দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচি

[সংকেত : ভূমিকা; ক্ষুদ্র ঋণের উপযোগিতা; ক্ষুদ্র ঋণের নিয়ম; ক্ষুদ্র ঋণে দরিদ্রের স্বনির্ভরতা; ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের সফলতা; উপসংহার।]

ভূমিকা : মানব সমাজে বেশ কয়েকটি সামাজিক সমস্যা রয়েছে । তার মধ্যে অন্যতম সমস্যা হলো দারিদ্র্য। সমস্যাটি কেবল একক সমস্যাই নয়, বরং বহুবিধ সমস্যার জন্মদাতাও বটে । মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণের সবচেয়ে বড়ো অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় দারিদ্র্য । আর মানুষ যখন মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয় তখন তারা নানা রকম অন্যায়, অনৈতিক ও অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়ে । তাছাড়া জাতীয় উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড়ো বাধা দারিদ্র্য । দারিদ্র্য মানুষকে হতাশাগ্রস্ত করে এবং ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে । তাই আমাদের দেশের মতো দরিদ্র দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচি ।

ক্ষুদ্র ঋণের উপযোগিতা : বাংলাদেশ বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম । বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এক ধরনের ঋণ ব্যবস্থার প্রচলন আছে। দরিদ্র মানুষের জন্য প্রচলিত ঋণ ব্যবস্থার চেয়ে ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচি বেশি উপযোগী বলে বিবেচিত । বাংলাদেশে যে ঋণ ব্যবস্থা প্রচলিত আছে তাতে ক্রমে ক্রমে সুদ বাড়তে থাকে । ফলে একসময় তা ঋণ গ্রহীতার কাঁধে ভারী একটি বোঝায় পরিণত হয় । কিন্তু ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থায় গ্রহণকৃত ঋণ কিস্তির ভিত্তিতে আদায় করা হয় বলে ঋণের মূল অংশ বৃদ্ধি পায় না । ঋণ গ্রহীতার জন্যও বিষয়টি বেশ স্বস্তির । ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচি একটি অরাজনৈতিক উদ্যোগ ।

ক্ষুদ্র ঋণের নিয়ম : ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থা বাংলাদেশের দরিদ্রদের ঋণ পাওয়া নিশ্চিত করে। প্রচলিত ঋণ ব্যবস্থায় ভূমিহীন ও বিত্তহীনদের ঋণ দেওয়া না হলেও ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থায় তাদের ঋণ দেওয়া হয় । প্রচলিত ঋণের নিয়মে ঋণগ্রহীতাকে জমি, শিল্প বা কল-কারখানা জামানত রাখতে হয়। কিন্তু ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থায় কোনো জামানতের প্রয়োজন হয় না। প্রচলিত ঋণ ব্যবস্থায় ঋণগ্রহীতাকে ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধকালে ব্যাংকে যেতে হয়, কিন্তু ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থায় ঋণগ্রহীতাকে ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধকালে ব্যাংকে যেতে হয় না । ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থায় কর্তৃপক্ষই গ্রহীতার বাড়ি পর্যন্ত এসে গ্রহীতাদের ঋণ দেয় এবং সময়মতো তা আদায় করে । ক্ষুদ্র ঋণে দরিদ্রের স্বনির্ভরতা : স্বল্প পুঁজির মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে পুনর্বাসনের জন্য এবং স্বনির্ভর করে গড়ে তোলার জন্য যে প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয়েছে তা হলো ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচি । স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানে সরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়েও বেশি ভূমিকা রাখছে । বাংলাদেশেও সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বহু ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচির ব্যবস্থা করা হয়েছে । দারিদ্র্য বিমোচনে এ কর্মসূচির অবদান অনেক বেশি । নিম্নে এসব কর্মসূচি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো-

বাংলাদেশ পল্লিউন্নয়ন বোর্ড (BRDB) : বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায় Bangladesh Rural Development Board (BRDB) দেশব্যাপী সমবায় ও আনুষ্ঠানিক গ্রুপ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার আর্থিক সহায়তায় পল্লি-দারিদ্র্য বিমোচনে কাজ করে আসছে । BRDB-এর উদ্যোগে পল্লি অঞ্চলে প্রায় ১৫০০টি সমবায় সমিতি ও আনুষ্ঠানিক দল গঠন করা হয়েছে । এরা গ্রামবাসীদের মধ্যে প্রচুর টাকা বিতরণ করে ।

বাংলাদেশ পল্লিউন্নয়ন একাডেমি (BARD) : বরিশাল, বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালীসহ ৮টি জেলার ৩০টি উপজেলায় Bangladesh Academy for Rural Development (BARD)-এর অধীনে ক্ষুদ্র কৃষক ও ভূমিহীন শ্রমিক উন্নয়ন প্রকল্প নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয় । এটি কুমিল্লায় অবস্থিত । এ প্রকল্পের আওতায় প্রথমে ১২২টি প্রশিক্ষণ কর্মশালার মাধ্যমে ২,২২৫ জন মহিলা এবং ৩,৩২০ জন পুরুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় । প্রথম দিকে বাংলাদেশ পল্লিউন্নয়ন একাডেমির আওতায় ৩০০টি গ্রামের ১৬,৬০৩টি পরিবারকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় । তারপর থেকে প্রতিবছর পর্যায়ক্রমে অসংখ্য গ্রামকে এ প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে, যা ‘এক গ্রাম এক সমিতি’ নীতির মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। BARD-এর গবেষণার প্রধান উদ্দেশ্য পল্লি অঞ্চলের আর্থসামাজিক সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া এবং সমাধান করা। কৃষি, সমবায়, দারিদ্র্য, ক্ষুদ্র ঋণ, গ্রামীণ শিল্প, গ্রামীণ ভৌত অবকাঠামোসহ আরও অনেক বিষয়ে BARD গবেষণা করে ।

গৃহায়ণ তহবিল : বাংলাদেশে প্রতিবছর বর্ষাকালে অধিক বৃষ্টির ফলে এবং বর্ষার পরে বন্যার পানি কমে গেলে নদী ভাঙন শুরু হয় । এতে নদীর তীরে বসবাসকারী জনগণ গৃহহীন হয়ে পড়ে । তাই বাংলাদেশ সরকার দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য গৃহায়ণ তহবিল গঠন করেন । গ্রামীণ দরিদ্র জনগণের জন্য ‘গৃহায়ণ তহবিল’ গৃহনির্মাণ কর্মসূচির আওতায় অনেক টাকা বরাদ্দ করে এবং অসংখ্য গৃহনির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে । তাছাড়া গৃহায়ণ তহবিল দরিদ্র শ্রমজীবী মহিলাদের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত আবাসিক সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে হোস্টেল নির্মাণ প্রকল্পে টাকা বরাদ্দ করে ।

দারিদ্র্য বিমোচনে কর্মসংস্থান ব্যাংক : বাংলাদেশের দরিদ্র জনগণের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ১৯৯৮ সালের ২২ সেপ্টেম্বর কর্মসংস্থান ব্যাংক যাত্রা শুরু করে । এ ব্যাংকের উদ্দেশ্য বেকার যুবকদের এবং দরিদ্রদের পুনর্বাসনের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা । বিভিন্ন লাভজনক ও উৎপাদনমুখী কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে এ ব্যাংক বেকার যুবকদের ঋণ প্রদান করে । প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এ পর্যন্ত কর্মসংস্থান ব্যাংক বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার অসংখ্য সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে অনেক টাকা ঋণ দিয়েছে ।

দারিদ্র্য বিমোচনে আত্মকর্মসংস্থান : বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে । আত্মকর্মসংস্থান অধিদপ্তর প্রায় ৩৫ লক্ষ যুবক-যুবতিকে দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ দেয় । এর মধ্য থেকে প্রায় ২০ লক্ষ বেকারকে কর্মসংস্থানে নিয়োগ দেওয়া হয় । শিক্ষিত বেকার যুবকদের ৭০টি কেন্দ্রের মাধ্যমে ইন্টারনেট ও নেটওয়ার্কিংসহ কম্পিউটার বেসিক ও গ্রাফিক্স ডিজাইন কোর্সে প্রায় ১ (এক) লক্ষ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় ।

দারিদ্র্য বিমোচনে, গ্রামীণ ব্যাংক : বাংলাদেশের গ্রামের দরিদ্র জনগণের দারিদ্র্য বিমোচনে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে গ্রামীণ ব্যাংক । বাংলাদেশের গ্রামের দরিদ্র জনগণকে গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে সহায়তা করে । গ্রামীণ ব্যাংক সারা বাংলাদেশের দরিদ্র জনগণকে যেমন ঋণ দিয়েছে, তেমনি DPS-এর মাধ্যমে সামান্য সঞ্চয়ের সুযোগও করে দিয়েছে । ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানে অসামান্য অবদানের জন্য গ্রামীণ ব্যাংক এবং এর প্রতিষ্ঠাতা ড. মোহাম্মদ ইউনূস যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ।

দারিদ্র্য রিমোচনে মৎস্য অধিদপ্তর : দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য মৎস্য অধিদপ্তর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে । গ্রামের দরিদ্র মৎস্য চাষিদের মৎস্য চাষের জন্য সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা ঋণ দেয় মৎস্য অধিদপ্তর । মৎস্য অধিদপ্তর বিনা জামানতে চাষিদের ঋণ দিয়ে থাকে । সংস্থাটি এ পর্যন্ত প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে এবং সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৩ লক্ষেরও অনেক বেশি । 

দারিদ্র্য বিমোচনে ব্র্যাক : দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ রুরাল এডভান্সমেন্ট কমিটি (ব্র্যাক) বিশেষ অবদান রেখে আসছে। ২০০৯ সাল পর্যন্ত ব্র্যাক উপার্জনমূলক কর্মতৎপরতা বৃদ্ধির জন্য ৬,৯৮২.০৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিতরণ করেছে । অপরদিকে, সঞ্চয়কৃত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৬৮.৫৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এছাড়াও দারিদ্র নিরসনে ক্রমোন্নতির ধারা অব্যাহত রয়েছে । দারিদ্র্য বিমোচনে আশা : বাংলাদেশের দরিদ্রদের মধ্যে ১৯৯২ সাল থেকে ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান করে আসছে অ্যাসোসিয়েশন অব সোশ্যাল এডভান্সমেন্ট (আশা)। ২০১০ সাল পর্যন্ত আশার সদস্যদের সঞ্চয়ের পরিমাণ ছিল মোট ৫,৩০০ কোটি টাকা এবং ৫৬,৫৬,২৫৭ জন সদস্যকে ৪১,০৬২.৮৪ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়।

ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের সফলতা : বাংলাদেশ একটি নিম্ন-মধ্যম আয়ের উন্নয়নশীল দেশ। স্বাধীনতার দশ বছর পরও আমাদের দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হার ছিল ৭৩ শতাংশ। ৪৫ বছর পর দরিদ্র জনসংখ্যার হার দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২.৯ শতাংশ । বাংলাদেশের দরিদ্র জনগণের দারিদ্র্য বিমোচনে কাজ করছে সরকারি ও বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠান। গ্রামের দরিদ্র জনগণ অল্প টাকা ঋণ নিয়ে অল্প অল্প করে ঋণ পরিশোধ করতে স্বাচ্ছ্যন্দবোধ করে। ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলো জনগণের সুবিধা বুঝেই অল্প টাকা ঋণ দেয় । ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার সহায়তায় দিন দিন বাংলাদেশের দরিদ্র জনসংখ্যার পরিমাণ কমছে ।

উপসংহার : বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার কমাতে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচি। ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী সংস্থাগুলো দরিদ্র জনগকে অল্প সঞ্চয়ের সুযোগ করে দিয়েছে এবং জনগণের সুবিধা বুঝে অল্প ঋণ প্রদান করে, যাতে ঋণ পরিশোধে জনগণের কোনো অসুবিধা না হয়। ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচির বিশেষ অবদানের ফলে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় বেড়েছে এবং দরিদ্র জনগণের জীবনমানেরও পরিবর্তন হয়েছে । তাই আমরা বলতে পারি, ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচি দারিদ্র্য বিমোচনের সবচেয়ে বড়ো হাতিয়ার।