ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পাঠ্যপুস্তক-রচয়িতা শিক্ষকদের দ্বারা বাংলা গদ্যের চর্চা শুরু হয়। কিন্তু এই সকল পাঠ্যপুস্তকের ব্যবহার নিতান্ত সীমাবদ্ধ থাকায় বাংলা গদ্যের সংস্কার সাধনে তাঁরা তেমন সহায়তা করিতে পারেনি।

‘ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে সাময়িক পত্র বাংলা সাহিত্যে খোলা হাওয়ার বাতায়ন খুলে দেয়। সাময়িক পত্রকে আশ্রয় করে বাংলা গদ্য-ভাষা নিজের পায়ে করে দাঁড়াতে শেখে। ১৮১৯ খ্রীষ্টাব্দে শ্রীরামপুরের মিশনারী ‘দিগদর্শন’ নামে একটি ক্ষুদ্র মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। বাংলা ভাষায় প্রকাশিত এটিই প্রথম মাসিক পত্র। জোশুয়া মার্শম্যানের পুত্র জন ক্লার্ক মার্শম্যান এর সম্পাদক ছিলেন। ‘যুবলোকের কারণ সংগৃহীত নানা উপদেশ’ এই পত্রিকার কলেবর পূর্ণ করত। দিগদর্শন প্রকাশের একমাসের মধ্যেই শ্রীরামপুর মিশন ‘সমাচার দর্পণ’ নামে আর একখানি সংবাদপত্র প্রকাশ করলেই যা ভাষার প্রথম সংবাদপত্র। সমাচার দর্পন বাঙ্গ লীদের চেষ্টায় দীর্ঘকাল জীবিত ছিল (১৮১৮-৫১)। এটা একটি উচ্চাঙ্গের বাংলা সংবাদপত্র’ ছিল। সমাচার দর্পর্ণের বিভিন্ন সাময়িক পত্রের প্রকাশকের ত্বরান্বিত করে।

মিশনারী-পরিচালিত বলে সমাচার দর্পণে হিন্দু সমাজ ও ধর্ম সম্বন্ধে নানা নিন্দাসূচক মন্তব্য থাকত। এই কারণে রামমোহন রায় প্রমুখ হিন্দু সমাজে কিছু উৎসাহী নেতা ১৮২১ খ্রীষ্টাব্দে ‘সম্বাদ কৌমুদী’ নামে একখানি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করলেন। তারাচঁাদ দত্ত ও ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন এর প্রকাশক। রামমোহন রায় সম্বাদ কৌমুদীর একজন নিয়মিত লেখক ছিলেন। সমাজসংস্কার বিষয়ে রামমোহন রায়ের সঙ্গে মতভেদ হওয়াতে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় সংম্বাদ কৌমুদীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ‘সমাচার চন্দ্রিকা ও সে-যুগের একখানি বিশিষ্ট সংবাদপত্র ছিল।

সমাচার চন্দ্রিকার পর ‘বঙ্গদূতের’ (১৮২৯) নাম উল্লেখযোগ্য। ইহার সম্পাদক ছিলেন নীলরতন হালদার এবং পরিচালকমণ্ডলীর মধ্যে ছিলেন রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর প্রভৃতি। বঙ্গদূত পত্রিকাতেই রাজনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ে সচেতন প্রথম প্রকাশিত হয়।

১৮৩১ খ্রীঃ ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সম্পাদনায় ‘সংবাদ প্রভাকর’ প্রকাশিত হয়। প্রথমে ইহা ছিল সাপ্তাহিক ও পরে দৈনিকে রূপান্তরিত হয়। বাংলা ভাষায় প্রকাশিত এটিই প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র৷ ‘সংবাদ প্রভাকর’ দীর্ঘ স্থায়িত্ব অর্জন করে। দেশ-বিদেশের সংবাদ ছাড়া এতে ধর্ম, সমাজ, সাহিত্য প্রভৃতি নানা বিষয়ের আলোচনা স্থান পেত। এই খ্যাতনামা পত্রিকায় বঙ্কিমচন্দ্র, দীনবন্ধু, রঙ্গলাল প্রমুখ কবি ও সাহিত্যিকগণের প্রথম বয়সের রচনা প্রকাশিত হয়েছিল। ঈশ্বগুপ্ত সংবাদ প্রভাকরের পৃষ্ঠায় পূর্ববর্তী বাঙ্গালী কবির ও কাব্যের বিষয়ে গবেষণার সূত্রপাত করেন।

সংবাদ প্রভাকরের পর জ্ঞনান্বেষণ (১৮৩১), জ্ঞানোদয় (১৮৩১) প্রভৃতি পত্রিকা অল্পবিস্তর সমাদর লাভ করে।

সাময়িকপত্রের গতানুগতিকতা ভঙ্গ করিল ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’। ব্রাহ্ম সমাজের মুখপত্ররূপে ইহা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৪৩ খ্রীঃ। পত্রিকা প্রকাশের প্রধান উদ্দেশ্য—“অনেক সভ্য দূরদেশ বশতঃ বা শরীরগত অসুস্থতা হেতু বা কোন কার্যক্রমে অথবা অন্য কোন দৈববিপাকে ব্ৰহ্মা সমাজে উপস্থিত হইতে অশক্ত হয়েন বিশেষতঃ তাঁহাদিগের নিমিত্তে উক্ত সমাজের ব্যাখ্যান সময়ে সময়ে এই পত্রিকাতে প্রকাশিত হইবেক।” ধর্মব্যাখ্যান ছাড়া এতে নীতিগৰ্ভ বিজ্ঞানবিষয়ক এবং অধ্যাত্মতত্ত্ববিষয়ক জ্ঞানোদ্দীপক প্রবন্ধ প্রকাশিত হত। সরল এবং সহজবোধ্য রচনাগুলি বাংলা গদ্যে সংযম ও দৃঢ়তা আনে। অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজনারায়ণ বসু দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রভৃতি মনীষীর রচনামণ্ডিত তত্ত্ববোধিনীর পত্রিকা বাংলা সাময়িকপত্রের যে আদর্শ স্থাপন করিল পরে তাহাই বিবিধার্থ সংগ্রহ, বঙ্গদর্শন, ভারতীতে অনুসৃত হল। তখন থেকে বাংলার শ্রেষ্ঠ লেখকগণ সাময়িক পত্রকে অবলম্বন করিয়াই সাহিত্যের আসরে প্রথম দেখা দিলেন। ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্ররূপে প্রকাশিত হলেও তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা ১৯শ শতকের মধ্যভাগে জ্ঞানবিজ্ঞান ও ভূগোল ইতিহাস সম্বন্ধে সাধারণকে কৌতূহলী করে তুলতে বিশেষ ভূমিকা নেয়। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার প্রকাশ একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।

প্রথম বারো বৎসর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদনা করেন অক্ষয়কুমার দত্ত। তার পর সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অযোধ্যানাং পাকড়াশী, হেমচন্দ্র বিদ্যারত্ন, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিভিন্ন সময়ে এর সম্পাদনা করেন।

অল্পশিক্ষিত জনসাধারণকে বিশেষতঃ অন্তঃপুরবাসিনীদের শিক্ষাচ্ছলে সাহিত্যরসের যোগান দেওয়ার জন্য প্যারীচাদ মিত্র ও রাধানাথ শিকদারের সম্পাদনায় ১৮৫৪ খ্রীঃ ‘মাসিক পত্রিবা’ প্রকাশিত হয়। ভূমিকায় লেখা ছিল “এই পত্রিকা সাধারণের বিশেষতঃ স্ত্রীলোকের জন্য ছাপা হইতেছে। যে ভাষায় আমাদিগের সচরাচর কথাবার্তা হয় তাহাতেই প্রস্তাব সকল রচিত হইবেক। বিজ্ঞ পণ্ডিতেরা পড়িতে চান পড়িবেন কিন্তু তাঁহাদিগের নিমিত্তে এই পত্রিকা লিখিত হয় নাই।”

১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দে বঙ্কিমচন্দ্র ‘বঙ্গদর্শন’ প্রকাশ করেন। বাংলা সাময়িক পত্র ও সাহিত্যের ইতিহাসে বঙ্গদর্শন’ এক অনন্যসাধারণ মর্য্যাদার অধিষ্ঠিত। কর্মে-জ্ঞানে-চিন্তায় শিক্ষিত বাঙ্গালীকে জাগ্রত করার উদ্দেশ্যে বঙ্কিম বঙ্গদর্শন প্রকাশ করেছিলেন। দেশের অতীত ইতিহাস ও প্রাচীন গৌরবের আলাচনার দ্বারা শিক্ষিত বাঙ্গালীর মনে যাতে আত্মসম্মানবোধ সঞ্চারিত হয় সেই জন্যই তার এই অধ্যবসায়। এই সঙ্গে সমাজবোধ জাগ্রত করার চেষ্টা ছিল। রবীন্দ্রনাথ এর ভাষায় “বঙ্গদর্শন আষাঢ়ের প্রথম বর্ষার মতো ‘সমাগতো রাজবদুন্নতধ্বনিঃ’ এবং মুষলধারে ভাববর্ষণে বঙ্গসাহিত্যের পূর্ববাহিনী পশ্চিমবাহিনী সমস্ত নদী নির্ঝরিণী অকস্মাৎ পরিপূর্ণতা প্রাপ্ত হইয়া যৌবনের আনন্দবেগে ধাবিত হইতে লাগিল।” এই সময় সব্যসাচী বঙ্কিম একহাতে মৌলিক সৃষ্টির দ্বারা নূতন রচনা উপহার দিচ্ছেন এবং অন্য হাতে অত্যুৎসাহী লেখকদের সীমাতি আক্রমণের প্রচেষ্টাকে সমালোচনার কঠিন আঘাতে অবদমিত রেখেছিলেন। অর্থাৎ বঙ্গ দর্শনে একাধারে রচনা ও সমালোচনা চলতে থাকে। প্রথম হতেই এই পত্রিকায় ইতিহাস, প্রত্নতত্ব, সাহিত্য সমালোচনা, সঙ্গীত, ব্যঙ্গকৌতুক, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজনীতি, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব বিষয়ক রচনা প্রকাশিত হত। বঙ্গদর্শনের পৃষ্ঠাতেই বঙ্কিমের যাবতীয় সাহিত্য-কর্ম প্রকাশিত হয়েছিল।

ভিন্নরুচি পাঠকসাধারণের সর্বাঙ্গীণ কৌতূহল নিবৃত্তি—সাময়িকপত্রের একটি শ্রেষ্ঠ দায়িত্ব। এই দিক হতে বঙ্গদর্শনের সাফল্য অনস্বীকার্য। বঙ্কিমচন্দ্রকে বাদ দিলে বঙ্গদর্শনের অপরাপর লেখক হলেন হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, চন্দ্রনাথ বসু, অক্ষয়চন্দ্র সরকার, প্রফুল্ল বন্দ্যোপাধ্যায়, রামদাস সেন ও সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

“শিক্ষিত বাঙ্গালীর চিত্ত যখন সুপ্তিসঙ্গীর্ণ গ্রামের বেড়া ভাঙ্গিয়া বঙ্গদর্শনেই পরিতৃপ্তি লাভ করিয়াছে তখন রাজানারায়ণ বসু ও তাঁহার তরুণ বন্ধুরা অখণ্ড ভারতের জাতীয় আদর্শখানি তুলিয়া ধরিলেন।” বঙ্গদর্শনের পরে প্রকাশিত হল ভারতী (১৮৭৮); সম্পাদক দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর পরে স্বর্ণকুমারী দেবী।

সাময়িকপত্রের ইতিহাসে এর পরে রবীন্দ্রনাথের ‘সাধনা’ ও প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজপত্রের’ নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

বাংলা ভাষায় প্রকাশিত সাময়িকপত্রের সংখ্যা সুপ্রচুর। মাসিক, সাপ্তাহিক, বারত্রয়িক ও দৈনিক ইত্যাদি বিভিন্নপর্যায়ে বহু পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। কেবলমাত্র ‘সংখ্যা বৃদ্ধি’ ছাড়াও এদের কিছু মূল্য যে ছিল তাহা অস্বীকার করা যায় না।

সাময়িক পত্র ও বাংলা সাহিত্য :

জনৈক সমালোচক মন্তব্য করিয়াছেন, “১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দ হইতে প্রায় আজ অবধি দেখিতেছি যে, বাংলা গদ্য সাহিত্য (এবং বাংলা আধুনিক সাহিত্য) প্রধানতঃ সাময়িকপত্রের আশ্রয়েই বাড়িয়া উঠিয়ছে। বাংলা গদ্যের শ্রেষ্ঠ লেখকগণের বাহন হইয়াই সংবাদপ্রভাকর, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, বিবিধার্থ সংগ্রহ, মাসিক পত্রিকা, সোমপ্রকাশ, বঙ্গ দর্শন, ভারতী, জ্ঞানাঙ্কুর, আর্যদর্শন, বান্ধব, নবজীবন, সাহিত্য, সাধনা, প্রবাসী, ভারতবর্ষ ও সবুজপত্র ইত্যাদির নাম বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হইয়াছে” দলিল-দস্তাবেজ তর্কাতর্কি ধর্মপ্রচার পুস্তিকা ও পাঠ্যপুস্তক ইত্যাদি ‘কেজো’ রচনার বাহিরে সত্যকার সাহিত্য বলতে যা বোঝায় তার কিঞ্চিৎ আস্বাদ বাঙ্গালী পাঠকের কাছে প্রথম আনিয়া দেয় সাময়িক পত্র৷ সমাচার দর্পণ, সম্বাদ কৌমুদী, সমাচার চন্দ্রিকা, বঙ্গদূত জ্ঞানান্বেষণ, সংবাদপ্রভাকর ইত্যাদি সাময়িকপত্রের দ্বারাই বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার সূত্রপাত।

বাংলা ভাষায় প্রকাশিত সাময়িকপত্রের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এইসকল পত্রিকাগুলি প্রধানত এই কটি উদ্দেশ্য সাধনে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছিল, (১) গদ্যকে জড়তামুক্ত করা, (২) লেখকগোষ্ঠী তৈরী করা, (৩) সাহিত্যের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি ও (৫) জাতীয় চেতনার ক্রমোন্মেযে সহায়তা। সুতরাং সাহিত্যের সহিত সাময়িকপত্রের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধের বিষয়টি অস্বীকার করা যায় না।

তবে সঙ্গে সঙ্গে একথাও স্মরণ রাখতে হবে, ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক হতে শুরু করিয়া আজ পর্যন্ত সাময়িকপত্রে বহুবিধ রচনা প্রকাশিত হলেও, ‘চালুনী দ্বারা ছাঁকিয়া তুলিলে’ সত্যকার সাহিত্য রচনা খুব বেশি মিলবে না। সাময়িকপত্রকে অবলম্বন করিয়া সাহিত্য-সৃষ্টির গুণও আছে, দোষও আছে। একদিকে সাময়িকপত্রগুলি যেমন অনেক সময় সাহিত্যিক গোষ্ঠী গড়ে তুলে সাহিত্যকে গঠন করতে উৎসাহিত করে অন্যদিকে অনেক সময় আবার সে সাময়িক সাহিত্যই গড়ে তোলে। যথার্থ সাহিত্য গড়ে না। বিখ্যাত ইংরাজ সমালোচক রবার্ট লিঙ্ বলিয়াছেন, “…..distinction between journalism and literature is that literature lasts. Literature that does not last is journalism. Journalism that lasts is literature.

তত্ত্ববোধিনী, বঙ্গদর্শন, হিতবাদী, সাধনা, ভারতী প্রভৃতি কয়েকটি পত্রিকার রচনার কথা বাদ দিলে আর যে খুব বেশী সাময়িক সাহিত্যের উৎকৃষ্ট নিদর্শন চোখে পড়বে না তা সত্য। তবু মনে হয়, “এ জগতে কিছুই নিষ্ফল নহে। একখানি সাময়িক পত্রের ক্ষণিক জীবনও…নিষ্কারণ বা নিষ্ফল নহে” –বঙ্কিমচন্দ্রের এই উক্তি সমর্থনযোগ্য৷