মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান

[ রচনা সংকেত : সূচনা, বিদেশি ভাষায় শিক্ষার ত্রুটি, বাঙালির ইংরেজি শিক্ষার কারণ, বিদেশি ভাষার আধিপত্যের কুফল, মাতৃভাষার সমৃদ্ধি ও উপযোগিতা, মাতৃভাষার গুরুত্ব, উপসংহার। ]

 সূচনা : 

“ নানান দেশের নানান ভাষা
বিনা স্বদেশী ভাষা
পুরে কি আশা ? ”

কবি রামনিধি গুপ্তের এ পক্তিগুলো থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায়, মাতৃভাষা ছাড়া পরিপূর্ণভাবে শিক্ষা লাভ সম্ভব নয়। মনের কথা প্রকাশ করতে মায়ের ভাষার জুড়ি নেই। এতে কোন জড়তা নেই— নেই কোন প্রতিবন্ধকতা। মাতৃভাষায় সবকিছু বোঝা সম্ভব যা অন্য ভাষায় সম্ভব নয়। সত্যি কথা বলতে কি ধর্ম শিক্ষা, বিজ্ঞান শিক্ষায় আমরা পিছিয়ে আছি একমাত্র মাতৃভাষার মাধ্যমে লেখাপড়া করতে পারছি না বলেই। ইংরেজি ভাষা যতটা দুর্বোধ্য আরবি তার চেয়েও দুর্বোধ্য। কিন্তু হাতে গোনা কয়েকজন লোক বিদেশি ভাষায় প্রবন্ধ লিখেছেন, বিবর্তনমূলক আইনের খসড়া রচনা করেছেন, আপামর জনসাধারণ এতে অংশগ্রহণ করতে পারেনি।

বিদেশি ভাষায় শিক্ষার ত্রুটি : নিজের ভাষাকে বাদ দিয়ে বিদেশি ভাষায় শিক্ষা লাভে প্রকৃত সুফল পাওয়া যায় না। তাতে অনেক ফাঁক থেকে যায়— অনেক কিছুই আমরা বুঝে উঠতে পারি না। অনেক ক্ষেত্রে না বুঝেই আমাদের অনেক কিছু মুখস্থ করে পরীক্ষায় পাস করতে হয়। এতে প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধিত হয় না। বিদেশি ভাষায় শিক্ষা গ্রহণে সময়ের অপচয় ঘটে। যে পরিমাণ আমরা শিক্ষা গ্রহণ করেছি, সে পরিমাণ বিদ্যা আমরা পাইনি। এ ত্রুটি শক্তির অপচয়, সম্পদের অপচয়। রবীন্দ্রনাথ তাই দুঃখ করে বলেছেন, “চারিদিকের আবহাওয়া থেকে এ বিদ্যা বিচ্ছিন্ন, আমাদের ঘর আর স্কুলের মধ্যে ট্রাম চলে। মন চলে না।” বিদেশি ভাষার বিরোধিতা নয় বরং বিদেশি ভাষা থেকে রত্নরাজি মন্থন করে স্বদেশী ভাষাকে সমৃদ্ধ করাই হচ্ছে আমাদের যুক্তি। তাতে আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবো সন্দেহ নেই।

বাঙালির ইংরেজি শিক্ষার কারণ : বাঙালির ইংরেজ প্রীতির পেছনে রয়েছে দুইশ বছরের ইতিহাস। ইংরেজ শাসনামলে তারা মুষ্টিমেয় দক্ষ আমলা ও কেরানিকুল সৃষ্টি করে তাদের শাসন ব্যবস্থা জোরদার করার লক্ষ্যে আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল ইংরেজি ভাষা। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ভাষা প্রবর্তনের ফলে ইংরেজদের সাম্রাজ্যিক উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল। আমাদের দেশের কতিপয় লোক ইংরেজি ভাষা শিক্ষা করার মধ্যদিয়ে ইংরেজ আনুগত্য লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল। সমাজের মুষ্টিমেয় লোক লাভবান হলেও, সিংহভাগ লোক ছিল এ সুবিধে হতে বঞ্চিত। পাকিস্তানি আমলে ইংরেজি ভাষার দাপট তো ছিলই তার ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয় উর্দুকে। কিন্তু বীরের জাতি বাঙালি এ অবিচার বেশিদিন মেনে নেয়নি। ১৯৫২ সালে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমাদের মাতৃভাষা প্রীতি বৃদ্ধি পায়। ভাষার জন্য লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে শিক্ষার মাধ্যমসহ সর্বস্তরে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চলে।

বিদেশি ভাষার আধিপত্যের কুফল : বিদেশি ভাষার আধিপত্য কখনও কোন দেশের অনুকূল বলে বিবেচিত হতে পারে না। ইংরেজ শাসনামলের দুইশ’ বছরের ইতিহাসই এর প্রমাণ। বিদেশি ভাষা আয়ত্ত করতে গিয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা ও চর্চায় আমরা পিছিয়ে পড়েছি। দেশের সব জনগণকে বিদেশি ভাষায় শিক্ষিত করা বাস্তবে সম্ভব না হলেও সেটা করতে গিয়ে দেশের বৃহত্তর জনসমাজকে অশিক্ষা ও অজ্ঞতার অন্ধকারে ফেলে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে ইংরেজি শিক্ষিত এমন একটি বিশেষ শ্রেণী গড়ে উঠেছে যারা মন মানসিকতায় সাধারণ জনগণের কাছ থেকে নিজেদের ক্রমেই দূরে সরিয়ে নিচ্ছে। ইংরেজি শিখতে গিয়ে এ শ্রেণীর লোকেরা দেশের প্রতি অবজ্ঞা ও শ্রদ্ধাহীনতার মনোভাব তৈরি করছে। তারা নিজেদের সন্তানদের ইংরেজি মিডিয়ামে শিক্ষিত করতে পেরে গর্বে ফেটে পড়ছে। পক্ষান্তরে, যাদের সন্তানেরা বাংলা মাধ্যমে লেখাপড়া করছে, তাদের অবজ্ঞার চোখে দেখছে।

মাতৃভাষার সমৃদ্ধি ও উপযোগিতা : শিশুর মুখে বুলি ফোটে যে ভাষায়, নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে যে ভাষা মিশে থাকে, সে মাতৃভাষার মাধ্যমেই লেখাপড়া শেখা সম্ভব। বর্তমানে আমাদের দেশে শিক্ষিতের হার বেড়ে যাওয়ার একমাত্র কারণ মাতৃভাষায় লেখাপড়ার সুযোগ। আমাদের মনে এমন একটা ধারণা কাজ করত যেন, আশীর্বাদপুষ্ট কয়েকজন ছাড়া বিদ্যা শিক্ষা করতে পারবে না। কেন ? একমাত্র বিদেশি ভাষার কারণে। তাই ভাষাবিদ, কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে— শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষার সমৃদ্ধি সাধনে। সাধারণের মাঝে শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হলে মাতৃভাষাই একমাত্র শিক্ষার বাহন হতে হবে। রবীন্দ্রনাথের কথা বলা যায়— “ইউরোপীয় বিদ্যা ইংরেজি ভাষার জাহাজে করে এদেশের শহরে বন্দরে আসতে পারে, কিন্তু পল্লীর আনাচে-কানাচে তাকে পৌঁছে দিতে হলে দেশি ভাষার ডিঙ্গি নৌকার প্রয়োজন।”

মাতৃভাষার গুরুত্ব : এজন্যই বলা হয়, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা লাভ ও চিন্তার উৎকর্ষতা আদান- প্রদানে কতগুলো সাধারণ সুবিধে রয়েছে। এক এক দেশের ভাষায় সে দেশের শিক্ষা সংস্কৃতির আলাদা আলাদা ধারা প্রবাহিত হয়। বলার চেয়ে লেখ্য ভাষার গুরুত্ব বেশি। তাই যদি মাতৃভাষায় সবকিছু লেখা যায় তাহলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার্জনে আর কোন বাধা কোথায় ? অপাংক্তেয় বলে কিছুই থাকবে না, দুর্বোধ্য বলে কেউ বই-পুস্তক তালাচাবি দিয়ে পালিয়ে বেড়াবে না । আমাদের দেশে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল কেন ? কেন তাজা প্রাণ ঝড়ে পড়েছিল মাতৃভাষার সর্বজনীনতার দাবিতে ? উত্তর একটাই—মাতৃভাষাকে অস্বীকার বা অবমাননা করা মানে নিজেকে অস্বীকার করা। এ দাবি প্রতিষ্ঠার জন্যই ভাষার জন্যে আন্দোলন করতে হয়েছিল।

আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা যখন জাপানে, জার্মানিতে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য যায়— সেখানে তাদের প্রথমে সেসব দেশের ভাষা শিখতে হয়। তাহলে সে দেশের ভাষায় কি তারা সমৃদ্ধ নয় ? তারা কি সেখানে বিজ্ঞানে পিছিয়ে রয়েছে ? মোটেও না। তাই মাতৃভাষার গুরুত্ব অবশ্যই দেয়া উচিত।

জাতীয় উন্নতি ও মাতৃভাষা : মাতা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি এ তিনটি পরম শ্রদ্ধার বিষয়। মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে পৃথিবীর কোন জাতি উন্নতি করতে পারেনি। অর্থনৈতিক অগ্রগতির জাতির সংস্কৃতির একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। মাতৃভাষাকে অবলম্বন করেই কোন জাতির সংস্কৃতির বিকাশ সাধিত হয়। মাতৃভাষার উপর ভিত্তি করেই জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধিত হয়। যারা মাতৃভাষার মর্যাদা দিতে পারে না তারা জাতীয় উন্নয়নও করতে পারে না। সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী বলেছেন, “পৃথিবীতে যখন যে জাতি গৌরবের পতাকা উড়াইয়াছেন তখনই দেখিতে পাইবেন, সে জাতি আপনার মাতৃভাষাকে পরিপুষ্ট সমলঙ্কৃত পরিপূর্ণ এবং সমুজ্জ্বল ও সুনার্জিত করিয়া তুলিয়াছেন।” বর্তমান বিশ্বে যে সকল দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি লাভ করেছে তার মূলে রয়েছে মাতৃভাষা প্রীতি, দেশাত্মবোধ ও শ্রম সাধনা। ইংরেজি পরিমণ্ডলে অবস্থান করেও স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ড নিজ নিজ ভাষাগত স্বাতন্ত্র্যকে ধরে রেখেছে।

মাতৃভাষা ও জাতীয়তাবোধ : যে জাতি জাতীয়তাবোধ প্রখর সে জাতি উন্নতির শিখরে উঠবেই এবং তা খুবই অল্প সময়ে। একটি দেশে নানা ধর্ম বর্ণের লোক বাস করতে পারে। কিন্তু তারা যদি জাতীয়তাবোধের এক মন্ত্রে দীক্ষিত হতে পারে তবে সে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। কোন জাতি পরাধীন থাকতে পারে, কিন্তু সে জাতির মাঝে যদি প্রখর জাতীয়তাবোধ জাগ্রত থাকে তবে কোন শক্তিই সে জাতিকে পরাধীন রাখতে পারে না। তারা ঠিকই এক সময় স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে আনে। তার প্রমাণ বাংলাদেশীরা দিয়েছে। সূদীর্ঘ পরাধীনতার গ্লানিকে মুছে ফেলে জাতীয়তাবোধের প্রের উজ্জীবিত হয়ে স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে এনেছে। জাতীয়তাবোধের জন্ম নেয় ভাষা প্রীতি থেকেই। বাঙালি জাতির ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েও সারা পৃথিবীতে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

উপসংহার : মাতৃভাষায় মুদ্রণ যন্ত্র চালু হয়েছে, কম্পিউটার চলছে। অতএব চিন্তার কোন কারণ নেই, সর্বস্তরে মাতৃভাষা চাল হলে প্রকৃত বিদ্যার্জন সম্ভব হবে। তাতে শিক্ষার আনন্দ বৃদ্ধি পাবে। আমরা সে আশাই করছি।

“ দেশি ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায় 

   নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ ন যায়।