বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর |
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অথবা, আমার প্রিয় কবি
অথবা, তােমার প্রিয় কবি
[সংকেত : সূচনা; জন্ম ও বাল্যকাল; কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ; ছােটো গল্প; উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ; শিক্ষা বিস্তারে রবীন্দ্রনাথ; মহাপ্রয়াণ ।]
সূচনা : বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে অন্যতম । শুধু কবিতা নয়, বাংলা সাহিত্যের সকল শাখায় তাঁর অবদান অসাধারণ । তিনি একাধারে নাট্যকার, গীতিকার, প্রাবন্ধিক, চিত্রশিল্পী, দার্শনিক ও চিন্তাবিদ । প্রতিভার এমন সর্বমুখিতা, এমন গভীরতা ও ব্যাপ্তি বিস্ময়কর। তিনি ভারতবর্ষের হয়েও হয়ে উঠলেন বিশ্ব নাগরিক তথা বিশ্বমানব । তিনি বাংলা ভাষাকে প্রথম বিশ্বের দরবারে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। একটি নির্দিষ্ট সময়ের হয়েও তিনি হয়ে উঠলেন সর্বকালের। তাঁর রচিত গান বাংলাদেশ এবং ভারতের জাতীয় সংগীত । তিনি সুপ্তিমগ্ন, নৈরাশ্য-পীড়িত জাতিকে শােনালেন নবজীবনের গান, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সােচ্চার হয়ে জড়াগ্রস্ত জীবনে এনে দিলেন এগিয়ে যাওয়ার ছন্দ, জনতার কণ্ঠে গণসংগীত । রবীন্দ্রনাথ তাই আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার ।
জন্ম ও বাল্যকাল : জোড়াসাঁকোর প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের পুত্র মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর । মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠ পুত্র হলেন বিশ্ববিখ্যাত কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । তাঁর অন্য ভ্রাতারাও যথেষ্ট প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ প্রমুখ বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিক্ষেত্রে সুপরিচিত। সত্যিই রবীন্দ্রনাথের মাতা সারদাদেবী ছিলেন রত্নগর্ভা বাঙালি নারী । ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের ৬ মে, বাংলা ১২৬৮ সনের ২৫শে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন । অল্প বয়সে মাকে হারানাের ফলে রবীন্দ্রনাথের বাল্যজীবন ভৃত্যদের শাসনের মধ্যেই অতিবাহিত হয়। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা কোনাে ডিগ্রি অর্জন না করলেও তার সমকক্ষ পণ্ডিত নিতান্তই বিরল। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তিনি পরিভ্রমণ করেছেন । রবীন্দ্রনাথ ১৭ বছর বয়সে ইংল্যান্ড গিয়ে অধ্যাপক হেনরি মর্লির নিকট থেকে ইংরেজি সাহিত্যের পাঠ গ্রহণ করেন। অতি শৈশবেই তাঁর কবি প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে । কথিত আছে, মাত্র ৯ বছর বয়সে তিনি কবিতা রচনা করে শিক্ষকদের বিস্মিত করেছেন। পিতার কাছে তিনি সংস্কৃত ব্যাকরণ ও জ্যোতিষশাস্ত্রে শিক্ষা লাভ করেন। মধ্যম ভ্রাতা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্মস্থল আহমেদাবাদ থেকে তিনি ইংরেজি ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেন । ১৬ বছর বয়স হতে তিনি ভারতী’ পত্রিকায় লিখতে থাকেন। ঊনবিংশ শতকে প্রায় প্রত্যেক প্রতিভাবান সাহিত্যিক জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি যাওয়া-আসা করতেন। এদের মধ্যে প্রধান ছিলেন রাজনারায়ণ বসু, বিহারীলাল চক্রবর্তী, অক্ষয় চৌধুরী, দেবেন্দ্রনাথ সেন প্রমুখ । তাদের সান্নিধ্যে, প্রভাবে এবং উৎসাহে বাল্যকাল হতেই রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হন।
ছােটোগল্প : রবীন্দ্রনাথের ছােটোগল্প বিষয় বৈচিত্র্যে অসাধারণ । ছােটোগল্পের সংকলন ‘গল্পগুচ্ছে’র আশিটি ছােটোগল্প এবং অন্যান্য গ্রন্থের গল্পসমূহ মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথের ছােটো গল্পের সংখ্যা একশ উনিশটি। উল্লেখযােগ্য ছােটোগল্পের মধ্যে কয়েকটি হলােপােস্টমাস্টার, কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, ছুটি, দিদি, মেঘ ও রৌদ্র, কর্মফল, দেনাপাওনা, পণরক্ষা, একরাত্রি, সমাপ্তি, দৃষ্টিদান, মাল্যদান, মধ্যবর্তিনী, শাস্তি, প্রায়শ্চিত্ত, অধ্যাপক, নষ্টনীড়, স্ত্রীর পত্র, পাত্র ও পাত্রী, রবিবার, শেষকথা, ল্যাবরেটরি, গুপ্তধন, জীবিত ও মৃত, নিশীথে, ক্ষুধিত পাষাণ, শুভা, অতিথি, খােকাবাবুর প্রত্যাবর্তন, ইচ্ছাপূরণ, মাস্টার মশায় ইত্যাদি।
উপন্যাস : রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের সংখ্যা মােট বারােটি : বৌ ঠাকুরানীর হাট, রাজর্ষি, চোখের বালি, গােরা, নৌকাডুবি, ঘরে বাইরে, চতুরঙ্গ, যােগাযােগ, শেষের কবিতা, দুই বােন, মালঞ্চ, চার অধ্যায়। এগুলাে বাংলা সাহিত্যের মূল্যবান সম্পদ।
নাটক : বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান অপরিসীম। বৈচিত্র্যপূর্ণ নাট্য সৃষ্টিতে তাঁর কৃতিত্ব অপরিসীম। নব নব আঙ্গিক এবং অতুলনীয় নাট্য ভাষা সৃষ্টিতে তিনি ছিলেন যুগের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসর। গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, কাব্যনাট্য, সাঙ্কেতিক নাটক, সামাজিক নাটক, প্রহসন ইত্যাদি শ্রেণিতে তাঁর নাটক ভাগ করা যায়। উল্লেখযােগ্য নাটকগুলাে হলাে- গীতিনাট্যবাল্মীকি প্রতিভা’, কালমৃগয়া’, মায়ার খেলা’; কাব্য নাট্য- ‘বিসর্জন’, ‘প্রকৃতির প্রতিশােধ’; নৃত্যনাট্য ‘নটীর পূজা’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, চণ্ডালিকা’, শ্যামা; প্রহসন ‘চিরকুমার সভা’, বৈকুণ্ঠের যাত্রা ইত্যাদি।
প্রবন্ধ : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিচিত্র বিষয় অবলম্বনে অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেছেন। সাহিত্যতত্ত্ব, সমালােচনা, ধর্ম, দর্শন, সমাজ, ইতিহাস, রাজনীতি, শিক্ষা, বিজ্ঞান, ভাষাতত্ত্ব, ভ্রমণকাহিনি, চিঠিপত্র প্রভৃতি বিষয়ে রচিত তাঁর প্রবন্ধগুলাে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। মােটকথা রবীন্দ্রনাথ এক জীবনে যা রচনা করেছেন তা একজন মানুষের পক্ষে এক জনমে আত্মস্থ করাও সম্ভব বলে মনে হয় না ।
চল্লিশ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ তাঁর পিতার ভুবনডাঙার মাঠে ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং তিনি নিজেও এখানে বসবাস করতে থাকেন। পরবর্তীকালে এ ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়ই ‘বিশ্বভারতী বিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিক শিক্ষাসাধনের পীঠস্থান এই ‘বিশ্বভারতী’ । কবির বয়স যখন ৪১ বছর তখন তাঁর পত্নীর মৃত্যু হয়। ১৯১২ সালে কবির ৫০ বছর পূর্ণ হওয়া উপলক্ষ্যে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ এক বিরাট সভায় দেশবাসীর পক্ষ হতে তাঁকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে। ‘গীতাঞ্জলি কাব্য ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হলে পাশ্চাত্য জগতে রবীন্দ্রনাথের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে এবং ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে নােবেল পুরস্কার অর্জন করেন। এ বছরেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘ডক্টর অব ল’ উপাধিতে ভূষিত করে। এটা ব্যতীত তিনি কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি লিট উপাধিও প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে তাকে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করেন। কিন্তু পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে ইংরেজ সরকার কর্তৃক ভারতবাসীর ওপর যে অমানুষিক অত্যাচার হয়েছিল তার প্রতিবাদে কবি এ উপাধি ত্যাগ করেন।
শিক্ষা বিস্তারে রবীন্দ্রনাথ : শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রেও তার অদম্য প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। বােলপুর’ তার প্রিয় স্থান সেখানে যুবক ও বালকদের ধর্মনীতি ও সাধারণ বিদ্যাশিক্ষা দেওয়ার নিমিত্তে তিনি গতানুগতিকতার পথ ছেড়ে ভারতীয় আদর্শে এক ব্রহ্মচর্যাশ্রম খােলেন। তিনি ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বভারতী’ এবং ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেন। রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা বিচিত্রমুখী হলেও তাঁর সবচাইতে বড় পরিচয় তিনি কবি । রবীন্দ্রনাথ মানবতার কবি, তিনি প্রকৃতির কবি । তিনি পৃথিবীর রূপমােহে মুগ্ধ হয়ে পৃথিবীর রূপ-মাধুর্যকে আকণ্ঠ পান করেছেন। তিনি মানুষের মাঝে বাঁচতে চেয়েছেন, সীমার । মাঝেই অসীমকে পেতে চেয়েছেন। পৃথিবীকে সুন্দর করে ভােলাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। পৃথিবীকে আরও সুন্দর করে তােলাই ছিল কবিচিত্তের বাসনা। পুরস্কার’ কবিতায় তাঁর ইচ্ছাটি প্রকাশ পেয়েছে :
সংসার মাঝে কয়েকটি সুর
রেখে দিয়ে যাবাে করি সুমধুর
দু-একটি কাঁটা করি দিব দূর
তার পরে ছুটি নিব ।
মহাপ্রয়াণ : সুদীর্ঘকাল একনিষ্ঠভাবে বাংলা সাহিত্য ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে কবি ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ আগস্ট (১৩৪৮ বঙ্গাব্দ ২২শে শ্রাবণ) অন্তিম বিশ্রাম গ্রহণ করেন। এ হলাে রবীন্দ্রনাথের বাইরের পরিচয়। কিন্তু বাইরের পরিচয় দিয়ে অন্তরের সবটুকু পরিচয় পাওয়া যায় না। সবার প্রিয় বিশ্বকবির প্রকৃত পরিচয় পেতে হলে তাঁর ভাব-সমুদ্রে অবগাহন করতে হবে ।
Leave a comment