ভূমিকম্প
অথবা, ভূমিকম্প ও বাংলাদেশ
অথবা, ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ
[সংকেত : ভূমিকা; ভূমিকম্প; ভূমিকম্পের কেন্দ; ভমিকম্পের কারণ, ভমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ কেন: ভমিকম্পে বাংলাদেশের কী পিরমাণ মাত হবে; নেপালে আঘাত হানা বিধ্বংসী ভূমিকম্প; ভমিকম্পের পর্বপ্রস্তুতি; ভমিকম্পের সময় করণীয়; ধ্বংসস্তুপে আটকে পড়লে করণীয়; উপসংহার ।]
ভূমিকা : প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে ভুমিকম্প সবচেয়ে ভয়াবহ। ভূমিকম্পসহ বিভিন্ন প্রাকতিক দুর্যোগ বাংলাদেশে বারবার আঘাত হানে। প্রাতবছরই কোনাে না কোনাে দুর্যোগ বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রাকে লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে। বিভিন্ন সূচকের মানদণ্ডে বিজ্ঞানীরা এসবের নাম দিয়ে থাকে। বন্যা, সাইক্লোন, টর্নেডাে, ঘূর্ণিঝড়, জলােচ্ছাস, খরা, নদীভাঙন ইত্যাদি ব্যাপক বিধ্বংসী এ। সকল অনাহুত জঞ্জাল যেন বাংলাদেশের পিছু ছাড়ছেই না । তারপর আবার বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভূমিকম্প। বিগত কয়েক বছর ধরে মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে অনেক বার । তাই আমাদের ভূমিকম্পজনিত ব্যাপক বিধ্বংসের হাত থেকে বাচার জন্য জাতীয় ভিত্তিক প্রস্তুতি নিতে হবে, অন্যথায় যেকোনাে মুহূর্তে জাতিকে চরমমূল্য দিতে হবে ।
ভূমিকম্প : ভূ-অভ্যন্তরে বিপুল শক্তি উদগীরণের ফলে এক প্রকার কম্পনের সৃষ্টি হয় । হঠাৎ করে এই শক্তির মুক্তি ঘটলে ভূপৃষ্ঠ ক্ষণিকের জন্য কেঁপে ওঠে এবং ভূ-ত্বকের কিছু অংশ আন্দোলিত হয়। এরূপ আকস্মিক ও ক্ষণস্থায়ী কম্পনকে ভূমিকম্প (Earthquake) বলে। ভূপৃষ্ঠের কম্পন তরঙ্গ থেকে যে শক্তির সৃষ্টি হয় ভূ-মণ্ডলে তা ভূমিকম্পের মাধ্যমে প্রকাশ পায় । সমুদ্রপৃষ্ঠে এ তরঙ্গ সৃষ্টি হলে তাকে সুনামি বলে। এই তরঙ্গ ভূ-গর্ভের কোনাে অঞ্চলে উৎপন্ন হয় এবং তা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এ কম্পন মাত্র কয়েক সেকেন্ড থেকে এক/দুই মিনিট স্থায়ী হয়। শক্তিশালী ভূমিকম্পে ঘর-বাড়ি, সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষতি হয় এবং অসংখ্য প্রাণহানি ঘটে।
ভূমিকম্পের কেন্দ্র : পৃথিবীর অভ্যন্তরে যে কেন্দ্র থেকে ভূ-কম্প-তরঙ্গ উৎপন্ন হয় তাকে ভূমিকম্পের কেন্দ্র বলে। এই কেন্দ্র থেকে কম্পন ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গের মাধ্যমে সব দিকে ছড়িয়ে পড়ে । শিলার পীড়ন-ক্ষমতা সহ্যসীমার বাইরে চলে গেলে শিলায় ফাটল ধরে ও শক্তির মুক্তি ঘটে। তাই প্রায়শই ভূমিকম্পের কেন্দ্র চ্যুতিরেখা অংশে অবস্থান করে। সাধারণত ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৬ সেমি এর মধ্যে এই কেন্দ্র অবস্থান করে। তবে ৭০০ কিমি গভীরে গুরুমণ্ডল (Mantle) থেকেও ভূ-কম্পন উত্থিত হতে পারে।
ভূমিকম্পের কারণ : সাধারণত তিনটি প্রধান কারণে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়ে থাকে :
ভূপৃষ্ঠজনিত : আমাদের ভূপৃষ্ঠ অনেকগুলাে প্লেট-এর সমন্বয়ে গঠিত। এসব প্লেট একটি আরেকটির থেকে আলাদা থাকে ফল্ট বা ফাটল দ্বারা। এসব প্লেটের নিচেই থাকে ভূ-অভ্যন্তরের সকল গলিত পদার্থ । কোনাে প্রাকৃতিক কারণে এই গলিত পদার্থগুলাের স্থানচ্যুতি ঘটলে প্লেটগুলােরও কিছুটা স্থান চ্যুতি ঘটে। এ কারণে একটি প্লেটের কোনাে অংশ অপর প্লেটের তলায় ঢুকে যায়, যার ফলে ভূমিতে কম্পন সৃষ্টি হয়। আর এই কম্পনই ভূমিকম্প রূপে আমাদের নিকট প্রতিভাত হয়।
আগ্নেয়গিরিজনিত : কখনাে কখনাে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ও গলিত লাভা উৎক্ষিপ্ত হওয়ার কারণে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হতে পারে ।
শিলাচ্যুতিজনিত : কখনাে কখনাে শিলা তার স্থান থেকে সরে যাওয়ার ফলে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয় ।
ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ কেন : বাংলাদেশের ভূমিকম্প বলতে আসলে বাংলাদেশ ও তৎসংলগ্ন এলাকার ভূমিকম্পকে বােঝায়। কারণ বাংলাদেশ আসলে ভারত ও মায়ানমারের ভূ-অভ্যন্তরের দুটি ভূ-চ্যুতির (faultline) প্রভাবে আন্দোলিত হয়। কেননা বাংলাদেশ ভারতীয় ইউরেশীয় এবং বার্মার (মায়ানমারের) টেকটনিক প্লেটের মধ্যে অবস্থান করছে। ভারতীয় এবং ইউরেশীয় প্লেট দুটি (১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে) দীর্ঘদিন যাবৎ হিমালয়ের পাদদেশে আটকা পড়ে আছে, অপেক্ষা করছে বড়াে ধরনের নড়াচড়ার অর্থাৎ বড়াে ধরনের ভূ-কম্পনের । বাংলাদেশে ৮টি ভূ-তাত্ত্বিক চ্যুতি এলাকা বা ফল্ট জোন সচল অবস্থায় রয়েছে। যথা– বগুড়া চ্যুতি এলাকা, রাজশাহীর তানাের চ্যুতি এলাকা, ত্রিপুরা চ্যুতি এলাকা, সীতাকুণ্ড-টেকনাফ চ্যুতি এলাকা, হালুয়াঘাট চ্যুতি এলাকা, ডাউকী চ্যুতি এলাকা, ডুবরি চ্যুতি এলাকা, চট্টগ্রাম চ্যুতি এলাকা, সিলেটের শাহজিবাজার চ্যুতি এলাকা (আংশিক-ডাওকি চ্যুতি) এবং রাঙামাটির বরকলে রাঙামাটি চ্যুতি এলাকা।
ভূমিকম্পে বাংলাদেশের কী পরিমাণ ক্ষতি হবে : বাংলাদেশে বড়াে ধরনের ভূমিকম্প হলে কী পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হবে তা অনুমান করা অসম্ভব । কেননা ভূমিকম্পের কোনাে পূর্বাভাস নেই । যায় কারণে মানুষ সতর্কতামূলক কোনাে পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে না। ভূমিকম্পে বাংলাদেশের অসংখ্য ঘর-বাড়ি ধসে পড়বে; রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ ভেঙে পড়বে; মানুষসহ অসংখ্য প্রাণী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে, অনেক মানুষ দেওয়াল চাপা পড়ে মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করবে। তাছাড়া জীবন ধারণের প্রয়ােজনীয় সকল জিনিসপত্র ধ্বংস হয়ে পড়বে। সবশেষে আমরা বলতে পারি যে, যদি কখনাে বাংলাদেশে বড়াে ধরনের ভূমিকম্প হয় তাহলে সারা দেশ একটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে ।
নেপালে আঘাত হানা বিধ্বংসী ভূমিকম্প : সম্প্রতি ২৫ শে এপ্রিল ২০১৫ সালে নেপালে এক বিধ্বংসী ভূমিকম্প আঘাত হানে। রিখটার স্কেলে এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল উৎপত্তি স্থলে ৮.১। এই ভূমিকম্পের উৎপত্তি স্থল ছিল কাঠমান্ডু। তার কয়েক মিনিট পর আবারও ৬.৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এভাবে ১০০-এর বেশি বার মৃদু ভূ-কম্পন ঘটে। এতে নেপাল ব্যাপক ধ্বংসের সম্মুখীন হয়। কাঠমান্ডু শহর প্রায় নিঃশেষ হয়ে পড়ে। সারা দেশে হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে। সর্বনাশা এই ভূমিকম্পে পৃথিবীর সবচেয়ে বড়াে পর্বত মাউন্ট এভারেস্টের কিছু অংশ ধসে পড়ে এবং বড়াে বড়াে ফাটল দেখা দেয়। এমনকি পর্বতে প্রচুর তুষার ধসের ফলে অনেক পর্বতারােহীর মৃত্যু হয়। গবেষকদের ধারণা, প্রতি ৭৫ বছর পরপর নেপালসহ এর আশেপাশে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানছে।
ভূমিকম্পের পূর্বপ্রস্তুতি : ভূমিকম্পের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়ােজন সেগুলাে হলাে :
১। গবেষকদের প্রকাশিত তথ্যমতে আপনি কী পরিমাণ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় আছেন তা জেনে নিন ।
২। আপনি যে ভবনটিতে আছেন সেই ভবনটি ভূমিকম্পরােধক কি না খোঁজ নিন । থাকলে কত মাত্রার ভূমিকম্প সহনীয় এবং না থাকলে এত দুর্বল ভবনে রেট্রোফিটিং এর ব্যবস্থা নিন।
৩। পরিবারের সবার সাথে বসে আশ্রয়ের ব্যাপারে পরিবারের জরুরি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন।
৪। বিছানার পাশে সবসময় টর্চলাইট, ব্যাটারি ও জুতাে রাখুন।
৫। প্রতি বছর পরিবারের সকলের সাথে ভূমিকম্পের করণীয় সম্পর্কে ট্রায়াল দিন ।
ভূমিকম্পের সময় করণীয় : ভূমিকম্পের সময় যা যা করণীয় সেগুলাে নিচে দেওয়া হলাে :
১। ভূমিকম্প শুরু হলে ছুটাছুটি না করে স্থির থাকুন। বাইরে বের হওয়া, ছাদ বা জানালা দিয়ে লাফ দেওয়া থেকে বিরত থাকুন ।
২। ভূমিকম্প শুরু হলে মেঝেতে বসে পড়ন । তারপর কোনাে ডেস্ক বা টেবিলের নিচে প্রবেশ করুন ।
৩। ভবনে ভূমিকম্পরােধক ব্যবস্থা থাকলে ভবন ধসের সম্ভাবনা কম থাকে। সুতরাং তখন ভবনে অবস্থান করাই সবচেয়ে বেশি নিরাপদ।
৪। ভূমিকম্পের সময় এলিভেটর/লিফক্ট ব্যবহার করা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ । সুতরাং এলিভেটর/লিট ব্যবহার পরিহার করুন ।
৫। ভূমিকম্পের সময় গাড়িতে থাকলে গাড়ি বন্ধ করে ভেতরে বসে থাকুন । গাড়ির বাইরে বের হলে আহত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।
৬। মেইন শক’ বা মূল ভূমিকম্প হওয়ার আগে ও পরে মৃদু বা মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যাকে বলা হয় | ‘ফোরশক’ এবং আফটার শক। এ সময়ও সতর্ক থাকতে হবে। কেননা ‘আফটার শক বা ‘ফোরশক’ থেকেও বড়াে ধরনের ক্ষতি হতে পারে।
৭। প্রথম ভূমিকম্পের সময় সম্ভব না হলেও পরে গ্যাস ও বিদ্যুতের মেইন সুইচ বন্ধ করে দিন ।
ধ্বংসস্তুপে আটকে পড়লে করণীয় : ভূমিকম্পে ধ্বংসস্তুপে আটকে পড়লে যা যা করণীয় সেগুলাে হলাে :
১। হাতে রুমাল, তােয়ালে বা চাদর থাকলে হালকাভাবে নাক-মুখ ঢেকে রাখুন । যাতে ধ্বংসস্তুপের ধুলাবালি নাকে, মুখে প্রবেশ করতে না পারে।
২। হাতে টর্চ থাকলে জ্বালান, ম্যাচ জ্বালাবেন না। কেননা গ্যাসের পাইপ লিক থাকলে আগুন লেগে যেতে পারে।
৩। কাউকে চিৎকার করে না ডেকে মুখে শিস বাজিয়ে, হাতে রেফারির বাঁশি থাকলে বাঁশি বাজিয়ে অথবা কোনােকিছুতে শব্দ করে | ডাকুন। এতে মুখে ধুলাবালি প্রবেশ করবে না।
উপসংহার : সকল প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে ভূমিকম্প সবচেয়ে বেশি বিধ্বংসী। এই বিধ্বংসী ভূমিকম্পের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনাে উপায় বা পূর্বাভাস নেই। ভূমিকম্প রেখার ঝুঁকিপূর্ণ সীমানার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান। তাই আমাদের শক্তিশালী। ভূমিকম্পের বিপর্যয় মােকাবিলা করতে সকল প্রকার প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। বাংলাদেশে অনেকবার বিভিন্ন মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। এতে জানমালের তেমন ক্ষতি না হলেও বেশি মাত্রার ভূমিকম্পে বাংলাদেশ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হতে পারে। সুতরাং বিষয়টি হাল্কাভাবে না নিয়ে এখনই ভবন নির্মাণের জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও দুর্বল স্থাপনাসমূহ চিহ্নিতকরণপূর্বক ভেঙে ফেলতে হবে।
Leave a comment