বাংলা রচনা : স্বদেশপ্রেম

ভূমিকা : স্বদেশপ্রেম জন্মভূমির জন্যে মানুষের একধরনের অনুরাগময় ভাবাবেগ। স্বদেশপ্রেম বলতে বােঝায় নিজের জন্মভূমিকে ভালােবাসা। জন্মসূত্রে জন্মভূমির সঙ্গেই গড়ে ওঠে মানুষের নাড়ির যােগ। স্বদেশের জন্যে তার মনে জন্ম নেয় নিবিড় ভালােবাসা। এই অনন্য ভালােবাসাই হচ্ছে স্বদেশপ্রেম। 

স্বদেশপ্রেমের স্বরূপ : জন্মভূমির মাটি, আলাে-বাতাস, অন্ন-জলের প্রতি মানুষের মমত্ব অপরিসীম। জন্মভূমির ভৌগােলিক ও সামাজিক পরিবেশের প্রতি থাকে তার একধরনের আবেগময় অনুরাগ। জন্মভূমির ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের সঙ্গে গড়ে ওঠে তার শেকড়ের বন্ধন। স্বদেশের প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি এই অনুরাগ ও বন্ধনের নাম স্বদেশপ্রেম। মা, মাতৃভূমি আর মাতৃভাষার প্রতি গভীর ভালােবাসার আবেগময় প্রকাশ ঘটে স্বদেশপ্রেমের মধ্যে। সেই তীব্র আবেগের পরিচয় আমরা পাই রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ-বন্দনায় :

‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে।
সার্থক জনম মা গাে, তােমায় ভালােবেসে।
‘ 

স্বদেশপ্রেম মানুষের অন্তরে সদা বহমান থাকে। বিশেষ সময়ে, বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে তা আবেগউদ্বেল হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ শাসনামলে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও সুকান্তের দেশাত্মবােধক গানে-কবিতায় স্বদেশপ্রেমের আবেগময় প্রকাশ দেখা যায়। ১৯৩০-এ মাস্টারদা-র নেতৃত্বে চট্টগ্রাম যুব-বিদ্রোহ স্বদেশপ্রেমেরই বলিষ্ঠ প্রকাশ। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে সমগ্র জাতির ঐক্যবদ্ধ সগ্রামে স্বদেশপ্রেমের চূড়ান্ত অভিব্যক্তি ঘটেছে। স্বদেশপ্রেম দেশ ও জাতির অগ্রগতির লক্ষ্যে জ্বলন্ত প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে একপ্রাণ হয়ে মহৎ লক্ষ্য সাধনে ব্রতী করে।

 স্বদেশপ্রেমের ভিন্নতর বহিঃপ্রকাশ : কেবল স্বাধীনতা অর্জন কিংবা স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামেই দেশপ্রেম সীমাবদ্ধ থাকে না, দেশকে সমৃদ্ধিশালী করাতেও স্বদেশপ্রেমের অভিব্যক্তি ঘটে। শিল্প-সাহিত্য চর্চায় কিংবা জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনায় স্বদেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। দেশের কল্যাণ ও অগ্রগতিতে ভূমিকা রেখে, বিশ্বসভ্যতায় অবদান রেখে বিশ্বসভায় দেশের গৌরব বাড়ানাে যায়। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জগদীশচন্দ্র বসু, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, এফ আর খান, ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রমুখের অবদানে বিশ্বে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। 

স্বদেশপ্রেমের বিকৃত রূপ : স্বদেশপ্রেম পবিত্র। তা দেশ ও জাতির জন্যে গৌরবের। কিন্তু উগ্র ও অন্ধ স্বদেশপ্রেম কল্যাণের পরিবর্তে রচনা করে ধ্বংসের পথ। অন্ধ স্বদেশপ্রেম উগ্র জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়। তা জাতিতে জাতিতে সংঘাত ও সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। জার্মানিতে হিটলার ও ইতালিতে মুসােলিনি উগ্র জাতীয়তা ও অন্ধ দেশপ্রেমের নগ্ন বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিল। তার ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লাখ লাখ লােকের মৃত্যু ঘটেছিল। বিপন্ন হয়েছিল বিশ্বমানবতা।। স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেম : স্বদেশপ্রেম বিশ্বপ্রেমেরই একটি অংশ। দেশকে ভালােবেসে মানুষ বিশ্বকে ভালােবাসতে পারে। তাই প্রকৃত স্বদেশপ্রেম কখনাে বিশ্বপ্রেমের পথে বাধা হতে পারে না। বস্তুত, বিশ্বমায়ের বুকের আঁচলের ওপর দেশজননীর ঠাই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর অমর বাণীতে বলে গেছেন সে কথা

‘ও আমার দেশের মাটি, তােমার পরে ঠেকাই মাথা।
তােমাতে বিশ্বময়ীর, তােমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।’

দেশপ্রেমের উজ্জ্বল প্রতিভূ : অনন্য দেশপ্রেমের অনেক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রয়েছে দেশে দেশে। সারা বিশ্বের মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালােবাসায় সিক্ত তাঁরা। উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অসামান্য অবদান রেখেছেন অনেক বাঙালি। তাঁদের মধ্যে নেতাজি সুভাষ বসু, চিত্তরঞ্জন দাস, এ. কে. ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, প্রমুখ চিরদিন আমাদের প্রেরণা হয়ে থাকবেন। বিশ্বের দেশে দেশে বহু রাষ্ট্রনায়ক দেশ ও জাতিকে নবচেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন। ইতালির গ্যারিবান্ডি, আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন, রাশিয়ার লেনিন, চিনের মাও সে তুং, ভিয়েতনামের হাে চি মিন, তুরস্কের মােস্তফা কামাল পাশা, ভারতের মহাত্মা গান্ধী এবং বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ রচনা করেছেন দেশপ্রেমের অমরগাথা। 

উপসংহার : স্বদেশপ্রেম এক জ্বলন্ত মহৎ প্রেরণা। সে প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে আমরা ব্যক্তিগত স্বার্থচেতনার ঊর্ধ্বে উঠি। যুক্ত হই সমষ্টির কল্যাণচেতনায়। দেশের সংকটে ঐক্যবদ্ধ হই। সব অমঙ্গল থেকে দেশ ও দেশবাসীকে রক্ষা করতে সচেষ্ট হই। দেশের উন্নতি ও অগ্রগতিতে সাধ্যমতাে অবদান রাখি। স্বদেশপ্রেমের ভেতর দিয়েই আমরা বিশ্বপ্রেমের সেতুবন্ধ রচনা করতে পারি।