চন্দ্রশেখর’ বঙ্কিমের বৈচিত্র্যপ্রয়াসী মানসিকতার পরিচায়ক। এতে একদিকে রয়েছে ইতিহাসের আর্বত, একদিকে রয়েছে আধুনিক প্রণয়সমস্যা, অপর দিকে রয়েছে গার্হস্থ্য চিন্তা সমুজ্জ্বল ধর্মীয় পটভূমিকা। লেখক প্রথম থেকে গার্হস্থ্যজীবন ও ইতিহাসকে সমান মর্যাদা দান করেও পরিণতিতে সমাজনিয়ন্ত্রা হয়ে উঠেছেন। বঙ্কিম বিশুদ্ধ পারিবারিক সুখনীড়ের যে মানস কল্পনা করেছেন তার বিরুদ্ধে ঝটিকাসঙ্কুল আবহাওয়ার বাস্তব সম্ভাবনাকে বিভিন্ন উপন্যাসে রূপায়িত করেছেন। পূর্বভারতে ইংরেজ রাজত্বে স্থাপন ও ভারতীয় শক্তির ক্রমাবলোপ এর ইতিহাস অংশ। মীরকাশেম বঙ্কিমের স্বদেশানুরাগী মনের সৃষ্টি। একদিকে চন্দ্রশেখর প্রতাপ-শৈবলিনী, অপরদিকে মীরকাশেম-দলনী—এই দুইটি জীবনাবর্তে উপন্যাসের ট্র্যাজেডি। এদের জীবনপ্রাঙ্গণে ইংরেজশক্তির ঝটিকা।


‘রজনী’ বঙ্কিমের একটি ক্ষুদ্রাকার সামাজিক উপন্যাস। এতে প্রযুক্তি কৌশলে বঙ্কিম একটি নতুনরীতি প্রদর্শন করেছেন। উপন্যাসের পাত্রপাত্রীর মধ্যে প্রধান চারজনের আত্মবিবৃতিতে কাহিনি অগ্রসর হয়েছে, ঔপন্যাসিক অতি সতর্কতায় সঙ্গোপন রয়েছেন। উপন্যাসের নায়িকা চরিত্রের পরিকল্পনায় বঙ্কিম ইংরেজি সাহিত্যের দ্বারস্থ হইয়াছেন। ঔপন্যাসিকের নিজ বক্তব্য উদ্ধার করি— “লর্ড লিটন প্রণীত Last Days Pompeii নামক উৎকৃষ্ট উপন্যাসে নিদিয়া নামে একটি কানা ফুলওয়ালী আছে; রজনী তৎস্মরণে সূচিত হয়।” উপন্যাসটি একটি বাস্তব সমাজের স্বপ্নলোক এই উপন্যাসে বঙ্কিম রজনী চরিত্র অঙ্কনে সূক্ষ্ম মনস্তত্ত্ববোধের পরিচয় রেখেছেন। বঙ্কিম উপন্যাসের প্রায় সর্বত্রলভ্য সন্ন্যাসীর অলৌকিকতায় গ্রন্থিমুক্তির স্বাক্ষর এতেও রয়েছে। অমরনাথের চরিত্রে বঙ্কিম তাঁর মানসপুত্রসম্ভব সত্যানুভূতির প্রখর উজ্জ্বলতা প্রদান করেছেন। চরিত্রটি আদর্শবাদ এবং আধুনিক মানসশূন্যতার অপূর্ব সমন্বয়ে সৃষ্ট।


‘আনন্দমঠ’, ‘দেবীচৌধুরাণী’ এবং ‘সীতারাম’ বঙ্কিমের অনুশীলন ধর্মতত্ত্বমূলক উপন্যাস। এই ত্রয়ী উপন্যাসে বঙ্কিম শিল্পীচেতনার সঙ্গে আর্দ্রবাদের সমন্বয় চেতনায় ঋষি বঙ্কিম হয়ে উঠেছেন। গীতার আদর্শ বঙ্কিমের মনোভূমি; এইজন্য তিনি এখানে যে পরিমাণে শিল্পী তদপেক্ষা অধিকতরভাবে জাতির ভবিষ্যৎ চিন্তাক্লিষ্ট নিয়ন্ত্রা। ‘আনন্দমঠ’ ও ‘দেবীচৌধুরাণী’ উপন্যাসে তিনি নিজের ধর্মচিত্তা ও তার প্রয়োগ রূপায়িত করেছেন। ‘আনন্দমঠে’ ঐতিহাসিক সন্ন্যাসী বিদ্রোহের প্রসঙ্গ ধরে ঊনবিংশ শতাব্দীর দেশাত্মবোধ প্রতিষ্ঠিত করেছেন গীতার নিষ্কাম কর্মবাদের আদর্শের ভিত্তিতে। ‘আনন্দমঠে’র মর্যাদা মহৎ উপনাসরূপে যতখানি তদপেক্ষা অনেক বেশি ভারতের জাতীয় গ্রন্থের মর্যাদায়। এই বিষয়ে এই গ্রন্থের সম্মানের সিংহাসনে আধুনিক ভারতের কোনও গ্রন্থ স্থাপিত হয় নি। বঙ্কিম ‘বন্দেমাতরম’ বন্দনা মন্ত্র সৃষ্টি করে এর আদর্শ ও প্রয়োগের সার্থকতায় ঋষিরূপে পূজিত হয়েছেন ‘আনন্দমঠে’। বঙ্কিম-প্রতিভার এই দিক চিরবন্দিত হয়ে থাকবে। ‘আনন্দমঠে’র অপর এক বৈশিষ্ঠ্য এর মধ্যে চরিত্র ও ঘটনার প্রধান-অপ্রধানের প্রশ্ন নেই ; একটি যুগের একটি জাতির প্রত্যেকে আপন হৃদয়ঝটিকায় স্বাধীনতা আন্দোলনের নৈবেদ্য সাজাতে এসেছে ; এইরূপ অসংখ্য চরিত্র ও যুগ ও জাতির প্রতিচ্ছবি ভারতের দ্বিতীয় কোনও উপন্যাসে লভ্য নয়। উপন্যাসের আধুনিক সংজ্ঞায় ‘আনন্দমঠ এই অর্থে সার্থকতম উপন্যাস। নিষ্কাম কর্মবাদের ক্রমাভিব্যক্তিতে ‘দেবীচৌধুরাণী’ ‘আনন্দমঠ’ এবং সর্বশেষে ‘সীতারাম’ স্থলাভিষিক্ত। ‘দেবীচৌধুরাণী’ এই প্রবাহের প্রথম বলে দোষত্রুটিও বেশি। নিষ্কাম কর্মাদর্শের রূপায়ণে তিনি এতদূর মগ্ন ছিলেন, যে, এই উপন্যাসে কাহিনি ও চরিত্রের বাস্তব গতিবিধির প্রতি যথার্থ দৃষ্টি রাখতে পারেন নি। ‘প্রফুল্ল’ চরিত্রের রূপান্তর বিশ্বাসের সীমা অতিক্রম করে গিয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ঔপন্যাসিক এতে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র-উৎকেন্দ্রিকতার যে-পরিবেশ অঙ্কন করেছেন তা সম্পূর্ণ বাস্তব হয়ে উঠেছে, কিন্তু অনুশীলন তত্ত্বের প্রথম প্রয়োগের দুর্বলতায় উপন্যাসটি এই সকল গুণ থাকা সত্ত্বেও মহৎ হয়ে উঠতে পারেনি। দেবী চৌধুরাণী শেষ পর্যন্ত প্রফুল্লই রয়ে গেছে, শাশ্বত নারীত্বের নিকট তার পরাজয়। এই তত্ত্বমূলক উপন্যাস পর্যায়ের শেষ উপন্যাস ‘সীতারাম’। বঙ্কিম এই উপন্যাসটিতে আশ্চর্য শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। ধর্মতত্ত্বের প্রয়োগ উদ্দেশ্যে গীতার শ্লোকানুসারে তিনি সীতারামের গতি নিয়ন্ত্রিত করেছেন সন্দেহ নেই, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সেই বাধ্যবাধকতা অতিক্রান্ত হয়ে প্রকটিত হয়েছে বাস্তব জীবননিয়তি। সীতারামের রূপমোহ ও তার তীব্রবেগে পতনে যে ট্রাজেডি রূপায়িত হয়েছে তাতে তিনি সুদক্ষ মনস্তত্ত্ববোধের পরিচয় দিয়েছেন। বঙ্কিমের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ প্রতিভা এর পূর্বে এতদূর সিদ্ধ হয় নি। ‘রমা’র বিচার-সভায় বঙ্কিম জনতা-চরিত্র অঙ্কনের যে পর্বতপ্রমাণ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন তা কেবলমাত্র শেকসপিয়র ও ইবসনের সম-চিত্রের অঙ্কন প্রতিভার সঙ্গেই তুল্য। বঙ্কিম একদিক থেকে শেকসপিয়র ও ইবসনের চেয়েও মাহাত্ম্য প্রদর্শন করেছেন। তিনি জনতা চরিত্রের মৌলিক শুভবুদ্ধিতে বিশ্বাসী। কোনও সাহিত্যে এর তুলনা নেই।


‘ইন্দিরা’, ‘রাধারাণী’ এবং ‘যুগলাঙ্গুরীয়’ বঙ্কিমের উপন্যাস লক্ষণাক্রান্ত বড়ো গল্প। ক্ষুদ্র পরিসরেও বঙ্কিম যে কতখানি কৃতিত্ববান তার পরিচয় এই তিনখানি গ্রন্থ। এদের মধ্যে আবার ‘ইন্দিরা’ বঙ্কিমের আশ্চর্য ক্ষমতার পরিচায়ক। ‘ক্ষণিকা’য় রবীন্দ্রনাথের যে পরিচয়, ‘ইন্দিরা’তেও বঙ্কিমের সেই পরিচয় বিধৃত। লঘুচপল খুশী মনের তরঙ্গে বঙ্কিম ‘ইন্দিরা’য় যে-শিল্পীকৌশল প্রদর্শন করেছেন তার তুলনা নেই।

পদ্মিনী উপাখ্যান— রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৫৮)

গ্রন্থের বিষয়বস্তু : মধুসূদনের পূর্বে একটি প্রথম বাংলা সাহিত্যের আখ্যানধর্মী কাব্য। পদ্মিনীর কাহিনি টডের ‘Annals an Antiquities of Rajastahn’ কাহিনি অবলম্বনে রচিত। আলাউদ্দিন কর্তৃক চিতোর আক্রমণ সতীত্ব রক্ষার জন্য পদ্মিনীর প্রাণ বিসর্জনের কাহিনি কে ঐতিহাসিক পরিবেশের মধ্যে বর্ণিত হয়েছে পদ্মিনী উপাখ্যানে। এই কাব্যে ক্ষত্রিয়দের প্রতি রাণা ভীমসিংহের উৎসাহ বাণী স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে জাগিয়ে তুলেছিল। কাব্যে মুসলমান শক্তির বিরুদ্ধে হিন্দু রাজপুতদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য হিন্দু জাতীয়তাবাদের সুর ধ্বনিত হয়েছে যা গুপ্ত কবির যুগে সত্যিই অভিনব বিষয় বলা যেতে পারে পদ্মিনী উপন্যাসে বাংলা কাব্যের জগতে নবদিগন্ত সূচনা করেছে।

গ্রন্থের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ :

  • গ্রন্থটি টডের Annals and Antiquites of Rajasthan অবলম্বনে রচিত। তবে এর কাহিনি পুরোপুরি ঐতিহাসিক নয়।

  • এই গ্রন্থের ঐতিহাসিক পরিবেশ স্বাদেশিকতা, বীর রস ও করুণ রসে রচিত।

  • পদ্মিনী উপখ্যান রাজস্থানের জনপ্রিয় কাহিনি। তবে এই আখ্যান কাব্যের চরিত্রগুলি ও রচনারীতি উল্লেখ যোগ্য নয়।

  • কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরাজি কাব্য ও স্কট, মুর, বায়রন প্রমুখ কবিদের আদর্শে স্বদেশ প্রেম ও ইতিহাসকে অবলম্বন করে গ্রন্থটি রচনা করেন।

  • গ্রন্থটির দ্বারা মাইকেল মধুসূদন দত্ত অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।

  • গ্রন্থটির বাণী মূর্তি প্রাণোজ্বল নয় বলে নবযুগের বার্তাবহ হয়ে উঠতে পারেনি, তবে বীর, রৌদ্র ও করুণরসের স্বচ্ছন্দ প্রকাশে তা স্মরণীয় হয়ে আছে।

রক্তকরবী—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯১৬)

যন্ত্রনির্ভর নগর কেন্দ্রিক সভ্যতায় রাজাও মন্ত্রীরা যেভাবে শোষণ ও শাসন চালাত তাকেই রবীন্দ্রনাথ রক্তকরবী নামক রুপক সাংকেতিক নাটকের মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন। যক্ষপুরীর হারিয়ে ৬৯ ঘ, ৪৭ ক ইত্যাদিতে পরিণত হয়েছে। তারা বসে করে ট, ঠ, ণ পাড়ায়। যক্ষপুরীর রাজার বিরুদ্ধে বিপ্লব এনেছে নন্দিনী, এখানে নন্দিনী বিপ্লবের প্রতীক আর রঞ্জন যৌবনের প্রতীক। এছাড়াও বিশু পাগল কিশোর, ফাগু লাল প্রমুখ চরিত্রগুলি জনসাধারণের রূপকে উপাস্থাপিত হয়েছে। নাটকে রঞ্জনের শরীরী উপস্থিতি আমরা লক্ষ্য করি না। তবে নাটকের শেষে রাজা রঞ্জনকে হত্যা করলেও সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের কাছে পরাজয় স্বীকার করেছে। এর মধ্য দিয়েই নাট্যকার নাটকে শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে বিপ্লবের বিজয় ঘোষণা করেছে।

শ্রেষ্ঠত্বের কারণ :

  • নাট্যকার ‘রক্তকরবী’ নাটকে আধুনিক সমাজ সমস্যার একটি উৎকট দিককে রূপের আবরণে তুলে ধরেছেন।

  • রক্তকরবী নাটকে রবীন্দ্রনাথ যন্ত্রসভ্যতার বিরুদ্ধে কৃষি সভ্যতার হয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

  • নাটকটি অঙ্কদৃশ্য বিরহিত এক নতুন রীতির নাটক।

  • অভূতপূর্ব প্রতীকের ব্যঞ্জনা, সংলাপ সৃষ্টির অভিনবত্ব, নাটকীয়তা ও গীতিরসের মূর্ছনায় রক্তকরবী বাংলা নাট্যসাহিত্যের জগতে এক বিস্ময়কর দৃষ্টি।

  • রক্তকরবী নাটকে নন্দিনী প্রেমের প্রতীক এবং রঞ্জন প্রাণের প্রতীক। প্রেম ও প্রাণের সংযোগে যক্ষপুরীর রাজা তথা শাষকশ্রেণির প্রতীক পরাভূত।

  • রক্তকরবী বিশ্বের যে কোনও শ্রেষ্ঠ নাটকের সমকক্ষ।

অভাগীর স্বর্গ—শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

বিত্তবাণ ঠাকুর দাস মুখুয্যের গৃহিণীর মৃত্যু হলে গুরুড় নদীর তীরের শ্মশানে চন্দন কাঠের চিতায় তাঁকে দাহ করা হয়। চিরদুঃখী অভাগী তা দেখে ভেবেছিল ভাগ্যবতী বামুনমা ছেলের হাতে আগুন পেয়ে স্বর্গবাসী হল। অভাগীরও মনে বাসনা হল যে সে যেন এমনি ভাবে স্বর্গে যেতে পারে। জন্মলগ্নে যাকে হারিয়ে ছিল বলে বাপ নাম রেখেছিল অভাগী। অভাগীর বিয়ে হয়েছিল রসিক বাগের সঙ্গে। কাঙ্গালীর জন্মের পর রসিক বাগ অন্য একজনের সঙ্গে ভিন গাঁয়ে ঘর বাঁধল। কাঙ্গালীকে নিয়ে দুঃখে দিন কাটলেও তার আশা ছিল ছেলের হাতের আগুন তাকে যন্ত্রণাদগ্ধ জীবন থেকে মুক্তি দিয়ে স্বর্গবাসী করবে। অভাগীর শেষ ইচ্ছা পূরণ হয়নি তার মৃত্যুর পর সমাজের চাপে কাঙ্গালী তার মুখে নুড়ো জ্বেলে নদীর চড়ায় মাটির নীচে সমাধিস্থ করেছিল।

শ্রেষ্ঠত্বের কারণ :

  • ব্রাহ্মণ শাষিত সমাজ ব্যবস্থার মর্মান্তিক চিত্রকে গল্পে শরৎচন্দ্র তুলে ধরেছেন।

  • জনদরদী লেখকে শরৎচন্দ্র গল্পে ব্যঙ্গের বানে তৎকালিন সমাজপতিদের বিদ্ধ করেছেন।

  • ‘অভাগীর স্বর্গ একটি হতভাগিনী নারীর স্বর্গ কামনার ব্যর্থতার কাহিনি।

  • গল্পের মধ্যে শরৎচন্দ্র গ্রামীণ আঞ্চলিক জীবনের প্রতিছবিকে সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন।

  • গল্পের নামকরণ বিষয়ানুগ, তাৎপর্যপূর্ণ ও শিল্প সার্থক হয়ে উঠেছে।

কমলাকান্তের দপ্তর–বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৫)

কমলাকান্ত নামক এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ নসীরাম বাবুর কাছ থেকে আফিং সেবন করে যত্রতত্র ভ্রমণে জীবন সম্পর্কে যে অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করেছিলেন সেগুলি প্রবন্ধ আকারে স্থান লাভ করেছে কমলাকান্তের দপ্তর নামক গ্রন্থে। কমলা কান্তের দপ্তর বাংলা সাহিত্যে নতুন ধরনের সৃষ্টি। কমলাকান্তের দপ্তর প্রবন্ধের অন্তর্গত ‘একটি গীত ‘বিড়াল’, ‘একা’, ‘বড়বাজার’, ‘আমার দুর্গোৎসব’ প্রভৃতি প্রবন্ধগুলিতে বঙ্গিমচন্দ্রের স্বদেশ ও সমাজ চেতনার বিশিষ্ট মননশীলতা প্রকাশ পেয়েছে। ‘বিড়াল’ প্রবন্ধে তিনি হাসির ছলে এক নায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে সাম্যবাদকে অভিনব রূপে প্রকাশ করেছেন। সমাজ স্বদেশ সাহিত্য সংস্কার ইত্যাদি বিষয়গুলি প্রবন্ধ গ্রন্থের মূল লক্ষ্য হলেও আসলে মানুষ কীভাবে সুখী হতে পারে তাই আলোচনা করেছেন বঙ্কিমচন্দ্র।

শ্রেষ্ঠত্বের কারণঃ

  • কমলাকান্তের দপ্তর একটি মননশীল হাস্যরসাত্মর প্রবন্ধ গ্রন্থ।

  • কমলাকান্ত চরিত্রটি কাল্পনিক। আসলে বঙ্কিমচন্দ্ৰ কমলকাত্তের ছদ্মবেশে বাঙালি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন।

  • ইংরেজ সাহিত্যিক ডিকুইন্সের ‘কনফেশনস অফ অ্যান ইংলিশ ওপিয়াম ইটার’ গ্রন্থের অনুসরণে বঙ্কিমচন্দ্র ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্রন্থটি রচনা করেন।

  • গ্রন্থটি বঙ্কিমচন্দ্র রসিকতার ভঙ্গিতে সমাজের নানা দুর্নীতিকে তুলে ধরে তার উপর ব্যঙ্গের কষাঘাত হেনেছেন।

  • বিড়াল প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র হাসির ছলে একনায়কতন্ত্রের প্রতিবাদে সাম্যবাদকে প্রতিষ্ঠা করেছেন।

জনা—গিরিশচন্দ্র ঘোষ (১৮৯৪)

জনা গিরীশচন্দ্র ঘোষের একটি সার্থক পৌরাণিক নাটক’ জনা নাটকের কাহিনি পরিকল্পনায় নাট্যকার ভারতীয় পুরাণকে অনুসরণ করেছেন। কাহিনিতে দেখা যায় রাজা নীলধ্বজের পুত্র প্রবীর অর্জুনের যজ্ঞের অশ্ব ধরে রাখায় পাণ্ডব পক্ষের সঙ্গে যুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, অর্জুন সারথী কৃষ্মের একনিষ্ট ভক্ত নীলধ্বজ এই যুদ্ধে সম্মত নয় কারণ তিনি কৃষ্ণের সেবক কিন্তু রানী জনা নীলধ্বজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে পুত্র প্রবীরকে যুদ্ধে উৎসাহ দিয়েছেন যদিও বিদুষক নীলধ্বজের ইচ্ছানুযাই যজ্ঞের ঘোড়া গোপনে মুক্ত করে দিয়েছেন কিন্তু তবুও যুদ্ধকে বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। যুদ্ধে প্রবীর পরাস্ত ও নিহত হলে জনা চরিত্রের ট্র্যাজিক রূপ লক্ষ্য করা যায়। নাট্যকের শেষে দেখিয়েছেন স্বর্গগত নীলধ্বজা জনা, প্রবীর সকলেই কৃষ্ণানুসারি হয়েছেন।

শ্রেষ্ঠত্বের কারণ :

  • জনা নাটকে দু প্রকার রসের মিশ্রণ ঘটেছে। একদিকে মানুষের জীবনে দৈবশক্তির লীলা তথা ভক্তিরস, অন্যদিকে পার্থিব জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে মানবরস।

  • নাটকে জনার মাতৃত্ব স্বদেশ হিতৈষতা। তেজস্বিতা এর সর্বপরি তার জীবনের কর ট্র্যাজেডি এই নাটকের মুখ্যবিষয়।

  • অলৌকিক ভক্তিরসের প্রাবল্য জনা নাটকের ট্র্যাজেডি-কে ক্ষুণ্ণ করেছে।

  • জনা নাটকে কৃষ্ণভক্ত বিদূষক চরিত্রটি লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছে।

  • জনা ও প্রবীর চরিত্রকে কেন্দ্র করে নাটকে নাট্যদ্বন্দ্ব চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে

  • কাহিনি নির্মাণ, চরিত্র সৃষ্টি, সংলাপ রচনা সর্বপরি ছন্দ নির্মাণের মধ্য দিয়ে গিরিশচন্দ্র ‘জনা’-কে সার্থক পৌরাণিক নাটক হিসাবে গড়ে তুলেছেন।

সারদামঙ্গল—বিহারী লাল চক্রবর্তী

নিবিড় প্রেমানুভব ও তীক্ষ্ণ সৌন্দর্যচেতনা-এই যুগ্ম প্রেরণা কাব্যখানি রচনার মূলে সক্রিয় রয়েছে। এই কাব্যে কবি তাঁর অন্তরবাসিনী প্রেয়সী কাব্যলক্ষ্মী ‘আনন্দরূপিনী মানস প্রতিমাকে বিশ্বব্যাপ্ত সৌন্দর্যের শতদলের ওপরে দাঁড় করিয়ে এক অভুতপূর্ব রাগিনীতে সুখ-দুঃখ, বিরহ মিলনের শ্লোক, কবি যে এই কাব্যে সরস্বতীর বন্দন করেছেন। তিনি নানা আকারে, নানাভাবে নানা লোকের কাছে উদিত হন। তিনি কখনো জননী, কখনো প্রেয়সী, কখনো কন্যা। তিনি সৌন্দর্যরূপে জগতের অভ্যন্তরে বিরাজ করেছেন এবং দয়া স্নেহ প্রেমে মানবের চিত্তকে অহরহ বিচলিত করেছেন। প্রকৃতি জুড়ে যে খণ্ড খণ্ড বস্তুর সমারোহ তা আসলে সব সৌন্দর্যের প্রতিফলন। বিশ্বসৃষ্টির রহস্য কবি ভেদ করতে চেয়েছেন সারদার কল্পনার মধ্য দিয়ে। এই সারদাকে পাওয়ার জন্য কবির কণ্ঠে কি গভীর আকুতিই না প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু কবি সারদার রহস্য শেষ পর্যন্ত ভেদ করতে পারেনিনি—

“ধেয়াই কাহারে আমি

নিজে তাহা জানি না।”

গ্রন্থের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ :

  • প্রকৃত পক্ষে সারদামঙ্গল একটি সম্পূর্ণ কাব্য নয়। তা কতকগুলি খণ্ডকবিতার সমষ্টিরূপ।

  • বিহারীলাল যে আধুনিক গীতিকাব্যের সচেতন কবি তার পরিচয় সারদা মঙ্গলে রয়েছে।

  • এই কাব্যের দেবী সারদা শেলীর নারচরিত্রের সমগোত্রীয়।

  • সারদামঙ্গল কাব্যে কবি বিহারীলালের রোমান্টিক ও মিষ্টি চেতনার প্রকাশ রয়েছে।

  • এই কাব্যে কবি মৈত্রী বিরহ, প্রীতি বিরহ ও সরস্বতী বিরহের উল্লেখ করেছেন।

  • সারদা মঙ্গলের ভাষা কবি কল্পনার বেশ উপযুক্ত। তবে তিনি যতবড় ভাবুক ছিলেন তত বড়ো কবি ছিলেন না।

ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়—অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮৭০)

‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ নামক প্রবন্ধে গ্রন্থটি অক্ষয়কুমার দত্তের শ্রেষ্ঠকীর্তি গ্রন্থটি দুটি খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ডটি প্রকাশিত হয় ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে এবং দ্বিতীয় খণ্ডটি প্রকাশিত হয় ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে। গ্রন্থটি রচনার উৎস হল হোরেস হেম্যান উইলসেনর “The Religious sects of the Hindoos। এছাড়া ডেভিড হেয়ার সাহেবের নাম স্মরণাক্ষ তৃতীয় সাম্বৎসারিক পাণ্ডিত্যের নিদর্শন হয়ে উঠেছে। এর প্রথম খণ্ডে রয়েছে শব্দবিদ্যা ও তুলনামূলক ভাষা বিজ্ঞান এবং দ্বিতীয় খণ্ডে রয়েছে প্রাচীন ভারতীয় ধর্ম দর্শন সাহিত্য।

শ্রেষ্ঠত্বের কারণ :

  • অক্ষয় কুমারের প্রবন্ধগুলির বিষয় মৌলিক নয় হয়ত জর্জ কুম্ব, হেমযান প্রমুখ রচয়িতাদের গ্রন্থ থেকে বিষয় সংগ্রহ করেছেন কিন্তু তাঁর প্রবন্ধগুলি হুবহু অনুকরণ নয়।

  • ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় রচনাটি প্রাপ্ত বয়স্ক পাঠকদের উদ্দেশ্যেই রচিত।

  • গ্রন্থটিতে প্রাবন্ধিকের অভিজ্ঞতার সঙ্গে বুদ্ধির বিশ্লেষণের সঙ্গে প্রজ্ঞার আশ্চার্য সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়।

  • গ্রন্থে শব্দ তত্ত্ব, ভাষাবিদ্যা থেকে শুরু করে ধর্মতত্ত্ব ও সাহিত্য পর্যন্ত বিস্তৃত বিষয়কে পাঠকের উপযোগী করে তুলে ধরেছেন অক্ষয় কুমার দত্ত।

চোখের বালি—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯০৯)

‘চোখের বালি’ উপন্যাসটি রবীন্দ্রনাথের একটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। এই উপন্যাসের কাহিনিতে তিনটি আখ্যান আছে। মহেন্দ্র বিনোদিনী, বিহারী বিনোদিনী ও বিহারী আশা প্রসঙ্গে। এদের মধ্যে প্রথম দুটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বিনোদিনীর প্রেম মহেন্দ্রর অভিমান ও অসংযম, বিহারীর চিত্র গভীরতা ইত্যাদিকে লেখক নিখুঁতভাবে তুলে ধরে মনের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার উপর তাঁর কাহিনিকে দাঁড় করিয়েছে। ঘটনার অন্তনির্হিত তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে তিনি কাহিনিকে বাস্তব করে তুলেছেন। এই উপন্যাসের মহেন্দ্র, আশা, বিহারী ও বিনোদিনী এই চারটি চরিত্রের টানাপোড়েন এ ‘চোখের বালি’ উপন্যাসটি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।

শ্রেষ্ঠত্বের কারণ :

  • ‘চোখের বালি’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ ‘আঁতের কথা’ কে টেনে বের করে প্রথম মনোবিশ্লেষণের নতুন রীতি প্রকাশ করলেন।

  • সমাজের সংস্কারের সঙ্গে ব্যক্তিজীবনের বিরোধ চোখের বালির বিশেষত্ব।

  • ‘কৃষ্মকান্তের উইল’-এর পর বাংলা মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের পালাবদল ঘটল চোখের বালি উপন্যাসে।

  • উপন্যাসের বিনোদিনী, বিহারী, মহেন্দ্র ও আশা চরিত্রের মধ্যদিয়েই কাহিনি দ্বন্দ্ব ফুটে উঠেছে।

  • রবীন্দ্রনাথের রাজর্ষী উপন্যাসের ১৬ বৎসর পর বাংলা সাহিত্যের যুগান্তকারী উপন্যাস ‘চোখের বালি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।

  • বিধবা সমস্যা তৎকালিন সমাজ জীবনে কি বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল তা ঘটনার প্রতিরূপে ঔপন্যাসিক আকর্ষণীয় করেন।

ছাড়পত্র—সুকান্ত ভট্টাচার্য (১৩৪৭)

‘ছাড়পত্র’ কাব্যের কবিতাগুলির বিষয় সাধারণ তুচ্ছ উপকরণে গড়া। তবে তারই মধ্যে রয়েছে বিপ্লব চেতনার বীজ। যেমন ‘চারাগাছ’, ‘সিঁড়ি’, ‘কলম’, ‘সিগারেট’, ‘দেশলাই কাঠি’, ইত্যাদি। ‘চারাগাছ’ কবিতাটিতে কবি সুকান্ত বিদ্রহের সংকেত দিয়েছেন এইভাবে—

“তাইতো অবাক আমি, দেখি যত অশ্বত্থ চারায়

গোপনে বিদ্রহ জমে, জমে দেহে শক্তির বারুদ;

আবার ‘দেশলাই কবি’ কবিতায় কবি শাসক শ্রেণির উদ্দেশ্যে হুঁসিয়ারী দিয়ে বলেছেন—

“আমরা বন্দি থাকব না তোমাদের পকেটে পকেটে,

আমরা বেরিয়ে পড়ব, আমরা ছড়িয়ে পড়ব

শহরে, গঞ্জে, গ্রামে-দিগন্ত থেকে দিগন্তে।

শ্রেষ্ঠত্বের কারণ :

  • ছাড়পত্র কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের প্রথম কাব্যগ্রন্থ।

  • সুকান্ত ভট্টাচার্যের শ্রেষ্ঠ কবিতার সংকলন হল ছাড়পত্র।

  • একদিকে মৃত্যুকীর্ণ যুদ্ধ এবং দুর্ভিক্ষ, বন্যা ও মহামারী—অন্যদিকে নতুন জীবন প্রতিষ্ঠার জন্য মৃত্যুপণ সংগ্রাম ‘ছাড়পত্রে’র কবিতাগুলির বিষয় হয়ে উঠেছে।

  • রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলামের মতো কবি সুকান্তও তাঁর “ছাড়পত্র” কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘আঠারো বছর বয়স’ কবিতায় যৌবন শক্তির জয়গান করেছেন।

  • গদ্য ছন্দে গঠিত ছাড়পত্র কাব্য গ্রন্থের কবিতাগুলি কবি আধুনিক শব্দ প্রয়োগ ও অলঙ্কার সজ্জার মধ্য দিয়ে সার্থক কাব্যরূপ দান করেছেন।

প্রাচীন সাহিত্য—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯১০)

রবীন্দ্রনাথ কিংবদন্তী সাহিত্যিক। সাহিত্য স্রষ্টা হিসাবে তাঁর চিন্তা ও ধ্যান ধারণার বিশিষ্ট্য পরিচয় মেলে সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধগুলিতে। ‘প্রাচীন সাহিত্য’ প্রবন্ধ গ্রন্থটি এ জাতীয় একটি গ্রন্থ । গ্রন্থটিতে রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন ও আধুনিক, ভারতীয় ও বিদেশি, সাহিত্যবস্তু ও সাহিত্যতত্ত্ব ইত্যাদি সাহিত্য সংক্রাস্ত অনেক বিষয় আলোচনা করেছেন। যুক্তি বিশ্লেষণ ও সামগ্রিক দৃষ্টি সর্বপরি সৌন্দর্য রসরসিকতা রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যচিন্তার লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। প্রাচীন সাহিত্য আলোচনায় সে যুগের ভাব ও পরিবেশ কল্পনা বলে একেবারে নতুন হয়ে উঠেছে। যুক্তি বাস্তবতা ও বিচার বিশ্লেষণ অপেক্ষা রসসৃষ্টির মৌলিক ও শিল্পসৌকর্যের মাপকাঠিতে সাহিত্যের স্বরূপ নির্ধারণ করেছেন।

প্রফুল্ল—গিরিশচন্দ্র ঘোষ (১৮৮৯)

নাটকের কাহিনিতে দেখা যায় বড়দাদা যোগেশ আদর্শবাণ। সৎ চরিত্র, কঠোর পরিশ্রম চেষ্টার দ্বারা ধীরে ধীরে সংসারে উন্নতি করেছে। সংসারে তার স্ত্রী, পুত্র, মা ছাড়া রয়েছে দুই ভাই রমেশ ও সুরেশ। সুরেশ ছোটো লেখাপড়া করে কিন্তু রমেশ ওকালতি করে। সে লোভী, সার্থপর চক্রান্তকারী, তারই ষড়যন্ত্রে যোগেশের ব্যাঙ্ক ফেলে হলে, যোগেশ সর্বশান্ত হয়। দেনার দায়ে যোগেশ মদ্যাসাক্ত হয়ে যায়। যোগেশের সাজানো বাগান রমেশের চক্রান্তেই শেষ পর্যন্ত শুকিয়ে যায়। এ নাটকের করুণ রসাত্মক ট্রাজিক পরিণতি দর্শক চিত্তে Pity ও fear সৃষ্টি করেছে।

শ্রেষ্ঠত্বের কারণ :

  • একান্নবর্তী একটি বাঙালি পরিবারের শোচনীয় বিপর্যয়ের কাহিনিই এ নাটকের মূল কাহিনি৷ সেই সূত্রে এটিকে পারিবারিক নাটক বলা যেতে পারে।

  • নাটকের ট্রাজেডি মূলত যোগেশ চরিত্রকে কেন্দ্র করে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে

  • অতি নাটকিয়তা প্রফুল্ল নাটকের ট্রাজিক রসকে কিছুটা ক্ষুণ্ণ করেছে বলা যেতে পারে৷

  • যোগেশ, প্রফুল্ল প্রমুখ আদর্শ চরিত্রগুলিও বেশ জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

  • সর্বপরি কাহিনি নির্মাণে, চরিত্র সৃষ্টিতে এবং সংলাপ রচনায় নাট্যকার বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।