উপন্যাস
পুতুল নাচের ইতিকথা (১৯৩৬)
গ্রন্থকার : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
গ্রন্থরূপ : মনস্তত্ত্বমূলক সামাজিক উপন্যাস।
বিষয় : অদৃশ্য সুতোর টানে অধীন পুতুলের মতই নিয়তি শাসিত মানুষের ইতিকথা এর উপজীব্য বিষয়। গাওদিয়া গ্রামের শশী ডাক্তার নিছক মজা করবার জন্যই শ্রীনাথ মুদির ফেলে দেওয়া পুতুলটা বকুল গাছের গোড়ায় ঠাকুরের মতো সাজিয়ে রেখে ছিল। সকাল বেলায় যামিনী কবিরাজের বৌ এসে সেটা নিয়ে গিয়েছিল শশীকে দেখাবার জন্য। ‘সূর্যবিজ্ঞান সিদ্ধ’ ‘অলৌকিক শক্তি সম্পন্ন’ যাদব পণ্ডিত সস্ত্রীক আফিম খেয়ে ইচ্ছা মৃত্যু ডেকে আনে। অলৌকিতার মোহে সে নিজেই এভাবে এক পুতুলে পরিণত হয়। বন্ধু পত্নী কুসুমের সঙ্গে শশীর এক অবৈধ রোমান্স গড়ে ওঠে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা পূর্ণতা পায় না। অ্যালোপাথি চিকিৎসায় বিরূপ মৃত যাদব পণ্ডিত এর ইচ্ছানুসারে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা হয়। শশী ডাক্তারের পিতা গোপাল দাস সারা জীবন অসৎ কর্ম করেও শেষে বৃদ্ধ বয়সে গ্রামের মায়া কাটিয়ে অন্যত্র চলে যায়। গোপালের জামাতা নন্দলাল বিন্দুর সঙ্গে জোর করে বিয়ে দেওয়ার প্রতিশোধে প্রথমে তাকে রক্ষিতা বানায়, অথচ ভ্রষ্টাচারী নন্দর মধ্যে দেখা দেয় স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা এবং মানবিকতা। অনুরূপ ভাবে উপন্যাসের নায়ক শশী যে এক স্ত্রীলোককে দিয়ে পুতুলকে ভগবান বানিয়ে মজা দেখতে চেয়েছিল, জীবনের পাত্রে ধরতে চেয়েছিল জগতের সাগরতরঙ্গ, দশচক্রে সে নিজেই পুতুল হয়ে গেল । গ্রাম্য বধূ কুসুম যাদব পণ্ডিতের মহাপুরুষত্ব দেখার কৌতুক আর লম্পট পিতৃদেবের অদ্ভুত আচরণ তার জীবনটাকে ‘গেঁয়ো পুকুরের ঢেউ’ এর মধ্যে আটকে রাখলো। এই ভাবে দেখা গেছে প্রায় প্রতিটি চরিত্র তার স্বভাবের বিপরীত আচরণ করে তাদের সম্পর্কে প্রচলিত ধারণার পরিবর্তন ঘটিয়েছে।
কেন উল্লেখযোগ্য :
১। আকাঙ্ক্ষা ও রূপায়ণের বৈপরীত্য মানুষকে কীভাবে পুতুল রূপে দেখায়, এই উপন্যাসে সেই ভাবটি এক প্রতীকি ব্যঞ্জনায় মূর্ত হয়েছে “নদীর মতো নিজের খুশীতে গড়া পথে কি মানুষের জীবনের স্রোত বহিতে পারে? মানুষের হাতে কাটাখালে তার গতি এক অজানা শক্তির অনিবার্য ইঙ্গিতে।” লক্ষ্য করা যায়, গ্রীক নিয়তিবাদ বা ভারতীয় অদৃষ্ট তত্ত্বের প্রচলিত ক্লাসিক্যাল ধারণার অনুবর্তন নয়, বৈজ্ঞানিকের কেনধর্মী জীবন জিজ্ঞাসায় আলোড়িত হয়েই মানুষের চিন্তা ও আচরণের অসঙ্গতিকে প্রকাশ করা হয়েছে।
২। বাস্তববাদের মধ্যে অবগাহনের পূর্বে শিল্পী মানিকের রোমান্টিক ভাব-কল্পনার একটি ধারা এই উপন্যাসে আত্মপ্রকাশ করেছে। সেই অর্থে এই উপন্যাস মানিকের রোমান্টিক মানসের এক মূল্যবান অভিজ্ঞান।
৩। শশী ডাক্তারের চরিত্র চিত্রণের মধ্য দিয়ে মধ্যবিত্তের “ভাববাদের চোরা গলি” হতে আনাগোনার পরিচয়টি ধরা পড়েছে, এই মোহ থেকে মুক্তির অন্বেষণ করেছে তাঁর পরবর্তী উপন্যাসের নায়কেরা।
গণদেবতা (১৯৪২)
গ্রন্থকার : তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
গ্রন্থরূপ : আঞ্চলিক উপন্যাস।
বিষয় : ক্ষয়িষ্ণু সামস্ত তান্ত্রিক ব্যবস্থার ফলে আধুনিক কলকারখানার প্রসার এবং তার ফলে চণ্ডীমণ্ডপের বিধি নিষেধ বা সনাতন নিয়ম নীতি লঙ্ঘন—এই ভাবটি উপন্যাসটির মূল বক্তব্য বিষয়। কাশীপুর গ্রামের কামার অনিরুদ্ধ এবং ছুতোর গিরিশ পুরনো নিয়ম ভেঙে গ্রাম ছেড়ে শহরের বাজারে এসে দোকান ফেঁদে বসে। এত দিন ধরে পেয়ে আসা সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে ভেবে গ্রামের মানুষ অসন্তুষ্ট হয়। প্রতিবিধানের আশায় গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপে সভা ডাকা হয়। উঠতি ধনী শ্রীহরি পাল বা ছিরু পাল জোট পাকায়। ফলে ছিরুর সঙ্গে অনিরুদ্ধের সংঘর্ষ বাধে। ছিরু অপমানিত হয়। পরদিন ভোরে জানা যায়, অনিরুদ্ধের জমির ফসল রাতে কারা কেটে নিয়ে গেছে। অনিরুদ্ধ সব বোঝে কিন্তু ছিরুর প্রভাব প্রতিপত্তির ভয়ে কিছু করতে না পেরে হতাশায় মদ্যপান ধরে এবং জৈব প্রবৃত্তির কাছে আত্ম সমর্পণ করে। চণ্ডীমণ্ডপ পাঠশালার পণ্ডিত, গ্রামের সকল ভাল কাজের অংশী ও সংগী দেবনাথ ঘোষ পরম বেদনায় অনুভব করে চণ্ডীমণ্ডপের শাসন নীতির অচল অবস্থা। এখন ছিরুপালদের মতো সুযোগ সন্ধানী ব্যক্তিদের ক্ষমতাই প্রবল। এক সময় মড়কে গ্রাম উজাড় হয়ে যায়, দেবুর পরিবার ধ্বংস হয়। নিঃসঙ্গ বিষণ্ণ দেবু উপলব্ধি করে প্রাচীন গ্রামীণ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার সঙ্গে নতুন প্রজন্মের উদ্ভবের সত্যরূপ।
কেন উল্লেখযোগ্য :
১। চণ্ডীমণ্ডপের শাসন নীতির প্রাধান্য ও অবসানের মধ্য দিয়ে গ্রামের লোক মানস তথা গণদেবতার প্রাচীন গৌরব ও অবক্ষয়ের বর্তমান রূপটি দেখানো হয়েছে। কৃষি নির্ভর গ্রাম বাংলার প্রাত্যহিক জীবনের রীতি নীতি, সম্বৎসরের লোকাচার, পূজা, পালা, ব্রত পার্বণের চিত্র, ইতুপূজা, ঘণ্টাকর্ণের পূজা, গাজনের উৎসব ইত্যাদি সব কিছুই উপস্থিত যেমন “চৈত্রমাসের ঘণ্টাকর্ণের পূজা।…ঘণ্টাকর্ণের পূজা করে বাংলার নিম্নজাতীয়েরা। সমস্ত মাস ধরিয়া ঘেঁটুর গান গাহিয়া বাড়ি বাড়ি ঘুরিয়া বেড়ায়। চাল-ডাল সিধা মাগিয়া মাসান্তে গাজনের সময় উৎসব করে।”
২। ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর আধুনিক কল-কারখানার প্রসারের প্রভাব এবং নয়া অর্থনীতির প্রভাবে মানুষের জীবন যাত্রার পরিবর্তনের দিকটি ইঙ্গিতে লক্ষিত হয়। সমাজবিজ্ঞানী এবং অর্থনীতিবিদের কাছে এই উপন্যাস কৌতূহল জাগাতে পারে।
৩। বীরভূমের রাঢ় অঞ্চলের লোকায়ত জীবনের সার্থক প্রতিফলনে উপন্যাসটি আঞ্চলিক উপন্যাস রূপে খ্যাতি অর্জন করেছে।
শেষের কবিতা (১৯২৯)
গ্রন্থকার : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
গ্রন্থরূপ : কাব্যোপন্যাস বলা যেতে পারে এই গ্রন্থটিকে।
বিষয় : শেষের কবিতা রচিত হয় যোগযোগ উপন্যাসের সমকালে। অথচ আঙ্গিক, ভাষারীতি, বিষয়বস্তু, জীবন ভাবনা—সবক্ষেত্রেই উভয়ের মধ্যে দুস্তর পার্থক্য। এক নতুন ধরনের রোমান্স বাংলা সাহিত্যে এ জাতীয় আখ্যায়িকা এর আগে কখনো লেখা হয়নি, রবীন্দ্র সাহিত্যেও আর দ্বিতীয়টি নেই। এই উপন্যাসের প্রেমানুভূতির তত্ত্ব উপস্থাপনই হয়ত কবির লক্ষ্য ছিল, কিন্তু অমিত ও লাবণ্যের প্রণয় কাহিনি অনন্য সাধারণ। অমিত চরিত্রের যে একটা সদা চঞ্চল, প্রথা বন্ধন মুক্ত, বিচিত্র লীলায়িত প্রাণ হিল্লোল আছে, তা তার সমস্ত চিন্তাধারা ও কর্মপ্রচেষ্টাকে এখন একটা নৃত্যশীল গতিবেগ দিয়েছে, যা আমাদের সাধারণ জীবন যাত্রার সম্পূর্ণ বিপরীত। মানুষের এই প্রথাবদ্ধ জীবনের যান্ত্রিক প্রেমের মধ্যে যেন এক বিচিত্র অননুভূতপূর্ব ছন্দের নূপুর নিক্কণ । শেষের কবিতায় এই রোমান্টিক প্রেম একটি অনন্য সাধারণ পুরুষ ও নারীর ব্যবহারিক জীবনে প্রতিফলিত ও প্রত্যক্ষগোচর হয়ে বাস্তব জগতে রূপ ও স্পষ্টতা লাভ করেছে। অমিত লাবণ্যের ট্রাজেডি যতটা তত্ত্ব ভাবনার ফল ততটা স্বাভাবিক কিনা এ প্রশ্ন সঙ্গতভাবে উঠতে পারে। অপূর্ব একটি প্রেমকাহিনি লেখা হলেও, এই প্রেমের জগৎটি বাস্তব সম্পর্ক বিরহিত, নায়ক নায়িকারা সকলেই যেন মায়া জড়ানো এক অপরূপ রূপ কথার জগতের অধিবাসী। তাদের হাস্যে লাস্যে বন্ধনভার মুক্ত প্রাণের গানে ‘শেষের কবিতা’ মুখর হয়ে উঠেছে। এই যৌবনের কাব্যখানিতে লিরিকের অশ্রাস্ত কলধ্বনি শোনা যায়, মুহুর্মুহু শাণিত কথার উল্কা বৃষ্টি হয়।
কেন উল্লেখযোগ্য :
বাংলা গদ্যের আশ্চর্য প্রকাশ শক্তি, গতি ও দীপ্তির বিকাশ ঘটেছে ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে। কাব্যরস প্রচুর আছে কিন্তু খাঁটি উপন্যাস-রসের সন্ধান করতে গেলে পাঠক বিফল হবেন।
গোরা (১৯১০ খ্রীঃ)
গ্রন্থকার : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
গ্রন্থরূপ : স্বদেশ ভাবনামূলক এপিক উপন্যাস।
বিষয় : উনিশ শতকের শেষ দশকে বাংলা দেশ তথা শহর কলকাতা এর পটভূমি। সমকালীন সমাজ জীবনের সমস্যাকে ব্যক্তি-দেশ-ধর্ম-জাতি ও রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত করে এখানে দেখানো হয়েছে, একদিকে ভারতীয় সংস্কৃতির ঔদার্য, অন্যদিকে ধর্মীয় সংস্কারের অনুদারতা। এর ঘটনা মূলত বৈচিত্রময়। উপন্যাসের নায়ক গোরা কৃষ্ণদয়াল বাবুর পুত্র রূপে পরিচিত হলেও আসলে তিনি আইরিশ সন্তান। মিউটিনির সময় তাঁর জন্ম, এ তথ্য গোরার অজানা ছিল। দেহে মনে অসাধারণ বলিষ্ঠ, পৌরুষের মূর্ত রূপ গোরা ঘোষণা করত—ভারতবর্ষ তার দেশ, হিন্দুর আচার আচরণ নিষ্ঠাভরে পালন করাই দেশহিতৈষিতা। উগ্রজাতীয়তা বোধের বহিঃপ্রকাশ তার প্রথম জীবনে লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু আত্মপরিচয় জানার পর, হিন্দু শাসিত পরিবারে বিদ্রোহী ফরু সর্দারের ছেলে তমিজকে সন্তানবৎ লালন পালনের দৃশ্য দেখে, সুচরিতা ও পরেশ বাবুর সংস্পর্শে এসে, গোরার মানসিক রূপান্তর ঘটে। সে উপলব্ধি করে ভারতীয় ধর্ম ও সমাজের সত্যরূপ। এই উপন্যাসে হিন্দু ব্রাষ্মের ধর্মীয় মতাদর্শ নিয়ে বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে যেমন গোরা-বিনয়, গোরা-পানুবাবু ইত্যাদির বিতর্ক দেখা গেছে। তবু মতাদর্শের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে চরিত্র গুলির মানবিক পরিচয়টি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আনন্দময়ী, সুচরিতা, পরেশবাবু, বিনয় ললিতা প্রভৃতি চরিত্রগুলি চিরস্মরণীয় হতে পেরেছে।
কেন উল্লেখযোগ্য :
১। ভারতবর্ষের মতো বৃহত্তর দেশ ও জাতির ধর্ম ও জাতপাত, শিক্ষিত বাঙালির মধ্যে ইংরেজ শাসনের ফলে অসন্তোষ ও সমালোচনা, গ্রামাঞ্চলে নায়েব জমিদারদের অত্যাচারে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে আপামর দরিদ্র প্রজাদের মধ্যে প্রতিবাদ-প্রবণতা, পৌত্তলিকতার সমর্থন ও বিরোধিতায় হিন্দু ও ব্রাম্মদের মধ্যে বিতর্ক ইত্যাদি বহুবিধ সমস্যার ঐহিক পরিচয় এখানে মহাকাব্যের মতো এক সুবিস্তৃত পরিসরে ব্যক্ত হয়েছে।
২। রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ চেতনা ও ভারত ভাবনার সম্মিলিত প্রকাশ ঘটেছে উপন্যাসের শেষে গোরার উপলব্ধির মধ্যে “আপনি আমাকে আজ সেই দেবতারই মন্ত্র দিন, যিনি হিন্দু মুসলমান খ্রীষ্টান ব্রায় সকলেরই যাঁর মন্দিরের দ্বার কোনও জাতির কাছে, কোনও ব্যক্তির কাছে, কোনও দিন অবরুদ্ধ না হয়—যিনি কেবল হিন্দুর দেবতা নন, যিনি ভারতবর্ষের দেবতা।”
৩। বাংলা সাহিত্যে স্বদেশ প্রেমের প্রকাশে গোরা তাঁর নিজস্ব বিশ্বাস ও দেশের মানুষের প্রতি অকৃত্রিম মমতায় ব্যক্ত করেছে এ স্বতন্ত্র আবেগ “জাহাজের কাপ্তেন যখন সমুদ্র পাড়ি দেয় তখন যেমন আহারে বিহারে কাজে বিশ্রামে সমুদ্র পাড়ের বন্দরটিকে সে মনের মধ্যে রেখে দেয় আমার ভারতবর্ষকে আমি তেমনি মনে করে রেখেছি।”— এ বক্তব্য নয় স্বদেশী নেতাদের ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নামে প্রীতিবাদ প্রদর্শন বা মানুষকে অনর্থক মাতিয়ে তোলার প্রচেষ্টা।
৪। রবীন্দ্র উপন্যাস তথা বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে বন্ধু অথচ বিপরীত স্বভাবী দুই পুরুষ-চরিত্রের সৃষ্টি ; যেমন—গোরা ও বিনয়। পরবর্তীকালে এরই অনুবর্তনে ‘ঘরে বাইরে’ তে নিখিলেশ ও সন্দীপ, ‘শেষের কবিতা’য় অমিত শোভনলাল, ‘চতুরঙ্গে’ শ্রীবিলাস শচীশ, এবং শরৎ সাহিত্যে ‘গৃহদাহে’ মহিম-সুরেশ চরিত্র পরিকল্পনা করা হয়েছে।
আরণ্যক (১৯৩৮)
গ্রন্থকার : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
গ্রন্থরূপ : নিসর্গ প্রধান উপন্যাস।
বিষয়ঃ সত্যচরণ নামে সুশিক্ষিত সহৃদয় ভদ্রসন্তান ইস্কুল মাস্টারীর চাকরী খুইয়ে কলকাতায় আসে। তার ধনী জমিদার বন্ধু উত্তর বাংলা আর বিহারের সীমানায় গঙ্গার ধারে তাদের জঙ্গল মহলের জমি ভূমিহীন চাষীশ্রেণি ও অন্যান্য লোকেদের মধ্যে বিলি ব্যবস্থার জন্য ম্যানেজার পদে তাকে নিযুক্ত করে পাঠায়। বন জঙ্গল কেটে মানুষের বসতি বা গ্রাম বসাবার কাজ শুরু হয়। নির্মূল হয় গাছপালা শোভিত অরণ্যের জগৎ। দেখা দেয় অর্থগৃধু মহাজন ব্যবসায়ী, আর কলকারখানা নির্ভর মলিন নগর বা উপনগরীর সম্ভাব্য পরিণতি। এই অরণ্য ধ্বংসের কাজে নিজে জড়িয়ে পড়ার ক্ষোভ দুঃখে নায়ক আত্মকথনে অরণ্যের সেই লুপ্ত সৌন্দর্য্য ও অরণ্যজীবী মানুষের স্মৃতিচারণে প্রায়শ্চিত্ত করে—“আমার এ অনুভূতি আনন্দের নয় দুঃখের। এই স্বচ্ছন্দ প্রকৃতির লীলাভূমি আমার হাতে বিনষ্ট হইয়াছিল, বনের দেবতারা কখনো আমায় ক্ষমা করিবে না জানি।”
কেন উল্লেখযোগ্য :
১। কোনও সুনির্দিষ্ট সুদীর্ঘ কাহিনি বা উপন্যাস নেই। অখণ্ড, বিস্তৃত, নিসর্গপ্রকৃতি এই উপন্যাসের পটভূমি। এই অঞ্চলের বিভিন্ন মানুষ সম্পর্কে নায়কের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা প্রকাশ পেয়েছে।
২। আরণ্যকের চরিত্রগুলি অরণ্যের মতোই সবুজ, স্বাভাবিক জীবনরসে উচ্ছল। নৃত্য শিল্পী বালক ধাতুরিয়া যেন সরস্বতী কুণ্ডের চঞ্চল জলধারা, সৌন্দর্য্য সাধক যুগলপ্রসাদ যেন রাত্রির তৃতীয় প্রহরে ঝরে পড়া জ্যোৎস্না, সাঁওতালরাজ দোবরু পান্না যেন বনভূমির আপাত রিক্ত মহিমা, তরুণী ভানুমতী যেন অরণ্য জগতের শ্যামল সবুজ পাতার আশ্রয়, বিহার প্রবাসী বাঙালি মেয়েরা যেন কাঁকর বিছানো মাটির রুক্ষতার প্রতীক।
৩। উত্তরে আজমাবাদ থেকে দক্ষিণে কিষাণপুর–পূর্বে ফুলকিয়া বইহার ও লবটুলিয়া থেকে পশ্চিমে মুঙ্গের জেলার সীমানা পর্যন্ত নিসর্গ প্রকৃতির বিভিন্ন রূপের পরিচয়দান, যেমন—খরায় শুষ্ক প্রকৃতির বর্ণনা : ‘সূর্যের দিকে চাহিয়া দেখিলাম একটি বিরাট অগ্নিকুণ্ড…তারই ধূ-ধূ আগুনের ঢেউ……ফুলকিয়া বইহার ও লোধাইটোলার বিস্তীর্ণ অরণ্যে আসিয়া লাগিয়া প্রতি তৃণপত্রে শিরা উপশিরার সব রসটুকু শুখাইয়া ঝামা করিয়া, দিগদিগন্তে ঝলসাইয়া পুড়াইয়া শুরু করিয়াছে এক তাণ্ডব লীলা।”
৪। বোমাইবুরুর জঙ্গলে ‘ডামবানু’ বা অল্প বয়সী সুন্দরী জিনপরী, ‘টাড়বারোঁ’ বা মহিষের দেবতা প্রভৃতি প্রসঙ্গ উপস্থাপনায় মিস্টিক ভাব-কল্পনা ও রহস্যানুভূতির প্রকাশ ঘটেছে।
৫। উপন্যাসের আঙ্গিক নির্মাণে ডায়েরী, ভ্রমণ কথা এবং আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসের ত্রয়ী লক্ষণ অল্পবিস্তার দেখা গেছে, যদিও লেখক ভূমিকায় জানিয়েছেন— “ইহা ভ্রমণ বৃত্তান্ত বা ডায়েরী নহে, উপন্যাস।”
পদ্মানদীর মাঝি (১৯৩৫)
গ্রন্থকার : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।
গ্রন্থরূপ : আঞ্চলিক উপন্যাস।
বিষয় : পদ্মার তীরবর্তী কেতুগ্রাম ও অন্যান্য গ্রামের জেলেরা বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন সময়ে পদ্মায় মাছ ধরতে যায়। দু একজন বাদে এদের অধিকাংশের আর্থিক অবস্থা শোচনীয়। কুবের, গণেশ ধনঞ্জয়ের জাল ও নৌকা ব্যবহার করে পায় যৎসামান্য মজুরী এই নিদারুণ দারিদ্রের সঙ্গে আছে প্রকৃতির অত্যাচার ও সামাজিক বৈষম্য। এই অত্যাচার থেকে রক্ষার জন্য গোপনে কখনো সাহায্য করে হোসেন মিঞা। এই সাহায্যের বিনিময়ে তার উদ্দেশ্য কোনও এক দুর্বলতার সুযোগে তার জনশূন্য ময়না দ্বীপে এদের নিয়ে যাওয়া। কুবের তার পঙ্গু স্ত্রী মালা ছেলেমেয়েদের নিয়ে দারিদ্রের মধ্যে বাস করেও মালার বিবাহিতা বোন কপিলাকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে। শেষ পর্যন্ত তার সেই অবৈধ বসবাসের স্বপ্ন সফল হয়। রাতুর ষড় যন্ত্রে পীতম মাঝির টাকা ভর্তি ঘটি চুরির অভিযোগে কুবের কেতুগ্রাম ছেড়ে ময়না দ্বীপে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
কেন উল্লেখযোগ্যঃ
১। পদ্মানদীর মাঝিদের জীবনযাত্রা রূপায়ণে বলিষ্ঠ বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গীর প্রবর্তন।
২। শ্রমজীবী দরিদ্র মানুষের জীবনে জৈবিক প্রবৃত্তির এক অভিনব নির্মম নিত্যসত্য প্রকাশ করেছেন।
৩। পদ্মানদীর মাঝিদের দারিদ্র লাঞ্ছিত জীবন চিত্র এই উপন্যাসের উপজীব্য।
৪। কুবের বা জেলে মাঝিদের সংসার যাত্রার নির্মম বাস্তবতার সঙ্গে কুবের কপিলার প্রেম সম্পর্ক আশ্চর্য ভাবে ফুটে উঠেছে।
৫। পৃথিবীর সমস্ত দেশের প্রতিনিধি স্থানীয় সাহিত্যের নির্বাচিত রচনা সংকলনের মধ্যে এই উপন্যাসের একটি বড়ো অংশ প্রকাশ পায়।
ধাত্রী দেবতা (১৯৩৯)
গ্রন্থকার : তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
গ্রন্থরূপ : আত্মজৈবনিক উপন্যাস।
বিষয় : জমিদারের ছেলে শিবনাথের শৈশবের থেকে কৈশোর ও যৌবন পর্যন্ত পরিণতির কাহিনি বিবৃত হয়েছে। বাল্যে যে দুঃসাহসিকতা তাকে যুদ্ধাভিনয় ও নেকড়ের বাচ্চা ধরতে উত্তেজিত করেছিল, কৈশোরে সেটাই তাকে মহামারীর প্রতিষেধক প্রচেষ্টায় ও যৌবনে সন্ত্রাসবাদ ও অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রেরণা দিয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিত্ব স্ফুরণের সঙ্গে সঙ্গে আভিজাত্য গৌরবের খোলস সম্পূর্ণভাবে শিব নাথের মন থেকে খসে গেছে—পিসিমার শিক্ষাপ্রসূত দৃপ্ত মর্যাদা বোধ মায়ের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশপ্রীতি ও জনসেবার অভিনব পথ অনুসরণ করেছে। তাই শেষ পর্যন্ত মায়ের আদর্শই শিবনাথের চরিত্রে মঞ্জুরিত হয়ে উঠেছে।
কেন উল্লেখযোগ্য :
১। এ উপন্যাসে তারাশঙ্কর পুরাতন ও নতুন জীবনের সংঘাতে নতুন যুগের দেশপ্রেম, সাম্যবাদ ও গণতান্ত্রিক চেতনাকে এক প্রশস্ত মানবিক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
২। দুর্ভিক্ষের পটভূমি ব্যবহারের জন্যই এ উপন্যাসটি অনন্য হয়ে উঠেছে।
৩। এখানে মা যা ছিলেন, মা যা হয়েছেন, মা যা হবেন—এই ত্রিকালের ভাবনা প্রকাশ পেয়েছে।
৪। সর্বোপরি, কথাকার রূপে বিশেষ খ্যাতি অর্জনে তারাশঙ্করকে উপন্যাসটি বিশেষ সহায়তা করেছে। অর্থাৎ বলা যেতে পারে এটি তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।
বিষবৃক্ষ (১৮৭৩ খ্রীষ্টাব্দ)
গ্রন্থকার : বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
গ্রন্থরূপ : সামাজিক উপন্যাস।
বিষয় : গোবিন্দ পুরের জমিদার নগেন্দ্রনাথ দত্ত বৈষয়িক কাজে নৌকারোহণে কলকাতা আসেন। পথে ঝড় বৃষ্টির কারণে এক আশ্রয়ের খোঁজে এসে কুন্দনন্দিনীর সাক্ষাৎ পান। সুন্দরী ও গুণবতী স্ত্রী সূর্যমুখী থাকা সত্ত্বেও নগেন্দ্রনাথ কুন্দনন্দিনীর রূপে মুগ্ধ হন। পরবর্তী সময়ে তারাচরণের সঙ্গে কুন্দের বিবাহ হলেও তিন বছর পর বিধবা হয়ে পুনঃরায় নগেন্দ্র ও সূর্যমুখীর সংসারে ফিরে আসে। রূপান্ধ নগেন্দ্রনাথের মানসিক পরিবর্তন দেখে সূর্যমুখী তাঁর সঙ্গে কুন্দের বিয়ে দিয়ে গৃহত্যাগ করেন। অতঃপর সূর্যমুখীর বিহনে নগেন্দ্রের চৈতন্য ফেরে, নানাস্থানে স্ত্রীকে সন্ধান করে ফিরতে লাগলেন। বহু দুঃখের পর সূর্যমুখী ফিরে আসে। হীরা দাসীর প্ররোচনায় এদিকে বিষ পান করে মরে কুন্দনন্দিনী। এইভাবে দেখানো হয়—“বিষবৃক্ষের বীজ বপন হইতে ফলোৎপত্তি এবং ফলভোগ পর্যন্ত।” ঘটনা ধারা, বলা হয়—“রিপুর প্রাবল্য ইহার বীজ ; ঘটনাধীনে তাহা সকল ক্ষেত্রে উপ্ত থাকে।… চিত্ত সংযম-এর অভাবই ইহার অঙ্কুর, তাহাতেই এ বৃক্ষের বৃদ্ধি।…. ইহার ফল বিষময়; যে খায়, সেই মরে।”
কেন উল্লেখযোগ্য :
১। বঙ্কিমচন্দ্র এই প্রথম বাংলা সাহিত্যে থিম নির্ভর সামাজিক উপন্যাসের সূচনা করলেন। বিধবা বিবাহ এবং রূপজ মোহে চিত্ত বিকার এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হয়ে ওঠে। “বাঁচিতে কে চাহে ? এ সংসার বিষময়। বিষবৃষ সকলেরই গৃহাঙ্গনে। কে ভালো বাসিতে চাহে?” পরবর্তী কালে “চোখের বালি” থেকে একালের বাংলা উপন্যাস পর্যন্ত এই ভাবেরই প্রতিধ্বনি নানাভাবে শোনা যায়।
২। প্রাচীন সামন্ততন্ত্রের নব্য বণিক তন্ত্রে পরিবর্তন, অবাধ বাণিজ্য সূত্রে নগেন্দ্রনাথের কলকাতা যাত্রা, প্লণ্ডর ফেয়ালি প্রভৃতি সওদাগরি অফিসের সঙ্গে শ্রীশচন্দ্রের সম্পর্ক, সূর্যমুখী ও কমলমণির মিস টেম্পোলের কাছে ইংরেজী শিক্ষা, তারাচরণের ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে সংযোগ, বিধবা বিবাহ প্রভৃতি সমকালীন প্রসঙ্গের প্রতিফলন উপন্যাসে সমাজ বাস্তবতার পটভূমিতে দেখা দেয়। লেখক এই প্রথম ধূসর ইতিহাস থেকে সমকালীন সামাজিক ভূমিতে পদার্পণ করেন।
৩। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিচারণায় বঙ্গদর্শন পত্রিকায় প্রকাশিত বিষবৃক্ষের জনপ্রিয়তা ধরা পড়েছে—“তখন বঙ্গদর্শনের ধূম লেগেছে, সূর্যমুখী আর কুন্দনন্দিনী আপন লোকের মতো আনাগোনা করছে ঘরে ঘরে। কী হল, কী হবে, দেশশুদ্ধ সবার এই ভাবনা।”
৪। বিষবৃক্ষ উপন্যাসের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রেরণায় পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শৈশব সহচরী’, রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ ; রমেশচন্দ্র দত্তর “সংসার” এবং শরৎচন্দ্রের বিধবা জীবন-নির্ভর উপন্যাসগুলি লেখা হয়। এই সকল কারণেই ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসের ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম।
পথের দাবী
গ্রন্থকার : শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
গ্রন্থরূপ : রাজনৈতিক উপন্যাস।
বিষয় : অগ্নিদীপ্ত রাজনৈতিক বিপ্লব নিয়ে রচিত এই মহৎ উপন্যাস। এর মধ্যে রাজনৈতিক দাবি ও ঔপন্যাসিক দাবি উভয় দাবীই অতি চমৎকার ভাবে মিটিয়েছেন। এর মধ্যে বিপ্লবী সব্যসাচী ও তাঁর বিপ্লবীর দল চতুর্দিকে যে প্রচণ্ড অগ্নিকাণ্ড বাঁধিয়ে তুলেছে তারই নিরাপদ অভ্যন্তরে অপূর্ব, ভারতী, নবতারা প্রভৃতির আবেগ ও বেদনা মিশ্রিত হৃদয় লীলার স্নিগ্ধ আসর রচিত হয়েছে। পথের দাবীর সভানেত্রী সুমিত্রা কঠিন প্রস্তরে নির্মিত নারীমূর্তি। কিন্তু মাঝে মাঝে এই প্রস্তর মূর্তির বিদীর্ণ অন্তর হতে বিগলিত অশ্রুধারা বাধা বন্ধনহীন আবেগে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে।
কেন উল্লেখযোগ্য :
১। এই উপন্যাসে শরৎচন্দ্র একটি সম্পূর্ণ নতুন বিষয়বস্তু ও পটভূমিকা গ্রহণ করেছেন। তাঁর অন্যান্য উপন্যাস হতেও আমরা তাঁর অকৃত্রিম ও গভীর দেশপ্রীতির পরিচয় পাই। কিন্তু তিনি মুখ্যত সমাজ সংস্কারক, সমাজের সুস্থ চেতনা উদ্দীপিত করানোই তাঁর প্রধান লক্ষ্য। যেইজন্য তাঁর দৃষ্টি প্রধানত, সমাজের আভ্যন্তরীণ দোষ ত্রুটির প্রতিই নিবদ্ধ। পরাধীনতার গ্লানিই ও দুর্ভাগ্য বোধ তাঁর বাস্তব চেতনার অনুস্যূত ছিল, কিন্তু রাজনৈতিক আন্দোলন ও বিপ্লববাদ নিয়ে এর পূর্বে কোনও উপন্যাস লেখেননি। তাই গ্রন্থটি তাঁর সাহিত্য প্রতিভার একটা নতুন বিকাশ।
২। ‘আনন্দমঠ’ বাদ দিলে ‘পথের দাবী’ কে বাংলা সাহিত্যে শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক উপন্যাস বলা যেতে পারে। একে অবলম্বন করে পরবর্তীকালে মনোজ বসুর ‘ভুলি নাই’, তারাশঙ্করের ‘ধাত্রীদেবতা গোপাল হালদারের ‘একদা’ প্রভৃতি উপন্যাস রচিত হয়েছিল। এক সময় এই উপন্যাস বাঙালি বিপ্লবী তরুণদের বিশেষ ভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
কৃষ্ণকান্তের উইল (১৮৭৮)
গ্রন্থকার : বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
গ্রন্থরূপ : সামাজিক উপন্যাস।
বিষয়ঃ যে দাম্পত্য ধর্মের গৌরব কথনের শুরু বিষবৃষে তার শেষ কৃষ্ণকান্তের উইলে । ‘বিষবৃক্ষে’ উপন্যাসের কাহিনির সঙ্গে কৃষ্ণকান্তের উইল উপন্যাসে বর্ণিত কাহিনির সাদৃশ্য ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পাঠকের চোখে পড়ে। উভয় উপন্যাসের ভাব গ্রন্থি একই, যা কিছু পার্থক্য চরিত্রগত জটিলতায়। কৃষ্ণকান্তের উইলের কাহিনি এইরূপ ঃ গোবিন্দলাল স্ত্রী ভ্রমরকে নিয়ে সুখে সংসার করছিলেন, হঠাৎ তাঁর জীবনে ধূমকেতুর মতো বাল্যবিধবা রোহিণীর আবির্ভাব হল। ভোগাকাঙ্ক্ষার জন্য উদগ্রীব রোহিণীর পক্ষে গোবিন্দলালকে নিজ অঞ্চলে তুলে টেনে আনা দুরূহ হল না। গোবিন্দলাল পতঙ্গের মতই রোহিণীর রূপ বহ্নির দিকে ছুটে গেল, ভ্রমর প্রবৃত্তি তাড়িত স্বামীকে সহানুভূতির স্পর্শে কাছে না টেনে, আত্মাভিমানের প্রচণ্ড ধাক্কায় দূরে ঠেলে দিল। গোবিন্দলালের মোহ ভাঙতে দেরী হল না, তাঁর হাতেই পিস্তলের গুলিতে প্রাণ হারালো রোহিণী। রোহিণীকে হত্যা করে তিনি ফেরার হলেন, মামলা মোকদ্দমার পর তিনি মুক্তি পেলেন বটে কিন্তু তিনি আর সে অঞ্চলে কাউকে মুখ দেখালেন না, শুধু স্ত্রীর মৃত্যু শয্যায় উপস্থিত হলেন। ভ্রমর তাঁর পায়ের ধূলো নিয়ে দেহত্যাগ করলেন কিন্তু দুষ্কৃতকারী ও নারী ঘাতক স্বামীকে পরজন্মে আর স্বামী রূপে পাবার আশা করলেন না। এই আঘাতে গোবিন্দলালের চৈতন্য হল, তিনি ঈশ্বর—পাদপদ্মে মনঃনিবেশ করলেন এবং ‘ভ্রমরাধিক’ ভ্রমর’ অর্থাৎ ঈশ্বরে চিত্তনিবেশ করে জীবনের দুঃস্বপ্ন ভুলতে চেষ্টা করলেন।
কেন উল্লেখযোগ্য :
নারীর আকাঙ্ক্ষা ও প্রবৃত্তির সঙ্গে সংস্কারের দ্বন্দ্ব পুরুষের নৈতিক অধঃপতন প্রভৃতি, মনস্তত্ত্বের দিক থেকে উপস্থাপিত হয়েছে। এই উপন্যাসে কাহিনির নাট্যগুণ চরিত্রগুলির পারস্পরিক সম্বন্ধ, গভীর বিশ্লেষণ ইত্যাদির দিক থেকে কৃষ্ণকান্তের উইল বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
শেষ প্রশ্ন (১৯৩১)
গ্রন্থকার : শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
গ্রন্থরূপ : উদ্দেশ্যমূলক সামাজিক উপন্যাস
বিষয় : ‘শেষপ্রশ্ন’ উপন্যাসটি প্রধানত বিতর্কমূলক মতবাদ আলোচনার ক্ষেত্র ; এটিকে উপন্যাসিক গুণসমৃদ্ধ বলা যায় না। এর একমাত্র চরিত্র কমল। অন্যান্য চরিত্র কমলকেন্দ্রের চারিদিকে বিন্যস্ত। কমলের তীক্ষ্ণ ব্যক্তিত্বের ও দৃঢ়জীবন নীতির বিভিন্নরূপ প্রতিক্রিয়ার বাহনমাত্র। কমলের যুক্তি প্রয়োগ ও স্বীয় মতবাদ প্রতিষ্ঠার নৈপুণ্য অসাধারণ। হিন্দু সমাজে প্রচলিত ও বদ্ধমূল সংস্কার রূপে গৃহীত আদর্শবাদ— সংযম ও ব্রহ্মচর্য, দাম্পত্য সম্পর্কের অবিচল নিষ্ঠা ও স্মৃতির মর্যাদা এবং সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা এ সবের বিরুদ্ধে কমল তীব্র প্রতিবাদও করেছে। তার মতে এগুটি কেবল মাত্র জীবনের ওপর দুর্ভর বোঝামাত্র। কোনরূপ সম্পর্কের স্থায়িত্বে আবদ্ধ না হয়ে, সম্পর্কছেদে কোনো মনো বেদনাকে প্রশ্রয় না দিয়ে, কেবল মুক্ত প্রাণে, নিরাসক্ত চিত্তে তাৎক্ষণিক আনন্দকে অস্তরের সমস্ত বলিষ্ঠ গ্রহণশীলতা দিয়ে উপভোগ করা—এটাই তার মতে জীবনের পরম সার্থকতা।
কেন উল্লেখযোগ্য :
‘শেষপ্রশ্ন’ উপন্যাস শরৎ উপন্যাসে এমন কিছু ব্যতিক্রম নয়, কমল তেমন একটা বিদ্রোহিনী নয়, শরৎ সৃষ্ট নারীচরিত্র মণ্ডলীতেই তার যথার্থ স্থান। মনন প্রধান উপন্যাস শরৎচন্দ্রের স্বক্ষেত্র নয়, তবুও বাংলা কথা সাহিত্যে ‘শেষ প্রশ্নের’ স্থান অনন্য।
পথের পাঁচালী (১৯২৯)
গ্রন্থকার : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
গ্রন্থরূপ : সামাজিক উপন্যাস।
বিষয় : বাংলা দেশের নিশ্চিন্দিপুর গ্রামে এক অখ্যাত গ্রামাঞ্চলকে কেন্দ্র করে অপুর শৈশব জীবন কাহিনি বিবৃত হয়েছে। উপন্যাসটি তিনটি পর্বে বিভক্ত : ‘বল্লালী বলাই’, ‘আম আঁটির ভেঁপু’, ‘অঙ্কুর সংবাদ’ (বা উড়োপায়রা)। প্রথম পর্বে আছে অপুর পূর্ব পুরুষের পরিচয়অপুর পিসিমা নিঃসন্তান ইন্দিরা ঠাকুরুণের করুণ জীবন কাহিনি। তাঁর “মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিন্দিপুর গ্রামে সেকালের অবসান” হয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। এই পর্বেই আছে অপুর জন্মের বিবরণ। দ্বিতীয় পর্বে আছে অপুর প্রকৃতি পরিচয়ের ইতিবৃত্ত। সহজ পল্লি প্রকৃতির গোপন গভীর সুর কীভাবে শিশু অপুর বিবাগী স্বপ্ন মুগ্ধ মনের তারে ঝঙ্কার তুলেছে তার আশ্চর্য ব্যঞ্জনাময় উপস্থাপনা। এখানে অপু এবং তার দিদি দুর্গার মধ্যে সখ্যতার সম্বন্ধটি ব্যক্ত হয়েছে। তারপর সোনাডাঙার মাঠ, বেত্রবতী নদী, আশ শ্যাওড়া সজনে ও ডুমুর গাছে ভরা নিশ্চিন্দি পুরের শিশু মনের কল্পভূমি ত্যাগ করে দুর্গাকে হারিয়ে ব্যবহারিক জীবনের কঠিন নিষ্ঠুর প্রয়োজনে অপু কাশী যাত্রা করেছে সর্বজয়া-হরিহরের সঙ্গে। সেই করুণ এবং অনিবার্য বিদায় কাহিনির নাম ‘অক্রূর সংবাদ’। গ্রন্থ শেষে সর্বজয়া, হরিহর, দুর্গা এমন কি অপুর কাহিনিও ছাপিয়ে উঠেছে পথের দেবতার দুর্নিবার আহ্বান“দিন রাত্রি পার হয়ে, জন্মমরণ পার হয়ে, মার্স, বর্ষ, মন্বন্তর, মহাযুগ পার হয়ে চলে যায়…তোমাদের মর্মর জীবন স্বপ্ন শেওলা ছাতার দলে ভরে আসে, পথ আমার তখনও ফুরায় না….চলে… চলে….. চলে….এগিয়েই চলে ।
কেন উল্লেখযোগ্য :
১। বিচিত্র পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে এই উপন্যাস প্রথম প্রকাশিত হয়। কল্লোল যুগের উত্তেজনা যখন স্তিমিত, সংশয়, অস্থিরতা, বিচিত্র উগ্র মতবাদের সংঘাতে, উদ্ভ্রান্ত বিপর্যস্ত যখন বাঙালির মনোজীবন, ঠিক সেই ক্রান্তিময় কালাপাহাড়ী সঙ্কটকালে ‘পথের পাচালী’র অপ্রত্যাশিত আবির্ভাব ঘটল। বোঝা গেল এই বাংলা দেশের গ্রাম প্রান্তে এক ‘সব পেয়েছির জগৎ’ আছে।
২। বাংলাদেশের পল্লিগ্রামের গরীব ঘরের পরিবার জীবনের মধুর পুরনো ঘরোয়া কাহিনির অন্তরালে লেখকের এক অভিনব দৃষ্টিভঙ্গী প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, “Vastness of space and passing time” –এর বিপুল রহস্য অনুধ্যানে জীবনের স্বরূপ উপলব্ধি করা। তাই গ্রন্থের সমস্ত কাহিনি সমস্ত চরিত্র মিলে জীবনের চলমান রূপটিকে, মহাকালের বিরামহীন পথিক স্বরূপকে প্রকাশ করেছে।
৩। উপন্যাসে অপুর জীবনকে কেন্দ্র করে বাঙালি শিশুর চিরন্তন শৈশব চেতনা যেন একতারার সুরে বেজে উঠেছে। এই উপন্যাস আমাদের মনে এক নস্টালজিক আবেদন সৃষ্টি করে।
৪। অনেকে এ গ্রন্থটিকে ‘আত্মচরিতমূলক’ মনে করেন। লেখকের জবানবন্দীতে তা ধরা পড়ে—“অবশ্য কতকটা যে আমার জীবনের সংযোগ আছে ঘটনাগুলির সঙ্গে, এ বিষয়ে ভুল নেই, কিন্তু সে যোগ খুব ঘনিষ্ঠ নয়, ভাসা-ভাসা ধরনের। চরিত্রগুলি সবই কাল্পনিক।”
৫ । উপন্যাসটি বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়। চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় এই বইকে চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত করে বিখ্যাত হন।
চরিত্রহীন (১৯১৭)
গ্রন্থকার : শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
গ্রন্থরূপ : সামাজিক উপন্যাস।
বিষয় : সমাজনীতির পটভূমিকায় ব্যক্তিচরিত্রের জীবন-বাসনা ও সুনীতিবোধের দ্বন্দ্বের আবর্ত উপেন্দ্র-সুরবালা, সতীশ-সাবিত্রী, দিবাকর-কিরণময়ীর জীবন বৃত্তকে ঘিরে রচিত হয়েছে। মানুষের চরিত্রে আছে দুটি সত্তা—এক স্বাধীন আর এক পারিপার্শ্বিক সমাজনীতির অধীন। এই সত্তার সংঘর্ষে ও সমন্বয়ে গড়ে ওঠে তার জীবন ও চরিত্র শরৎচন্দ্র দেখিয়েছেন, মানব চরিত্রের আলোচনা বা বিচার এর কোনও একটি দিকের দ্বারা সম্পূর্ণ হতে পারে না। যে মানুষ এই দুই দিকের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করতে পারে, সে এই সংসারে যথার্থ চরিত্রবান, যে পারে না তাকে আমরা বলি ‘চরিত্রহীন’ সাধারণ ভাবে এই অনুভূতি সত্য, এ উপন্যাসে প্রায় সব চরিত্রই তাদের নিজেদের মধ্যে সামঞ্জস্য করে নিতে পেরেছে। ব্যতিক্রম কেবল কিরণ্ময়ী। অসাধারণ রূপসী ও বুদ্ধিমতী হওয়া সত্ত্বেও সে তার স্বামী হারানের ভালোবাসা পায়নি। উপেন্দ্রের ভাই দিবাকরের কাছে শ্রদ্ধা পেয়েও না পাওয়ার চিরন্তন ব্যর্থতায় শেষে অর্দ্ধোন্মাদিনী হয়ে চরম বেদনায় তাকে দৈব বিশ্বাসের আশ্রয় নিতে হয়েছে।
কেন উল্লেখযোগ্য :
১। চরিত্রহীন উপন্যাস সম্পর্কে শরৎচন্দ্র প্রমথনাথ ভট্টাচার্য, উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, ফণীন্দ্রনাথ পাল প্রমুখ বন্ধুবর্গের কাছে যে মন্তব্য প্রকাশ করেছিলেন, তার থেকে এই উপন্যাসটি সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব মতামত, ধ্যান ধারণা ও বিশ্বাস এবং একটি পরিকল্পনার কথা জানা যায়। তার মতে ; “ওটা সাইকোলজি এবং এ্যানালিসিস….. একটা সম্পূর্ণ সায়েন্টিফিক এথিক্যাল নভেল”। বস্তুত চরিত্রহীনে এমন কিছু স্বভাব ধর্ম আছে যা আধুনিক যুগ লক্ষণের অনুবর্তী। আত্মবিশ্লেষণ ও মনোবিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে চরিত্রের স্বরূপ উদ্ঘাটন ও ব্যাখ্যাদান এবং প্রচলিত নীতিবোধের মূল্যায়ন উপন্যাসটিকে আকর্ষণীয় করে তোলে।
২। কিরন্ময়ীর মতো উজ্জ্বল নারীচরিত্রের উপস্থাপনা। দিবাকরের প্রশ্নের উত্তরে তার দীপ্ত বাচন ভঙ্গী পাঠককে সর্বক্ষণ সচকিত করে রাখে; যেমন—নারীপুরুষের মিলনের কারণ রূপে সৃষ্টি তত্ত্ব ব্যাখ্যা : “প্রতি অনু-পরমাণু নিরত্তর আপনাকে নতুন করে সৃষ্টি করতে চায়। কেমন করে সে নিজেকে বিকাশ করবে, কোথায় গেলে, কার সঙ্গে মিললে, কি করলে সে আরও সবল আরও উন্নত হবে, এই তার অক্লান্ত উদ্যম।”
৩। সতীশের প্রতি মেসের ঝি সাবিত্রীর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, বিপিনের মতো অসৎ ব্যক্তির লোভও প্ররোচনা উপেক্ষা করে সুচিনিষ্ঠ জীবনযাপন পাঠককে বিস্মিত ও কৌতূহলী করে।
৪। বিভিন্ন চরিত্রের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণের সঙ্গে ঘটনা উপস্থাপনায় নাটকীয়তা উপন্যাসটিকে সুখ পাঠ্য করে তোলে। যেমন ২১ অধ্যায়ে উপেন্দ্রের সাবিত্রীকে দেখে সতীশের বাসা থেকে ফিরে যাওয়া, ২৮ অধ্যায়ে দুর্বৃত্তদের হাত থেকে সতীশের সরোজিনীকে উদ্ধার, ৪০ অধ্যায়ে মোক্ষদার মুখে সাবিত্রীর কথা শুনে উপেন্দ্রের সতীশের কাছে প্রত্যাবর্তন ইত্যাদি।
কজ্জলী (১৯২৭)
গ্রন্থকার : পরশুরাম ছদ্মনাম রাজশেখর বসু। গ্রন্থরূপ : কৌতুক রসের গল্প সংকলন।
বিষয় : এই সংকলনে আছে পরিহাস ও ব্যাচ্ছলে ব্যক্তি ও সমাজের অসঙ্গতি বর্ণনা। স্থান পেয়েছে ছ’টি গল্প : প্রথম গল্প – বিরিশ্মিবোবা — শিষ্য প্রতারক গুরু বা অবতার জাতীয় ব্যক্তির বাগ্জালে কীভাবে শিক্ষা দীক্ষা যুক্তি বুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে উচ্চ ও মধ্য শ্রেণির মানুষেরা ধরা দেয় তার বুদ্ধিদীপ্ত বর্ণনা। দ্বিতীয় গল্প : জাবালি—পৌরাণিক এক ঋষি চরিত্রের উপযোগবাদী মূল্যায়ন, তৃতীয় গল্প ঃ দক্ষিণ রায়—বংশলোচন বাবুর বৈঠকের নায়ক কেদার চাটুজ্যের বর্ণনায় ব্যবসায়ী কাউন্সিলে পদলাভের উচ্চাকাঙ্ক্ষী, বকুলালের দক্ষিণরায়ের কৃপায় বাঘে রূপান্তরিত হওয়ায় অবিশ্বাস্য উদ্ভট গল্প, চতুর্থ গল্প ঃ স্বয়ম্বরা— টুণ্ডলার ট্রেনের কামরায় মিস জোন জিলটারের পাণিপ্রার্থী ঢ্যাঙা ও বেঁটে দুই সাহেব টিমথি টোপার এবং ক্রিস্টোফার কলম্বাসের জিলটারের মনোনীতি বিল বাউন্ডারের কাছে নাকালের কাহিনি আর কেদার চাটুজ্যের নিজের ওই মেমের কাছে প্রতারিত হওয়ার ঘটনা। পরবর্তী গল্প ঃ কচি সংসদ—সমকালীন বাংলার তরুণ বা অনতিতরুণদের প্রেম বিবাহ ইত্যাদি কাজের হাস্যকর ছেলে মানুষির পরিচয় দান। শেষ গল্প ঃ উলট পুরাণ— ইংল্যাণ্ডকে ভারতের উপনিবেশ রূপে উল্টোভাবে দেখিয়ে ভারতীয় চরিত্রের বিশেষত ইংরেজ সান্নিধ্যলোভী উচ্চবিত্ত সম্প্রদায়ের শেষোক্ত রূপায়ণ।
কেন উল্লেখযোগ্য :
ক) পরিস্থিতিগত ও চরিত্রগত হাসির উপাদানসহ একটি সামাজিক উদ্দেশ্য এই সঙ্কলনের অনেক গল্পে বর্তমান ; যেমন বিরিঞিবাবা’য় আছে ‘স্বামী গিরির ভণ্ডামীর স্বরূপ উদ্ঘাটন। স্বাবলম্বী মুক্তিমতি যশোবিমুখ সংস্কারের ছিন্ন বন্ধন, জাবালি চরিত্রের আদর্শকে মানব সমাজে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। উলট পরাণে’ পরাধীন ভারতের ছবিকে উল্টো করে দেখনো ইত্যাদি।
খ) প্রধানত বিশুদ্ধ হাস্য বা Humour এবং তার পাশাপাশি Satire এবং Wit এর সহাবস্থান বইটিকে হাস্য বা কৌতুকরসের এক মূল্যবান সংকলনে পরিণত করেছে। প্রকৃত পক্ষে বৈঠকী মেজাজ, অনাবিল দৃষ্টিভঙ্গী, মার্জিত শুভ্র রসিকতা এবং বাঙালি জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার সরস পরিচয়ে এই গ্রন্থ বাংলা সাহিত্যে এক অদ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে।
গ) উপমা ও শব্দ নির্বাচনে পরশুরামের অননুকরণীয় স্টাইল বা বাগদীপ্তি ফুটে উঠেছে ; যেমন—বিরিঞিবাবা’র বর্ণনার “….দু পয়সা দামের সিঙ্গাড়ার মতো সুবৃহৎ নাক, মৃদু হাস্য মণ্ডিত প্রশস্ত ঠোঁট, তার নীচে খাঁজে খাঁজে চিবুকের স্তর নামিয়াছে।” কিম্বা ‘স্বয়ম্বরা’ গল্পে কেদার চাটুজ্যের মেমসাহেবকে আশীর্বাদ : “ঠোঁটের সিঁদুর অক্ষয় হোক।” সাধু গদ্যের মধ্যে চলিত শব্দের এমন কি ইংরেজী শব্দের অপূর্ব ব্যবহার গ্রন্থটিকে স্মরণীয় করে তুলেছে।
গড্ডলিকা (১৯২৪)
গ্রন্থকার : পরশুরাম ছদ্মনামে রাজশেখর বসু।
গ্রন্থরূপ : কৌতুক রসের গল্প সংকলন।
বিষয় : এই সংকলনে আছে পরিহাস বা কৌতুকের আশ্রয়ে ব্যক্তির আচরণে অসঙ্গতি বর্ণনা। এখানে স্থান পেয়েছে পাঁচটি স্বতন্ত্র বিষয়ের বিভিন্ন স্বাদের গল্প ঃ শ্রী শ্রীসিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড, চিকিৎসা সংকট, মহাবিদ্যা, লম্বকর্ণ, ভূশণ্ডীর মাঠে। প্রথম গল্প কিছু ব্যবসায়ীর। (শ্যামানন্দ ব্রহ্মচারী, বিপিন, অটল দত্ত, গণ্ডেরিরাম বাটপাড়িয়া ইত্যাদি)। ধর্মের নামে এক বৃহৎ অসৎ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের জন্য মুনাফা সংগ্রহ করে জনগণের শেয়ারের টাকা আত্মসাৎ করার কৌতুককর বিবরণ। দ্বিতীয়টিতে বিপত্নীক নন্দবাবুর ট্রাম থেকে পা পিছলে পড়ে যাওয়ার পর বন্ধুদের তাড়নায় কাল্পনিক রোগের ভয়ে বিভিন্ন ডাক্তার দেখিয়ে শেষে লেডী ডাক্তার বিপুলা মল্লিকের অভিভাবকত্বে জীবনযাপনের সকৌতুক ইঙ্গিত। তৃতীয় গল্পে জগদ্গুরুর কাছ থেকে মহাবিদ্যা অর্থাৎ অপরকে ফাঁকি দেওয়ার কাজে ব্যস্ত সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির ও বৃত্তির মানুষের চিত্তের লোভের স্বরূপ উদ্ঘাটন। চতুর্থ গল্পে আছে জমিদার বংশলোচন ও মানিনীর মধ্যে দাম্পত্য কলহের পটভূমিতে লম্বকর্ণ নামে একটি ছাগলের উপস্থিত বুদ্ধি ও গোঁয়ার্তুমির সহাস্য বিবরণ। আর শেষ গল্পে স্থান পেয়েছে মৃত্যুর পর শিবুর তিন জন্মের তিন স্ত্রী এবং তার বর্তমান স্ত্রী নৃত্যকালীর তিনজন্মের তিন স্বামীর ভূশণ্ডীর মাঠে ভৌতিক ক্রিয়াকলাপের অদ্ভুত—অবিশ্বাস্য রঙ্গ রসিকতা।
কেন উল্লেখযোগ্য :
ক) হাস্যরস ও অদ্ভুত রসের যুগপৎ প্রকাশ, বিজ্ঞানীর অনুরূপ নির্মোহ পর্যবেক্ষণ শক্তি, চরিত্র চিত্রণে অভিনবত্ব, যুদ্ধপূর্ব মধ্যবিত্ত নাগরিক বাঙালি জীবনের অলস অকর্মণ্য গার্হস্থ্য চিত্র ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের গুণে গল্পগুলি বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্ররূপে চিহ্নিত হয়েছে।
খ) শ্যামানন্দ ব্রহ্মচারী, গণ্ডেরিরাম, নন্দবাবু, তারিনী কবিরাজ, লাটুবাবু, নাদু মল্লিক প্রভৃতি চরিত্র রূপায়ণে কাল জয়ী কৃতিত্ব দেখা গেছে, তাই রবীন্দ্রনাথের মুগ্ধ মন্তব্যঃ “বইখানি চরিত্র চিত্রশালা, তিনি মূর্তির পর মূর্তি গড়িয়া তুলিয়াছেন মনে হইল ইহাদিগকে চিরকাল জানি।
গ) অজস্র উদ্ভটের প্রাবল্য, অপূর্ব উদ্ভাবনী শক্তি, অপ্রত্যাশিত ঘটনা সমাবেশ পরশুরামের গল্পগুলিতে দেখা যায়। যেমন— নাস্তিকদের আত্মা নাই, তাঁহারা মরিলে অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন প্রভৃতি গ্যাসে পরিণত হন।
ঘ) উপমা প্রয়োগে ও বর্ণনায় অভিনবত্ব; যেমন— “নৃত্যকালীর রং ছিল পানতুয়ার মতো। কিন্তু ডাকিনীর রং যেন পানতুয়ার শাঁস।” কিংবা ট্রাম থেকে নন্দবাবু পড়ে যাওয়ার পর যাত্রীদের মন্তব্য : “আহা হা বড় লেগেছে—থোড়া গরম দুধ পিলা দাও–দুটো পাই কি কাটা গেছে?” একজন সিদ্ধান্ত করিল মৃগি, আর একজন বলিল ভির্মি। কেউ বলিল মাতাল, কেউ বলিল বাচাল, কেউ বলিল পাড়া গেঁয়ে ভূত” (চিকিৎসা সংকট)। সাধু গদ্যের মধ্যে চলিত শব্দের এমন কি মৌখিক বাক্রীতির প্রকাশ ঘটেছে।
ঙ) বৈঠকী আমেজ গল্পগুলির মধ্য এক ভিন্ন স্বাদের সরস পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
শ্রীকান্ত (১৯১৭-৩৩)
গ্রন্থকার : শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
গ্রন্থরূপ : সামাজিক উপন্যাস।
বিষয়ঃ উপন্যাসটির নায়ক শ্রীকান্তের স্মৃতিচারণা চারটি পর্বে বিন্যস্ত : শ্রীকান্ত রাজলক্ষ্মী এই দুই মূল চরিত্রের পারস্পরিক আকর্ষণে অনুরাগের ঘটনা ছাড়া আছে ইন্দ্রনাথ, অন্নদাদিদি, মেজদা, নতুনদা, বাম বাবু, সাধুবাবা, বিঠৌরা গ্রামের গৌরী তেওয়ারীর মেয়ের কাহিনি-সম্বলিত প্রথম পর্ব। দ্বিতীয় পর্বে আছে মায়ের গঙ্গাজল সখী, নন্দাটগর, অভয়া ও তার পাষণ্ড স্বামী এবং রোহিণী দা, বাঙালি স্বামীর স্বাধীন ব্রহ্ম দেশীয় পত্নী, মনোহর চক্রবর্তী, বর্ধমান গামী দরিদ্র কেরানীর জীবন-কথা। তৃতীয় পর্বে বজ্ৰানন্দ, সুনন্দা, কুশারী পরিবার, চক্রবর্তী ও তাঁর স্ত্রী, সতীশ ভরদ্বাজ ক্ষণিকের অতিথি হয়েও চিত্তপটে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে। চতুর্থ পর্বে পাই বৈশ্ববী কমললতা ও গহরকে। গ্রাম বাংলার সঙ্কীর্ণ পরিধি থেকে বিহার ভাগলপুর কলকাতা এমনকি সুদূর ব্রহ্মদেশ পর্যন্ত শ্রীকান্তের জীবন অভিজ্ঞতায় কাহিনির পটভূমি প্রসারিত। এই অভিজ্ঞতার পরবর্তী মূল্যায়নে পতিব্রতা অন্নদাদিদির দুঃখ লাঞ্ছিত জীবন, বিবাহিত জীবনের নিষ্ঠুর বৈপরীত্য ও পাষণ্ড স্বামীর অত্যাচারে বিপর্যস্ত অভয়ার রোহিনিদার সঙ্গে সুস্থ সুন্দর প্রেমময় জীবন যাপনের আকাঙ্ক্ষা, গঙ্গামাটির গ্রামে রাজলক্ষ্মীর কর্তৃত্বের বাসনা, বৈব রসের সাধিকা কমললতা নতুন গোঁসাই শ্রীকাত্তের মধ্যে দিয়ে পরম প্রেমময় ব্রজেশ্বরের রূপধ্যানের ঐশী স্বরূপ বিশ্লেষিত হয়েছে।
কেন উল্লেখযোগ্য :
১। উপন্যাসটির প্রথম পর্ব প্রকাশিত হয় ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় ১৩২২-২৩ বঙ্গাব্দে, ২য় পর্ব ১৩২৪-২৫ বঙ্গাব্দে, ৩য় পর্ব ১৩৩৩ এবং শেষ পর্ব ১৩৩৮-৩৯ বঙ্গাব্দে। প্রথম প্রকাশ কালে এটি শ্রী শ্রীকান্ত শর্মা’র ছদ্মনামে ‘শ্রীকান্তের ভ্রমণকাহিনিরূপে’ পরিচিত হয়। পরে লেখকের আত্মজীবনের কিছু প্রকাশ এবং উত্তম পুরুষে কাহিনি কথনের জন্য একে ‘আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস রূপেও চিহ্নিত করার চেষ্টা হয়। আবার অসংখ্য ঘটনা এবং বহু মানুষের উপস্থিতি সহ রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্তের মিলন বিরহের একটি নিবিড় লীলা নাট্য অনুভব করে একে ‘সামাজিক উপন্যাস’ ছাড়া যেন আর কিছু ভাবা যায় না। আসলে একমুখী কাহিনির অভাব, বিচ্ছিন্ন ঘটনাবলী, খণ্ড খণ্ড চরিত্রের সমষ্টি, আত্মকথন ভঙ্গী নায়কের পথিক স্বভাব ইত্যাদির ফলে শ্রীকান্ত কে উপন্যাসের শ্রেণিতে এক অভিনব গঠন রীতি দান করেছে।
২। শ্রীকান্ত উপন্যাস বিশেষত এর ১ম, ২য় পর্ব উচ্চাঙ্গের শিল্প সাফল্যের নিদর্শন। তার কারণ, বিষয়ের অপূর্ব উপস্থাপনা এবং আগাগোড়া সূক্ষ্ম ইঙ্গিতময় বর্ণনরীতি, যেমন—ইন্দ্রনাথ শ্রীকান্তের ‘নৈশ অভিযান’ বর্ণনা বা বর্মা যাত্রার সময় সমুদ্রে সাইক্লোনের ঘটনা ইত্যাদি। ৩য় পর্বে রতনের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ, ৪থ পর্বে কমললতার জীবনে পুরুষের প্রতারণা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
৩। উপন্যাসটির চারটি পর্ব পৃথক বৈশিষ্টমণ্ডিত ;– যেমন—১ম পর্বে চরিত্র ও ঘটনার প্রাধান্য ; ২য় পর্বে অভয়া ইত্যাদির মাধ্যমে সমাজ সমালোচনা বা বিতর্কের প্রাধান্য ; ৩য় পর্বে গঙ্গা মাটির পরিবেশ সহ বিবরণ ও চিন্তশীলতার প্রভাব বেশি; ৪র্থ পর্বটি যেন গীতিকবিতার সুরে বাঁধা।
৪। শ্রীকান্তের মতো ভবঘুরে, উদাসীন, নির্লিপ্ত স্বভাবের আত্মকথক নায়ক চরিত্র পরবর্তী কালের বাংলা উপন্যাসে প্রাধান্য বিস্তার করে; যেমন—প্রবোধ স্যান্যালের— ‘মহাপ্রস্থানের পথে, কালকূটের ‘কোথায় পাবো তারে’, ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’ ইত্যাদির নাম বিশেষ স্মরণযোগ্য।
তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৫১)
গ্রন্থকার : অদ্বৈত মল্লবর্মন।
গ্রন্থরূপ : আঞ্চলিক উপন্যাস।
বিষয় : তিতাস নদীর তীরবর্তী গ্রামের মালোপাড়ার মানুষদের জীবন কথা এই উপন্যাসের উপজীব্য বিষয়। শুকদেবপুরে পঞ্চদশী কন্যার সঙ্গে গোকনঘাটের কিশোরের মালাবদল হয়। কিন্তু গোকনঘাটে ফেরার পথে নয়া গাঙের মুখে ডাকাতরা মেয়েটিকে লুণ্ঠন করে। মেয়েটি সাঁতার কেটে আত্মরক্ষা করে। তাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে নিত্যানন্দ ও গৌরাঙ্গ নামে দুই সহোদর জেলে। সেখানে জন্ম হয় অনন্তের। তবু ডাকাতে ধরে নিয়ে যাওয়া বধূর সমাজে স্থান নেই, এই দুশ্চিন্তায় ও আঘাতে কিশোর পাগল হয়ে যায়। গ্রামের ধনী জেলে কালোচরণ ও তার মা এক পোড়া ভিটেয় অনন্তের মাকে থাকতে দেয়। বিধবার বেশে অনন্তের মা তার বিনয় নম্র, শান্ত স্নিগ্ধ ব্যবহারে গ্রামের সকলকে মুগ্ধ করে। জীবিকার জন্য মাছ ধরা জালের সুতো কাটে। তার সঙ্গে দীননাথ মালোর মেয়ে বাসন্তীর বন্ধুত্ব হয়। এই বাসন্তী এক সময় ছিল কিশোরের বাগদত্তা, পরে তাকে কিশোরের বন্ধু সুবল বিয়ে করে। কালোচরণের নৌকায় জন খাটতে গিয়ে সুবলের মৃত্যু হয়। নিঃসন্তান সুবলের বৌ বাসন্তীর ভালোবাসা অনন্তকে কেন্দ্র করে দুর্বার হয়ে ওঠে। অনন্তর জ্ঞানার্জনের মধ্য দিয়ে বৃহত্তর পৃথিবীর সঙ্গে পরিচয় শুরু হয়।
কেন উল্লেখযোগ্য :
১। একটি নদী ও মালো পাড়ার জীবন যাত্রাকে কেন্দ্র করে এই উপন্যাস লেখা হয়েছে। কিন্তু কোথাও দীনতা মলিনতা বা কুশ্রীতা নেই। এক সুন্দর রোমান্টিক মেজাজে উপন্যাসটি শুরু হয়েছে : “স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়….ভোরের হাওয়ায় তার ঘুম ভাঙে, সূর্য তাকে তাতায়, রাতের চাঁদ ও তারারা তাদের ঘুম পাড়ায়। তিতাস মাঝির নদী।” সুগভীর মানবিকতা বোধ, সৌন্দর্য চেতনা, সংস্কৃতি মনস্কতা উপন্যাসটিকে বিশেষত্ব দিয়েছে। ‘মুর্শিদা ও বাউল গান, ভাটিয়ালী, এবং গোষ্ঠ গান, মনসার গান, মাঘ মণ্ডলের ব্রত, পৌষ পার্বণ, দোল উৎসব ইত্যাদির মধ্য দিয়ে মালো সংস্কৃতির পরিচয় দেওয়া হয়েছে।
২। তিতাস নামে সাধারণ এক নদীকে ঘিরে অতি সাধারণ মানুষের জীবনে মায়ের স্নেহ, ভাইয়ের প্রেম, বন্ধুর ভালোবাসা, গ্রামের মেয়ে বৌ ঝিদের সাম্য-সম্প্রীতির রঙিন সুতোয় বোনা এক আশ্চর্য্য নক্সী কাঁথা হয়ে উঠেছে, যেখানে আছে “কথার নীচের মায়ের বুকের উষ্মতার দোসর তিতানের উষ্মতা।”
৩। উপন্যাসটি প্রথমে মাসিক ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সেই সময় গ্রন্থের পাণ্ডুলিপিটি হারিয়ে যায়। ভগ্ন হৃদয়ে লেখক বন্ধু ও পাঠকদের অনুরোধে পুনরায় লিখতে শুরু করেন। কিন্তু মালো উদ্বাস্তুদের সাহায্য কল্পে অপরিমিত পরিশ্রমে যক্ষ্মা রোগাক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়।
Leave a comment