জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
অথবা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

[সংকেত : ভূমিকা; মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি; মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য; মুক্তিযুদ্ধের চেতনা; রাজনীতিক, সামাজিক ও অর্থনীতিক ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনুপস্থিতি; উপসংহার । ]

ভূমিকা : ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বিনিময়ে অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা। এ যুদ্ধ শুধু এদেশের স্বাধীন ভূখণ্ড আদায়ের যুদ্ধ ছিল না; এ যুদ্ধ ছিল বাঙালির আত্মমুক্তি ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার । ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে এ যুদ্ধ চূড়ান্তভাবে শুরু হলেও এর ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল বহুবছর আগেই। তাই বাঙালি জাতির জীবনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাস তাৎপর্যপূর্ণ।

মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি : মানুষ স্বভাবত স্বাধীনতাপ্রিয় । প্রতিটি মানুষ স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায় । তাই মানুষ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে । সুপ্রাচীনকাল থেকেই মানুষ স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করার জন্য নানাভাবে সংগ্রাম করে আসছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পেছনেও এক সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে । সেই ১৭৫৭ সালের কথা। তখন বাংলার স্বাধীন নবাব ছিলেন সিরাজ-উদ-দৌলা । ইংরেজরা ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন পলাশির প্রান্তরে এক ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে পরাজিত করে এদেশের অধিকার ছিনিয়ে নেয়। সেদিন থেকেই বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয় । তারপর বাঙালি প্রায় দুইশত বছর ইংরেজদের অধীনে। ছিল। তাদের শাসন-শােষণ, বঞ্চনা আর নানা অত্যাচারে বাঙালি নিষ্পেষিত হয়েছে । পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দি থাকা আর স্বাধীনতা হারানাের যন্ত্রণা তাদের প্রতিটি মুহূর্তকে বিষিয়ে তােলে। ইংরেজদের নিপীড়নে বিভিন্ন সময় এদেশের মানুষের মনে জন্ম নিয়েছে। ক্ষোভ আর আন্দোলনের চেতনা। ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাবে শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক মুসলমান অধ্যুষিত এলাকাগুলাের জন্য আলাদা আবাসভূমির দাবি জানান। তার এ প্রস্তাবেই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ বপন করা হয়। এরই ফলে ব্রিটিশরা এদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। তারপর ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি আলাদা রাষ্ট্র হয়। এর মধ্যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের আবার পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান নামে দুটি আলাদা ভূখণ্ড থেকে যায়। আর এদেশের মানুষ পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয় ।

পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্রের অন্তর্গত হলেও স্বাধীনতার সুফল ভােগ করতে পারেনি। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানিরা নিজেদের হাতে শাসন ক্ষমতা রেখে বাঙালিদের শাসন করতে থাকে। শিক্ষা, অর্থনীতি, প্রশাসনিক ও সামগ্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে তারা বৈষম্য শুরু করে। পূর্ব পাকিস্তানিরা সকলক্ষেত্রে অবহেলার পাত্র ও সুবিধাবঞ্চিত হয়। ফলে তাদের মনে আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে । পশ্চিমারা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে আমাদের মাতৃভাষাকে কেড়ে নিতে চাইল । এরই ফলে ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি শুরু হয় ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার রক্তিম সংগ্রাম। এরপর ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক নির্বাচনে বাঙালির সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয় অর্জিত হলে এদেশের মানুষ আরও অধিকার সচেতন হয়ে ওঠে। ১৯৬৯ সালে দেশে গণঅভ্যুত্থান ঘটে। ১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু তৎকালীন ক্ষমতাসীন ইয়াহিয়া সরকার ক্ষমতা ছাড়তে নানা টালবাহানা শুরু করে। ফলে বাঙালিরা আরও ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। আর বাঙালিদের স্বাধিকার চেতনাকে নস্যাৎ করে। দেওয়ার জন্য ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে লেলিয়ে দেয়। ফলে ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ রাতের গভীরে ঘমন্ত। বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, গণহত্যা চালায়। বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। সমগ্র দেশের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে।

মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য : ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ কালােরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদেশের অসহায় মানুষের ওপর নির্বিচারে ঝাপিয়ে পড়েছিল। তারা এদেশে ভয়ানক হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল। তাদের অত্যাচার-নির্যাতন ও জুলুম থেকে রক্ষা পেয়ে। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সেদিন এদেশবাসী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। প্রত্যাশা ছিল, সে স্বাধীন দেশে সকলের জন্য অবারিত হবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তাসহ নানা সুযােগ-সুবিধা। মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল একটি শােষণমুক্ত স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা : বাঙালি জাতিসত্তার ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনেক গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ। দুই লক্ষ মা-বােনের সম্ভ্রম আর ত্রিশ লক্ষ শহিদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই স্বাধীনতা। বাঙালি জাতির জীবনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কতটুকু গভীর তা আমরা তৎকালীন অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের একটি বেতার ভাষণ থেকে উপলব্ধি করতে পারি । তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি সেসব শহিদদের কথা সেসব অসীম সাহসী বীর মুক্তিযােদ্ধাদের যারা তাদের আত্মবলিদানের জন্য অমর হয়েছেন, তাঁরাই আমাদের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন চিরকাল । সত্যিই বাঙালির চেতনায় বহুবছর আগে থেকেই স্বাধীনতার স্বপ্ন ছিল । অবশেষে অনেক কষ্টের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার চেতনা বাঙালি আজ ধরে রাখতে পারেনি । আজ স্বাধীনতা লাভের পর ছেচল্লিশ বছর কেটে গেলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যথার্থ প্রতিফলন ঘটেনি। বাঙালি জাতি আজ ভুলে যেতে বসেছে নয়মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে আজ শুধু মিথ্যা আর প্রবঞ্চনার ছড়াছড়ি। জাতি আজ বিবেকহীন। মানুষের মধ্যে থেকে মানবিক মূল্যবােধ ও নৈতিকতা বিলীন হয়ে যাচ্ছে। মানুষের মান-অপমানবােধ ও মনুষ্যত্ব। বলতে আজ আর কিছু নেই। এই পরিস্থিতিতে অনেকেই প্রশ্ন তুলতে পারে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আমরা কতটুকু ধারণ করতে পেরেছি? আমরা যদি মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনায় উজ্জীবিত হতে পারতাম, তাহলে আজ এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতাে না। এমনকি আমরা। অগণিত মানুষের আত্মদানের কথা ভুলে যেতে পারতাম না। আমরা যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাসকে ভুলে যাচ্ছি, তা আমাদের কাজকর্মে ও আচরণে প্রকাশ পায় । তাছাড়া ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাঝেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আমরা জাগ্রত করিনি। এ প্রজন্মের কেউ কেউ এ ইতিহাস জানলেও অদূর ভবিষ্যতে হয়তাে সবাই বিস্মৃত হবে। কারণ আজকের পরিস্থিতিতেই লক্ষ করা যাচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সকলের মধ্যে প্রায় স্তিমিত । তাই আগামী একযুগ পরে কেমন হবে তা কল্পনাতীত নয় ।

রাজনীতিক, সামাজিক ও অর্থনীতিক ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনুপস্থিতি : রাজনীতিক, সামাজিক ও অর্থনীতিক ক্ষেত্রে আজ আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভিত্তিক একটি সমাজ ও অর্থনীতি আমরা গড়তে পারিনি। অথচ আমাদের যে রাজনৈতিক চেতনা তথা রাজনীতিক সংস্কৃতি ছিল। তা সুসংবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল একটি জাতি গঠনে সহায়ক হতে পারত। আর তা না পারার কারণ হলাে ক্ষমতার লােভ এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠোর শাসন না থাকা। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে আকাক্ষা ও চেতনাকে সামনে রেখে আমরা যুদ্ধ করেছিলাম তা যেন এখন আমরা অনেকেই ভুলতে বসেছি। আমাদের সমাজজীবন নানাভাবে কলুষিত হয়ে গেছে। সমাজজীবনের চরম অবক্ষয় যেন অপ্রতিরােধ্য হয়ে উঠেছে। এ অবক্ষয়ের। চিত্র যুবসমাজকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করছে। তাদের নৈতিকতা ও মনুষ্যত্ববােধ সবকিছু নিঃশেষ হতে চলেছে। তাদের সামনে আজ কোনাে আদর্শ নেই। আমাদের দেশের যুবসমাজের অবক্ষয়ের প্রধান কারণ হলাে আর্থনীতিক ও রাজনীতিক দুর্বলতা । রাজনীতিক, দৈন্য, ক্ষমতার লােভ, দ্বন্দ্ব-কলহ, আর্থনীতিক দুর্দশা, শিক্ষাজগতে নৈরাজ্য ও স্বেচ্ছাচারিতা যুবসমাজকে বিপথগামী করেছে। তারা দেখতে পায়, সমাজে একজন জ্ঞানী-গুণীকে কেউ সম্মান করে না, মূল্যায়ন করে না। অথচ একজন ক্ষমতাশালী। লােককে সবাই ভয় পায়, সম্মান করে। তার কথায় সকলে ওঠে-বসে। বড়াে ধরনের অন্যায় কাজ করলেও আইন তাকে নিরাপদ রাখে । এসব নানা নেতিবাচক দিক তখন আমাদের যুবসমাজ গ্রহণ করে। আর এভাবেই সামাজিক, মানবিক ও ধর্মীয় মূল্যবােধ কমে যাচ্ছে।

যুবসমাজই হলাে দেশের ভবিষ্যৎ। তারা ভেঙে পড়লে জাতির অকল্যাণ সুনিশ্চিত। তাই আমাদের যুবসমাজকে সুসংগঠিত করে তাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগিয়ে তুলতে হবে এবং তাদের সত্য ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করতে হবে । মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি জাতি যে চেতনায় উজ্জীবিত হয়েছিল তা যুবসমাজকে জানাতে হবে। কারণ তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারলে দেশ উন্নত। হবে । কেবল তারাই পারবে সমাজের সকল অনাচার দূর করে দুর্নীতিমুক্ত একটি সুখী-সমৃদ্ধ সােনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করতে ।

উপসংহার : বহুকষ্টের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আজ বিপন্ন হতে চলেছে। তাই জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিকাশ ঘটাতে হবে। তবেই এদেশের জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতি সম্ভব।