পলিথিনের ক্ষতিকর প্রভাব

[ রচনা সংকেত : ভূমিকা, পলিথিনের ব্যবহার এবং অপব্যবহার, পলিথিনের ক্ষতিকর প্রভাব, পলিথিন নিষিদ্ধকরণে সরকারি ঘোষণা / ব্যবস্থা, বেকারত্ব সৃষ্টি ও এর সমাধান, পলিথিনের বিকল্প, উপসংহার। ]

ভূমিকা : মানুষসহ সব প্রাণীর জন্য পরিবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশই হলো প্রাণের ধারক ও বাহক। পরিবেশের ওপর নির্ভর করে মানুষ, উদ্ভিদ বা প্রাণীর উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। প্রতিটি জীবই বাঁচার জন্য নিজ নিজ পরিবেশ থেকে প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করে। সে পরিবেশ যদি কোন কারণে দূষিত হয়ে ওঠে, তবে তা জীবের অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। অথচ আমাদের এ পরিবেশ বিভিন্নভাবে দূষিত হচ্ছে। যা আজ পৃথিবীর প্রধান আলোচ্য বিষয়। এই পরিবেশ দূষণের যেসব উপাদান রয়েছে তার মধ্যে পলিথিন অন্যতম। এর পরিমাণ অত্যন্ত ভয়াবহ। প্রতিনিয়ত সরকারের সদিচ্ছা ও জনসাধারণের পলিথিন ব্যবহারে বিরত থাকার মধ্য দিয়ে একদিন বাংলাদেশ পলিথিনমুক্ত হবে এটাই আজ সবার প্রত্যাশা। 

পলিথিন কী : পলিথিন প্রকৃতি থেকে সৃষ্ট কোন পদার্থ নয়। এটি একটি রাসায়নিক পদার্থ। পলিথিন বিষাক্ত প্রোপাইলিনের সঙ্গে পেট্রোলিয়াম হাইড্রো কার্বনের ৩/৪টি মলিকুলের সংমিশ্রণে তৈরি হয়। বিজ্ঞানের পরিভাষায় এর নাম পলিথাইলিন। অন্যান্য পদার্থের মত পলিথিন ভেঙ্গে অন্য কোন পদার্থে রূপান্তরিত হয় না। পলিথিনকে কোন অণুজীব মাইক্রোন অর্গানিজম খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে না। যদি পলিথিন ভেঙ্গে গিয়ে মিথেন কিংবা কার্বন ডাই অক্সাইডে পরিণত হত তাহলে কোন সমস্যা হত না। পলিথিন রূপান্তরিত হয় না বলে এটা পচে না ।

পলিথিনের ব্যবহার সম্পর্কিত প্রতিবেদন : পলিথিনের ভয়াবহতা নিয়ে ২০০২ সালের পূর্বে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। যেমন–

বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা শহরেই প্রতিদিন প্রায় কোটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহৃত হয়, যার নব্বই ভাগই একবার ব্যবহারে পর পরিত্যক্ত হয়। পলিথিন শহরের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাকে বিঘ্নিত করে এবং জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে।

চিকিৎসকদের প্রতিবেদনে বলা হয়, পলিথিনের ব্যবহার মারাত্মক রোগের সৃষ্টি করতে পারে। পলিথিন ব্যাগে রাখা খাবারের ওপর এর প্রভাব পড়লে সে খাবার গ্রহণে চর্মরোগ, ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগের সৃষ্টি করতে পারে। পলিথিন রঙ্গিন করতে ব্যবহৃত ক্যাডমিয়ামের বিষাক্ত প্রভাবও স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে। বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদনে বলা হয় পলিথিন বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ। পলিথিন পোড়ালে যে গ্যাস উৎপন্ন হয়, সেই গ্যাস বায়ুকে বিষাক্ত করে তোলে। অর্থনৈতিক প্রতিবেদনে বলা হয় পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করে পাটজাত ব্যাগ ব্যবহার করলে তা দেশের জন্য অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে।

পলিথিনের ব্যবহার এবং অপব্যবহার : আজ থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগে যে পলিথিনের যাত্রা শুরু হয়েছিল তা আজ এত ব্যাপক আকার ধারণ করেছে যে গোটা দেশটিই যেন পলিথিনে ছেয়ে গেছে। এমন কোন স্থান নেই যেখানে পলিথিনের ব্যবহার নেই। আমাদের দেশে পলিথিন সাধারণত ফ্যাশন হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে। পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, খালি হাতে বাজারে গিয়ে ১০/১২টি রঙিন ব্যাগ নিয়ে ঘরে ফেরা হয়। দামে সস্তা ও নানা রঙের পলিথিন অতি সহজেই ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে। বিভিন্ন ধরনের বিক্রেতারাও এটা সহজলভ্য বিধায় সহজেই জিনিসপত্রের সাথে দিয়ে থাকে। সাধারণত শপিং ব্যাগ হিসেবেই এটা বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো এর বহুল অপব্যবহার হচ্ছে। পলিথিন নিয়ে বাড়ি ফেরার পর আমরা প্রয়োজনীয় জিনিস রেখে দেই এবং পলিব্যাগগুলো ডাস্টবিনে ফেলে দেই। অনেক সময় বাড়ির আশপাশেই ফেলে দিয়ে ঝামেলামুক্ত হয়ে যাই। দেশে এমন কোন জায়গা নেই যেখানে পলিথিন ছড়িয়ে নেই। এর মূল কারণ হলো দামে সস্তা বলে জিনিসপত্র রেখে পলিব্যাগগুলো মূল্যহীন ভেবে ফেলে দেই। এভাবেই প্রতিদিন সারা বাংলাদেশে লাখ লাখ পলিথিনের অপব্যবহার হচ্ছে।

পলিথিনের ক্ষতিকর প্রভাব : পলিথিন এমন একটি রাসায়নিক উপাদানে তৈরি যা পরিবেশের জন্য মোটেই উপযোগী নয়। তাই পরিবেশবাদীরা পলিথিন ব্যবহারের বিভিন্ন ক্ষতিকর দিক তুলে ধরেছেন। এর মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য দিক তুলে ধরা হলো :

১। পলিথিন রাসায়নিক উপাদানে তৈরি বলে তা স্বাস্থ্যসম্মত নয়।

২। পলিথিনে যখন কোন খাদ্যদ্রব্য বহন করা হয়, তখন এর মধ্য থেকে বিষফেনোল নামক বিষ নির্গত হয় এবং খাদ্যদ্রব্যের সাথে মিশে যায়। এই খাদ্যদ্রব্য খেলে বিষাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

৩। এটি মাটির সঙ্গে মিশে না। ফলে মাটির উর্বরাশক্তি নষ্ট হয়।

৪। ডাস্টবিনে ফেলা পলিথিন বৃষ্টির পানির সঙ্গে ড্রেনে ঢুকে পড়ে, ফলে ড্রেনের পানি উপচে ওপরে উঠে আসে এবং জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে।

৫। পলিথিন অক্ষয়। এটা কখনো পচে না।

৬। পলিব্যাগ পোড়ালে তাতে বায়ু দূষণে সহায়তা করে অর্থাৎ বায়োক্সিন, হাইড্রোজেন সায়ানাইড গ্যাস উৎপন্ন হয়। এর ফলে বায়ুর দূষণ ঘটে। এতে যক্ষ্মা বা ক্যান্সার হয়ে মৃত্যুর আশঙ্কা দেখা দেয় ।

৭। পলিথিন নদীর তলদেশে জমা হয়ে নদীর তলদেশ ভরাট করে ফেলে। ফলে বন্যা হয়। ‘৯৮ সালের দীর্ঘস্থায়ী বন্যা এর জন্য কিছুটা হলেও দায়ী।

৮। পলিব্যাগ জমার কারণে অনেক সময় পানি সহজে প্রবেশ করতে পারে না। যার ফলে শুষ্কতা ও পানিশূন্যতা দেখা দেয়।

উপরিউক্ত কারণগুলো ছাড়া আরো বহুবিধ কারণও আছে। এসব ক্ষতিকর দিক বিবেচনা করে শিক্ষিত সমাজ ভীষণ শঙ্কিত।

পলিথিন নিষিদ্ধকরণে সরকারি ঘোষণা / ব্যবস্থা : পলিথিন দেশের শত্রু। এ বিষয়টি বর্তমান সরকার দারুণভাবে উপলব্ধি করে। পলিথিনকে বাংলাদেশ সরকার চিরতরে নির্মূল করে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এর পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন বর্তমান সরকারের পরিবেশ ও বনমন্ত্রী শাজাহান সিরাজ। গত ২৩ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে পরিবেশ ও বনমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সারাদেশে পলিথিন নিষিদ্ধকরণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। শুধু সিদ্ধান্ত নয়, সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণা করা হয় প্রাথমিকভাবে ১ জানুয়ারি ’০২ ঢাকা শহর এবং ১ মার্চ ‘০২ থেকে সারা দেশে পলিথিন উৎপাদন ও ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। পরিবেশ রক্ষায় সরকারের এ মহতী উদ্যোগকে কতিপয় লোক ছাড়া সর্বস্তরের জনগণ স্বাগত জানায়। উল্লেখ্য পলিথিন ব্যাগের উৎপাদন, চোরাচালান ও ব্যবহার বন্ধের জন্য বহুদিন ধরেই বিভিন্ন মহল থেকে দাবি জানানো হয়েছে। এতদিন এই দাবি যথোচিত সুবিচার পায়নি এবং এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোন কার্যব্যবস্থাও গৃহীত হয়নি। অতীতে অন্তত দুবার এই ক্ষতিকর ব্যাগ নিষিদ্ধের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। প্রথম উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল ১৯৯১ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে। আর দ্বিতীয় উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় দু’টি উদ্যোগই কার্যকর হয়নি। শেষ পর্যন্ত সকল ব্যর্থতার অবসান ঘটিয়ে বর্তমান সরকার সফলতার মুখ দেখিয়েছেন। একদিন সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে যাবে। কারণ বর্তমান সরকার এর জন্য শাস্তি ঘোষণা করেছেন। আইন অমান্যকারীকে সর্বোচ্চ দশ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের ব্যবস্থা করেছেন। আইনের ভয়ে আমাদের বিশ্বাস সবাই পলিথিন ব্যবহারে বিরত থাকবে। পলিথিনের অকাল মৃত্যু ঘটবে।

বেকারত্ব সৃষ্টি ও এর সমাধান : পলিথিন ক্ষতিকর জিনিস হলেও এটা ছিল অনেক লোকের বেঁচে থাকার অবলম্বন। উৎপাদনকারীরা এর থেকে অর্জিত আয় দিয়েই তাদের সংসার চালাতো। হঠাৎ পলিথিন বন্ধ হওয়ার কারণে প্রায় চল্লিশ হাজার লোক কর্মহীন হয়ে পড়বে। সৃষ্টি হবে বেকারত্ব। তাই তারা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। কিন্তু তাদের এই সামান্য স্বার্থের কথা চিন্তা করে বৃহৎ স্বার্থকে ধ্বংস করা যায় না। তবে তাদের কথাও চিন্তা করতে হবে, যারা এর উৎপাদনের সাথে জড়িত ছিল। কারণ তারা আমদেরই সন্তান, এদেশেরই নাগরিক। সরকার তাদেরকে অন্য জায়গায় নিয়োগ দিতে পারে। পলিথিনের বিকল্প যেসব জিনিসের কারখানা তৈরি হবে, সেখানেও তাদেরকে নিয়োগ দান করতে পারেন। সরকারের ইচ্ছেতেই কেবল তাদের বেকারত্ব মোচন করা সম্ভব। সরকার এ দিকটা অবশ্যই বিবেচনা করবেন। 

পলিথিনের বিকল্প : পরিবেশবাদীরা পলিথিনের ক্ষতিকর দিক আলোচনার পাশাপাশি এর বিকল্প দিক নিয়েও আলোচনা করেছেন। সমগ্র পৃথিবীর পরিবেশবাদীরা স্বীকার করেছেন যে পাট, কাগজ এবং তুলার ব্যাগ পলিথিনের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করতে পারে। পাট সত্যিই পরিবেশের বন্ধু। এটি ক্ষুদ্র কোষযুক্ত এবং পচনশীল। এটি পোড়ালে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয় না এবং খরচও অত্যন্ত কম। পাটের মতো তুলা-কাগজও পরিবেশের বন্ধু। এর তৈরি ব্যাগগুলো ক্রেতারা স্বল্প খরচেই কিনতে পারে। পলিথিনের মতো ক্রেতাদের রুচি অনুযায়ী নানা নকশার ব্যাগ তৈরি করা যায়। অবশ্য এসব ব্যাগ বাজারে এসে গেছে। পলিথিন ব্যাগের বিকল্প হিসেবে প্রথম মাসে ২ কোটি ৫০ লাখ পাটের ব্যাগ বাজারে এসেছে। অচিরেই বিজেএমসি ২ টাকার মূল্যের পাটের ব্যাগ সরবরাহ করবে। সেই সাথে আসবে মাল্টি পাটের ব্যাগ যা সহজে পকেটে ভরে বহন করা যাবে। এসব জিনিস সুষ্ঠুভাবে ব্যবহৃত হলে একদিন বোঝাই যাবে না যে, পলিথিন নামক ক্ষতিকর জিনিস বাজারে ছিল।

উপসংহার : পলিথিন পরিবেশের জন্য কখনোই শুভকর নয়। তাই এটা বন্ধের জন্য সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন এন.জি.ও থেকে শুরু করে সর্বস্তরের জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারের সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনে বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করতে হবে। তবেই বাংলাদেশ পলিথিনমুক্ত হবে এবং দেশটা সবার বসবাসের উপযোগী হবে।