বাংলা রচনা : মানবাধিকার

মানবাধিকার
অথবা, মানবাধিকার ও বাংলাদেশ

[ সংকেত : ভূমিকা; মানবাধিকার; মানবাধিকারের পটভূমি; মানবাধিকারের ক্রমবিকাশ; মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘােষণা; বাংলাদেশের সংবিধানে মানবাধিকারের স্বীকৃতি; বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘন; মানবাধিকারের বর্তমান অবস্থা; বাংলাদেশে মানবাধিকার রক্ষায় করণীয়; মানবাধিকার রক্ষায় আইনের প্রয়ােগ; উপসংহার । ]

ভূমিকা : মানুষের জীবনের সাথে ‘অধিকার’ শব্দটি ওতপ্রােতভাবে জড়িত। ধনী, গরিব, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গােত্র নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের অধিকার থাকা চাই। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে অধিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অধিকার ছাড়া কোনাে মানুষ স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করতে পারে না। প্রত্যেক মানুষকে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য চাই কতকগুলাে অধিকার। অথচ বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে ।

মানবাধিকার : সংক্ষেপে মানবাধিকার বলতে যা বুঝি তা হলাে মানুষের অধিকার। মানুষের অধিকার মানেই হলাে মানবাধিকার । মানুষের মৌলিক অধিকারসহ সকল প্রকার অধিকার মানবাধিকারের অন্তর্ভুক্ত। তবে মানবাধিকার বিষয়টি অনেকাংশে দেশ-কাল ও ব্যক্তির ওপর নির্ভর করে। যেমন- একজনের জন্য যা মানবাধিকার, অন্যজনের জন্য তা মানবাধিকার নয়। এক দেশের জন্য যা মানবাধিকার, অন্য দেশের জন্য তা মানবাধিকার নাও হতে পারে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘােষণাপত্র গৃহীত হয় ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর।

মানবাধিকারের পটভূমি : প্রাচীনকাল থেকে মানুষের মধ্যে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গােত্র ইত্যাদি নিয়ে ভেদাভেদ ও হানাহানি হয়ে আসছিল। তাছাড়া নানা কারণে একই জাতি বা ধর্মের মধ্যেও দ্বন্দ্ব-সংঘাত হচ্ছে। বিভিন্ন প্রকার দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধের অভিজ্ঞতার আলােকে মানুষ আজ সচেতন হয়েছে। তাই বিশ্বে শান্তি, শৃঙ্খলা গড়ে তুলতে মানবাধিকার সনদ সৃষ্টি হয়েছে। 

মানবাধিকারের ক্রমবিকাশ : পৃথিবীর প্রাচীনতম আইন সংকলন করেছিলেন ব্যাবিলনের রাজা হাম্বুরারি । তিনি খ্রিষ্টপূর্ব দুই হাজার বছরেরও আগে তাঁর নিয়মাবলিতে মানবাধিকারের প্রাচীনতম ধারার পরিচয় দিয়েছিলেন। তারপর খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতকে মহানবি হজরত মুহাম্মদ (সা.) কর্তৃক প্রণীত ‘মদিনা সনদ’-এ জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমঅধিকারের পূর্ণ স্বীকৃতি পাওয়া যায় । ইংল্যান্ডে ম্যাগনাকার্টা’ প্রণীত হয় ১২১৫ খ্রিষ্টাব্দে। এই ম্যাগনাকার্টাকে মানবাধিকারের প্রথম চার্টার বলা হয়। তাছাড়া কার্ল মার্কস, রুশাে, জন লক, হুগাে প্রমুখ বিখ্যাত মনীষীদের রচনায় মানবাধিকারের ধারণা পাওয়া যায়। পরবর্তী সময়ে আমেরিকার ‘স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র, ফরাসি বিপ্লবের মানবাধিকার সনদ’, রুশ বিপ্লবের বাণী মানবাধিকার আন্দোলনের একটি বড়াে অর্জন। আমেরিকার সংবিধানে দাস প্রথা অবৈধ ঘােষণা এবং মানবাধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে একটি বিরাট সাফল্য হিসেবে চিহ্নিত।

মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘােষণা : জার্মানি ও ইতালির জাতিগত বিদ্বেষের কারণে বিশ্বযুদ্ধের মতাে বর্বর ও চরম নৃশংসতার সৃষ্টি হয়েছিল। বন্দিশিবিরে লক্ষ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করা হলে বিশ্ববাসীর বিবেক মানবাধিকার রক্ষায় সােচ্চার হয়ে ওঠে। ১৯৩৯-১৯৪৫ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলে। এমন প্রলয়ংকরী মানববিধ্বংসী যুদ্ধ বন্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোতে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতিসংঘ। জাতিসংঘ সনদের দলিলে আন্তর্জাতিক পরিসরে মানব জাতির অধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং বলা হয় মৌল মানবিক অধিকার, মানুষের মর্যাদা, ছােটো-বড়াে, জাতি-গােত্র, ধর্ম-বর্ণ, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকারের প্রতি এ সংস্থা পুনরায় আস্থা রাখার অঙ্গীকার করছে। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘােষণাটি ৩০টি ধারা সংবলিত। যার মধ্যে ১৯টি ধারা নাগরিক ও রাজনীতিক অধিকার সম্পর্কিত। এসব ধারা বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকার নামে পরিচিত।

বাংলাদেশের সংবিধানে মানবাধিকারের স্বীকৃতি : স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান। গণপরিষদে গৃহীত হয়। এটি দেশের সর্বস্তরের জনগণের জন্য পবিত্রতম একটি দলিল। সংবিধানের ৭(১)নং অনুচ্ছেদে আছে ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। বাংলাদেশ সংবিধানে জনগণের জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা, কর্ম, বেকারত্ব, বিশ্রাম, অবকাশ, ব্যাধিসহ বিভিন্ন বিষয়ে মুক্তির নিশ্চয়তা প্রদান করেছে। তাছাড়াও শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাম্য, বাকস্বাধীনতা, সম্পত্তির অধিকার ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানবাধিকার সংরক্ষণ ও বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’

বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘন : বাংলাদেশের মানুষ মানবাধিকার বঞ্চিত হচ্ছে। ক্ষমতার লােভে মানুষ অন্যের অধিকার খর্ব করে নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করছে । ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা ক্ষমতার দাপটে মানুষের অধিকার হরণ করছে, সংবিধানের নিয়মকে চরমভাবে ব্যাহত করছে। সরকার নিজের ক্ষমতাকে দীর্ঘদিন স্থায়ী করার জন্য মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত করে মনগড়া আইন প্রণয়ন করে। এসব কারণে সাধারণ মানুষ যেমন মানবাধিকার বঞ্চিত হচ্ছে তেমনি বিশ্বের দরবারে দেশবাসীর মাথা নিচু হচ্ছে। জনগণের অধিকার রক্ষা। করতে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে বহুবার মানবাধিকার আইন প্রণয়ন করা হয়েছে ।

মানবাধিকারের বর্তমান অবস্থা : সমগ্র বিশ্বে প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষ নানাভাবে মানবাধিকার বঞ্চিত হচ্ছে। পৃথিবীর প্রায় দুই তৃতীয়াংশ মানুষ এর শিকার হচ্ছে। পৃথিবী জুড়ে দেখা যায়, নারী-পুরুষের সমঅধিকার এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। শিক্ষা সুযােগ নয়, শিক্ষা মানুষের অধিকার। বিভিন্ন দেশে অসংখ্য মানুষ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দুবেলা দুমুঠো খেতে না পেয়ে অনেক মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। নানান রােগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ন্যূনতম চিকিৎসা-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে অনেকে। তাই বলা যায়, সর্বদিক থেকে বিশ্বে মানবাধিকার লজিত হচ্ছে এবং সর্বক্ষেত্রে তার বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

বাংলাদেশ মানবাধিকার রক্ষায় করণীয়: অর্থনীতি ও রাজনীতির দিক থেকে ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা সাধারণ মানুষের অধিকার খর্ব করছে। এতে দেশের সাধারণ জনগণ, সৎ নাগরিক ও সমাজসেবী কল্যাণকামীরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ছেন। এমন বিপর্যয়ের দিনে দেশের সাধারণ জনগণসহ সকল শ্রেণির জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। ক্ষমতাবান অপরাধী চক্রের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে সকল শ্রেণির মানুষকে সরকারকে সহায়তা করতে হবে।

মানবাধিকার রক্ষায় আইনের প্রয়ােগ : ক্ষমতাবান, অন্যায়কারী ও দুর্নীতিবাজ মানুষের হাতে নানাভাবে বাংলাপের মানুষের। মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। বাংলাদেশের মানবাধিকারের এমন বিপর্যয় থেকে উত্তরণের জন্য আইনের আশ্রয় নিতে হবে, সঠিকভাবে আইন প্রয়ােগ করতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের কয়েকটি বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। যেমনー

১. জনগণকে আইনের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে।
২. আইনকে সার্বিকভাবে সহায়তা করতে হবে ।
৩. প্রত্যেককে নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।
৪. নিজেদের ভােটাধিকার সম্পর্কে অবগত হতে হবে এবং জাল ভােট থেকে বিরত থাকতে হবে।
৫. আইন প্রণয়নের মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করতে হবে।
৬. নির্যাতিত ব্যক্তিদের আইনের আশ্রয় নিতে হবে ।
৭. মানবাধিকার রক্ষায় সরকারের সদিচ্ছা থাকতে হবে।

উপসংহার : বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই বিভিন্ন দিক থেকে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। ক্ষমতালিম্পু ব্যক্তিরা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে নিরীহ মানুষকে অধিকার বঞ্চিত করে। এসব ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের বেশি দিন সুযােগ দেওয়া যাবে না। প্রত্যেক নাগরিককে তাদের নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং প্রয়ােজনে আইনের আশ্রয় নিতে হবে। তাহলেই মানবাধিকার বিশ্বব্যাপী ঈপ্সিত মাত্রায় রক্ষিত হবে ।