বাংলা রচনা : সময়ের মূল্য |
সময়ের মূল্য
অথবা, সময়ের সদ্ব্যবহার
[ সংকেত : ভূমিকা; সময়ের গুরুত্ব; সময়ের চলমানতা; মানবজীবন ও সময়; সময়ানুবর্তিতার দৃষ্টান্ত; মানুষের কতব্য; সময়ের যথাযথ ব্যবহার; সময় অবহেলার পরিণাম; ছাত্রজীবনে সময়ের গুরুত্ব; উপসংহার । ]
ভূমিকা : মানুষের জীবনে সর্বাপেক্ষা মূল্যবান সম্পদ সময় । কেননা সময়ের যথাযথ ব্যবহারের ওপরই মানুষের জীবনের পাহ নির্ভর করে। একজন মানুষ সময়কে যেমন মূল্যায়ন করবে সে তেমনি ফল পাবে। তাই সময়ের কাজ সময়ে করাই ভালাে। একবার যে সময় অতীত হয়ে যাবে সে সময় আর কখনাে ফিরে আসবে না। সময়কে মূল্যায়ন করতে হবে সবকিছুর উর্ধ্বে। সময়ের সদ্ব্যবহারই পারে আমাদের ক্ষণস্থায়ী জীবনকে স্মরণীয় করে রাখতে। তাই ছন্দময় ও গতিময় সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। সময়ের গুরুত্ব সম্পর্কে MK Ghandi বলেছেন, ‘Time is life, Life is time. Balance between life and time can help one reach the highest apex of success.’
সময়ের গুরুত্ব : একটি পরিচিত প্রবাদ হলাে, ‘Time and tide wait for none.’ সময় ও স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না। মানুষের আয়ু বা জীবনকাল সীমিত । কিন্তু মানুষকে এই সীমাবদ্ধ জীবনে অনেক কাজ, অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয় । তাই প্রতিটি মুহূর্ত খুব গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান। এই মূল্যবান সময় বা মুহূর্তকে যথাযথভাবে কাজে না লাগিয়ে হেলায় অতিবাহিত করলে। জীবনের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যায়। পরবর্তীতে এই ক্ষতির জন্য আফসােস করা যায় কিন্তু সেই সময়কে আর ফিরিয়ে আনা যায় না । তাই জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত বা সময়ের মূল্য অপরিসীম। কোনাে পার্থিব সম্পদের মানদণ্ডে সময়ের মূল্য নিরূপণ করা সম্ভব নয়। তাই অত্যন্ত সতর্কতার সাথে সময়ের সদ্ব্যবহার করা উচিত।
সময়ের চলমানতা : কবি হেমচন্দ্র বলেনㅡ
দিন যায় ক্ষণ যায় সময় কাহারাে নয়
বেগে ধায়, নাহি রহে স্থির।
অনাদিকাল থেকে অনন্তের পথে আপন বেগে ছুটে চলেছে সময়। সময়ের ছুটে চলার মধ্যে কোনাে বাধা নেই, নেই কোনাে অলসতা । নিরলস ছুটে চলার জন্যই সময়ের মূল্য অপরিমেয়, অসীম। কোনাে কিছুর বিনিময়ে তাকে এক মুহূর্তের জন্য স্থির করা যায় না । আপন বেগে ধেয়ে চলে সময়। মূল্যবান সময়ের ধাবমানতার সাথে যে ধেয়ে চলতে পারে সেই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকতে পারে এই। ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে। সময়কে হাতে পেয়ে অবহেলায় জীবন কাটালে জীবন সায়াহ্নে হাহাকার করে কোনাে লাভ হয় না। বয়ে যাওয়া সময় কখনাে ফিরে আসে না। সময় স্রোতের মতাে কেবল এগিয়ে চলে, কখনাে থামতে জানে না। তাই সময়ের ক্ষেত্রে ইংরেজ কবি লর্ড টেনিসনের ‘Brook’ কবিতার পঙুক্তি দুটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকㅡ
‘Men may come and men may go
But I go on for ever.’
মানবজীবন ও সময় : জীবনকে সার্থক ও পরিপূর্ণ করতে হলে সময়ের মূল্য সম্বন্ধে সচেতন থাকতে হবে। মানুষের আয়ুষ্কাল সীমিত, অথচ তার সম্মুখে বিশাল কর্মক্ষেত্র । কাজেই এই সীমিত সময়ের মধ্যে তাকে সমুদয় কর্ম সুচারুভাবে সম্পাদন করতে হবে । কর্মহীন বা কর্মবিমুখ জীবন অসার ও নিরর্থক। মানুষের খাওয়া, পরা, শােয়া, ঘুম প্রভৃতির যেমন নির্দিষ্ট সময় আছে তেমনি অন্যান্য প্রয়ােজনীয় কাজের জন্যও সময়কে ভাগ করে নেওয়া দরকার । জীবনের লক্ষ্য স্থির করে কর্তব্য অনুযায়ী সময়কে ভাগ করে জীবনে। সাফল্য অর্জন করা সম্ভব । এলােমেলােভাবে কাজ করলে কিংবা লক্ষ্যহীনভাবে কাজ করলে কোনাে কাজেই সফলতা আসে না । এতে সময়ের অপচয় হয়। কাজেই সময়ের সদ্ব্যবহার করতে হলে জীবনের লক্ষ্য বা কাজের লক্ষ্য আগে নির্ধারণ করতে হবে। নির্ধারিত সময়ে নির্ধারিত কাজ সম্পাদন করার জন্য বিশেষভাবে যত্নবান হতে হবে । আমরা সময়ের মূল্য বুঝি না বলেই সময়ের সদ্ব্যবহার করতে পারি না। ফলে বহু অমূল্য সময় অযথা নষ্ট হয়ে যায় । মানুষের জীবনে সাফল্যের মাপকাঠি সময়ের মূল্য সম্বন্ধে সচেতনতার ওপর নির্ভর করে। মহাপুরুষ ও বিখ্যাত মনীষী কিংবা পৃথিবীর খ্যাতিমান ব্যক্তিদের জীবনী পড়লে দেখা যায় যে, তারা যে সময়ে যে কাজটা করা প্রয়ােজন মনে করতেন, ঠিক সেই সময়েই সেটা করতেন। আজকের কাজ আগামী দিনের জন্য ফেলে রাখতেন না । নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট কর্তব্য সম্পাদন করা ছিল তাদের জীবনের বৈশিষ্ট্য।
সময়ানুবর্তিতার দৃষ্টান্ত : হারিয়ে যাওয়া ধন ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে কিন্তু হারানাে সময় আর ফিরে পাওয়া যায় না। কাজেই সময়কে কাজে লাগাতে হবে। সময় যেন এক শস্যক্ষেত্র, আর মানুষ হলাে কৃষক। মানুষ ইচ্ছা করলে এই ক্ষেত্রে মহামূল্যবান সম্পদ সৃষ্টি করতে পারে। আবার অবহেলা করলে এই মূল্যবান ক্ষেত্র আগাছায় ভরে যায়। তখন সময় যেমন বিফলে যায় তেমনি জীবনও হয় ব্যর্থ। অথচ আমাদের এ সম্বন্ধে কোনাে সচেতনতা নেই। সময়ের কাজ সময়ে না করাই বাঙালির স্বভাব । অথচ ইংল্যান্ড, আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, জাপান প্রভৃতি দেশের মানুষ সময়ের সদ্ব্যবহার করায় আজ উন্নতির উচ্চ শিখরে আরােহণ করেছে। জাপানি জাতি সময়ের মূল্য বুঝে আজ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতিসমূহের মধ্যে অন্যতম হয়েছে। ইংরেজরা সময়ানুবর্তিতার বলে পৃথিবী শাসন। করেছিল। অথচ বাঙালি কাজ পায় না । আলস্য পরবশ হয়ে কত মূল্যবান সময় হেলায় অতিবাহিত করে।
মানুষের কর্তব্য : মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী হলেও কর্মগুণে তার জীবনের গৌরব চিরস্থায়ী হয়। তখন মানুষ মরেও বেঁচে থাকে মানুষের হৃদয়ে । মানুষের সামনে অফুরন্ত শিক্ষাক্ষেত্র এবং বিশাল কর্মজগৎ রয়েছে। মানুষ যদি সময়ের অপচয় না করে প্রতিটি সম্ভাবনাময় মুহূর্তকে কাজে লাগিয়ে সার্থক করে তুলতে পারে, তাহলে তার ক্ষণস্থায়ী জীবন জ্ঞান ও কর্মের মহিমায় অনন্তকাল ধরে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। সেজন্য একটি ক্ষুদ্র মুহূর্তও অপচয় না করে যথাসময়ে কাজ করে নিজেকে চিরস্মরণীয় করতে হবে ।
সময়ের যথাযথ ব্যবহার : ক্ষণস্থায়ী জীবন নিয়ে মানুষ পৃথিবীতে এসেছে। কিন্তু সামনে বিশাল এক কর্মক্ষেত্র। সংক্ষিপ্ত জীবনে বিশাল কর্মক্ষেত্র পাড়ি দিতে প্রয়ােজন সময়ের যথাযথ ব্যবহার ও কর্ম সম্পাদনের পরিকল্পনা। অন্যথায় জীবন ফুরিয়ে যাবে কিন্তু কর্ম ফুরাবে না। সুতরাং সময়ের কাজ সময়ে করতে হবে। আর তাই প্রথমে জীবনের লক্ষ্য স্থির করে সময় ভাগ করে নিতে হবে এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে হবে ।
এলােমেলােভাবে কাজ করলে কখনাে লক্ষ্যে পৌঁছানাে সম্ভব হবে না। প্রতিটি কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করতে হবে। তবেই জীবনে সাফল্য আসবে এবং কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানাে সম্ভব হবে। সময়কে মূল্য দিয়ে ক্ষণস্থায়ী জীবনকে অমরত্বের মহিমা দান করা যায়। কবির ভাষায়ㅡ
সময়ের মূল্য বুঝে যারা করে কাজ
মরেও অমর তারা পৃথিবীর মাঝ ।
সময় অবহেলার পরিণাম :
নিতান্ত নির্বোধ সেই শুধু যেই জন
অমূল্য সময় করে বৃথায় যাপন ।
পৃথিবীতে যারা নির্বোধ তারাই অলস জীবনযাপন করে। অলসরা অমূল্য সম্পদকে মূল্যায়ন করতে জানে না। মানবজীবন সামান্য। সময়ের গণ্ডিতে বাঁধা। সময়ের সামান্য সুযােগ চলে গেলে আর ফিরে পাওয়া সম্ভব হয় না। প্রচলিত প্রবাদে বলা হয়, সময়ের একফোঁড়, অসময়ের দশফোঁড়। তাই সময়ের কাজ সময়েই করতে হবে। সময়কে অবহেলা করলে ব্যর্থতা জীবনকে ঘিরে ধরবে, জীবনের সমস্ত সুখ কল্পনাই থেকে যাবে। অনুশােচনা আর ব্যর্থতার সমুদ্রে ডুবে মরবে আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলাে। সময়কে অবহেলা করা মানে সুন্দর কল্পনাকে ধ্বংস করা। তাই সময়কে অবহেলা না করাই শ্রেয়।
ছাত্রজীবনে সময়ের গুরুত্ব : ছাত্রজীবন মধুর জীবন, ছাত্রজীবন সুখের জীবন। মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ছাত্রজীবন । এ সময় | মানুষের জীবনের চাবিকাঠি, ভিত্তিভূমি। ছাত্রজীবনে সাফল্যের সােপান তৈরি করার সুযােগ আসে। তাই এই সময়কে গুরুত্ব দিয়ে ভবিষ্যতের ভিত্তি প্রস্তুত করতে হয়। এ জীবনে যে সময়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দেবে সেই ভবিষ্যতে গৌরবময় ভূমিকা রাখতে পারবে । যে এ জীবনে অবহেলা করবে তার ভবিষ্যৎ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে । তাই ছাত্রদের উদ্দেশে বলা যায়ㅡ
খেলায় মজিয়া শিশু
কাটাইও না বেলা
সময়ের প্রতি কভু।
করিও না হেলা।
উপসংহার : জীবনে সাফল্য অর্জন করতে হলে সময়ের মূল্য সম্বন্ধে সচেতন থাকা বাঞ্ছনীয়। বিশ্বের উন্নত জাতি কিংবা দেশসমূহের উন্নতির মূলে রয়েছে সময় জ্ঞানের সচেতনতা। তাদের কাছে পার্থিব সম্পদের চেয়ে সময় অধিক মূল্যবান বলেই তারা সম্পদে, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে উন্নতির উচ্চশিখরে আরােহণ করছে। পক্ষান্তরে, আমরা বাঙালিরা সময়ের মূল্য বুঝি না বলেই দুঃখ-দুর্দশা আমাদের নিত্যসঙ্গী। আমরা আজ পৃথিবীর দরিদ্র জাতি ও দেশ হিসেবে পরিচিত। কাজেই ব্যক্তিগত এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে সাফল্য আনতে হলে সময়ের মূল্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে । তাই আমাদের দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার ছাত্রদের সময়ানুবর্তিতা মেনে চলা একান্ত আবশ্যক। সময়ের মূল্য সম্বন্ধে সচেতন হলে জীবন সাফল্যের আনন্দে ভরপুর ও রসময় হয়ে উঠবে।
Leave a comment