গ্রাম ও শহরের ব্যবধান অপসারণ

[ সংকেত : ভূমিকা; গ্রামের অতীত ঐতিহ্য; বর্তমানকালে গ্রাম এবং গ্রামীণ জীবন; বর্তমানকালে শহর এবং শহুরে জীবন; গ্রামীণ জীবন এবং শহুরে জীবনের পার্থক্য; শহুরে জীবনের সুবিধাসমূহ; গ্রামের বর্তমান দুরবস্থা ও তার কারণ; গ্রাম ও শহরের ব্যবধান অপসারণের গুরুত্ব; গ্রাম ও শহরের ব্যবধান অপসারণে করণীয়; উপসংহার । ]

ভূমিকা : ছায়া ঢাকা পাখি-ডাকা গ্রামবাংলা একসময় অফুরন্ত সম্পদের ভান্ডার ছিল। কিন্তু বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব কল্যাণে শহরগুলাে হয়ে উঠেছে সকল কিছুর প্রাণকেন্দ্র। শহরের মানুষের সংস্কৃতি, জীবনযাত্রার মান হয়ে উঠেছে লােভনীয় । তাদের জীবনধারায় চলছে আধুনিকতার ছন্দ। অন্যদিকে, গ্রামের মানুষ বৈচিত্র্য ও ছন্দহীন জীবনযাপন করে আসছে বলে তাদের দুঃখ-দৈন্যের শেষ নেই। সুবিধা-বঞ্চিত গ্রামবাসী মানবেতর জীবনযাপন করে। তাই গ্রাম ও শহরের ব্যবধান অপসারণ করা অতীব জরুরি।

গ্রামের অতীত ঐতিহ্য : গ্রামের অতীত ঐতিহ্য ছিল গৌরবের। গােলাভরা ধান, গােয়ালভরা গােরু, পুকুরভরা মাছ ও ক্ষেতভরা ফসলে গ্রামবাংলা ছিল সমৃদ্ধ। কৃষকের মুখে সর্বদা হাসি লেগেই থাকত। ঘরে ঘরে তৈরি হতাে কুটির শিল্পজাত পণ্য । কষাণিরা সারাদিন ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকত। মােটকথা, সুজলা-সুফলা-শস্য শ্যামলা গ্রামবাংলা একদা ছিল অফুরন্ত সম্পদ ও সৌন্দর্যের ভান্ডার। 

বর্তমানকালে গ্রাম এবং গ্রামীণ জীবন : গ্রামের শান্ত-স্নিগ্ধ আগের রূপটি এখন আর নেই। কৃষকেরা মনের আনন্দে মাঠে ফসল ফলাত। সপ্তাহে এক বা দুই দিন হাট বসত। কৃষকেরা সে হাটে বেচাকেনা করত। প্রকৃতির বুক ছিল স্নিগ্ধতায় ভরা, সৌন্দর্যে অপরূপ। গ্রামের মানুষের জীবনে ছিল শান্তি আর কণ্ঠে ছিল মধুমাখা গান । কিন্তু এখন আর সেদিন নেই। অশিক্ষা ও অনাহারেঅর্ধাহারে মানুষ আজ বিপর্যস্ত। অভাব-অনটন, দুঃখ-দারিদ্র্য তাদের নিত্যসঙ্গী। গ্রামের শিক্ষিত লােকেরা এখন আর গ্রামে থাকতে চায় না। তারা শহরে গিয়ে ভিড় জমায়। গ্রাম আজ শ্রীহীন। একসময় কুটির শিল্পজাত পণ্য উৎপাদন করে গ্রামবাসী প্রচুর টাকা উপার্জন করত। সেই কুটিরশিল্প আজ বিলুপ্ত প্রায়। 

বর্তমানকালে শহর এবং শহুরে জীবন : শহরে রয়েছে আকাশচুম্বী দালানকোঠা, প্রশস্ত রাস্তা, বিরাট বিরাট শপিংমল প্রভৃতি । শহুরে মানুষের চাকচিক্যময় জীবনযাপন দেখলে মনে হয় তারা এক ভিন্ন জগতের মানুষ। তাদের চালচলন, কথাবার্তা, জীবনরীতি গ্রামের মানুষের কাছে পরম লােভনীয় বলে প্রতিভাত হয়। শহরের মানুষের মধ্যে চলে টাকা উপার্জনের অশুভ প্রতিযােগিতা। সেখানে মানুষের মাঝে প্রীতির বন্ধন দৃঢ় নয়। শিক্ষিত শ্রেণির বসবাস হলেও শহরের মানুষের মধ্যে মানবতার ছোঁয়া নেই। কৃত্রিম আভিজাত্য সেখানে দানা বেঁধে আছে। শহরের মানুষগুলাে স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক। এখানে দীন-দরিদ্রের প্রতি সকলেই ভ্রুক্ষেপহীন, আত্মনিমগ্ন ব্যস্ত মানুষ কেউ কারও কুশল জিজ্ঞাসা করে না। জিজ্ঞাসা করে না কোথায় নিবাস, কোথায় ঠিকানা। শহরের মানুষ কেউ কারও দিকে তাকায় না। আবার যদিও বা কেউ তাকায় সে দৃষ্টিতে মায়া নেই, মমতা নেই। শহরে টাকার বিনিময়ে সবকিছুই পাওয়া যায় । টাকাই এখানকার নিয়ন্তা। শহরের মানুষের জীবনযাত্রার মান অনেক উঁচু। তরিতরকারি ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্য গ্রাম থেকে শহরে আসে। শহরের জীবনযাপন চাকচিক্যময় হলেও মানুষের বাসস্থান সমস্যা, ঘিঞ্জি পরিবেশ, অপরিচ্ছন্ন অলি-গলি, বিভিন্ন দুর্ঘটনা এসবের কারণে শহুরে জীবন দুর্ভোগের শিকার । তথাপিও শহরে হাতের কাছেই প্রয়ােজনীয় সব জিনিস পাওয়া যায়। তাছাড়া শিক্ষা, চিকিৎসা, যােগাযােগ, বিনােদন এসবকিছুরই শহরে সুব্যবস্থা রয়েছে। আর এসব কারণে শহুরে জীবন স্বাভাবিকভাবেই গ্রামীণ জীবন থেকে উন্নততর ও বিলাসবহুল । 

গ্রামীণ জীবন এবং শহুরে জীবনের পার্থক্য : ব্যবসায়-বাণিজ্য ও শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু হলাে শহর। তাই অফিস-আদালত, ভালাে স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, বিভিন্ন শপিংমল, শিল্পকারখানা সবকিছু শহরাঞ্চলে গড়ে উঠেছে। পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, বিনােদনের সুব্যবস্থা, বিলাসবহুল দালানকোঠা, সবকিছুই শহরের জীবনযাত্রার মানকে উন্নত ও আরামদায়ক করেছে। অন্যদিকে, গ্রামগুলাে শহর থেকে অনেক দূরবর্তী স্থানে অবস্থিত হওয়ায় সবরকম সুযােগ-সুবিধা পায় না। তাছাড়া জীবনধারণের জন্য প্রয়ােজনীয় সব উপকরণ গ্রামে পাওয়া যায় না। দুঃখ-দারিদ্র্য, অশিক্ষা, রােগ-শােক গ্রামের মানুষের নিত্যসঙ্গী। শহুরে জীবনের মতাে গ্রামীণ জীবনে বিলাসিতা নেই ।

শহুরে জীবনের সুবিধাসমূহ : আধুনিক শিক্ষা-সভ্যতার সকল প্রকার সুযােগ-সুবিধা শহুরে জীবনে বিদ্যমান। শহরে মানুষের আনন্দবিনােদনের জন্য রয়েছে সিনেমা হল, পার্ক, উদ্যান, চিড়িয়াখানা, যাদুঘর, শিশুপার্ক, বিভিন্ন রেস্তোরা এবং শহরের প্রায় প্রতিটি ঘরেই রয়েছে টিভি, ফ্রিজ, ডিভিডি, ভিসিআর ইত্যাদি। গরমকালে ঘর ঠান্ডা রাখার জন্য রয়েছে এয়ারকন্ডিশনার। এছাড়াও রয়েছে | দৈনন্দিন কাজকর্মে ব্যবহৃত বিভিন্ন ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি। মানুষের চিকিৎসা সেবার জন্য পাশেই রয়েছে ডাক্তার, হাসপাতাল, ক্লিনিক | ও বিভিন্ন বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্র। একস্থান থেকে অন্যস্থানে অতি সহজে যাতায়াতের জন্য রয়েছে রিকশা, অটোরিকশা, সিএনজি চালিত অটোরিকশা, বাস, ট্যাক্সি প্রভৃতি। মানুষের নাগরিক অধিকার ও নিরাপত্তার জন্য রয়েছে আদালত, পুলিশ, র্যাবসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা। মােটকথা, শহরের মানুষ আধুনিক সব সুযােগ-সুবিধা পেয়ে জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছে।

গ্রামের বর্তমান দুরবস্থা ও তার কারণ : গ্রামের বর্তমান দুরবস্থার প্রধান কারণ হলাে শিল্পায়নের প্রভাবে মানুষের শহরমুখী হয়ে | যাওয়া। শিল্প বিপ্লবের ফলে বিভিন্ন কল-কারখানা স্থাপিত হওয়ায় নতুন নতুন শহর বা শহরের পত্তন হয়েছে। ফলে শিল্প-কারখানার – পাশাপাশি বিভিন্ন অফিস-আদালতও এসব শহরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে নগর সভ্যতার পত্তন হয়েছে। শহরগুলােতে দিন দিন বিভিন্ন | কর্মসংস্থানের সুযােগ সৃষ্টি হওয়ায় গ্রামের মানুষ শহরের দিকে ছুটে চলে। গ্রামের শিক্ষিত লােকেরাও শহরে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস। শুরু করে। অন্যদিকে শহরের কল-কারখানায় উৎপাদিত ভােগ্যপণ্যের সাথে প্রতিযােগিতায় টিকতে না পেরে গ্রামের উৎপাদিত কুটির শিল্পজাত পণ্যগুলাে বিলুপ্ত হতে চলেছে। ফলে স্বাভাবিক কারণেই গ্রামের মানুষ ক্রমশ বেকার হতে চলেছে। আর অভাব-অনটনে দিন কাটাচ্ছে। এসব কারণে গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার সাথে শহরের মানুষের জীবনযাত্রার প্রতিনিয়ত ব্যবধান সৃষ্টি হচ্ছে। 

গ্রাম ও শহরের ব্যবধান অপসারণের গুরুত্ব : বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এদেশের প্রায় ৮০% লোেক গ্রামে বাস করে। সুপ্রাচীনকাল থেকে গ্রামকে কেন্দ্র করেই এদেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রসার ঘটেছে। এছাড়া দেশের জাতীয় অর্থনীতি মূলত গ্রাম নির্ভর । তাই গ্রামােন্নয়ন ব্যতীত এদেশের সার্বিক উন্নয়ন অকল্পনীয়। গ্রামের বিশাল জনগােষ্ঠীকে অনগ্রসর রেখে জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়। শহরের উন্নয়ন দিয়ে শুধু স্বল্প সংখ্যক লােকের আর্থনীতিক উন্নতি নিশ্চিত হতে পারে। কিন্তু গােটা দেশের উন্নতি সম্ভব নয়। তাই আমাদের প্রধান করণীয় হলাে গ্রাম ও শহরের ব্যবধান অপসারণ করা।

গ্রাম ও শহরের ব্যবধান অপসারণে করণীয় : গ্রাম ও শহরের ব্যাপক ব্যবধান অপসারণ ব্যতীত একটি দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব | নয়। কতিপয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে গ্রাম ও শহরের ব্যবধান অপসারণ করা যায়। নিমে সেগুলাে তুলে ধরা হলাে:

১. শহর ও গ্রামের যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন : শহর ও গ্রামের ব্যবধান অপসারণের জন্য প্রথমে যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন করতে হবে। এজন্য গ্রামের রাস্তাঘাটের উন্নয়ন ঘটিয়ে শহরের সাথে সংযােগ স্থাপন করতে হবে, যাতে শহরের | জিনিসপত্র সহজে গ্রামে ও গ্রামের জিনিসপত্র সহজে শহরে আনা-নেওয়া করা যায় । 

২. প্রশাসনিক অফিস স্থানান্তর : সব অফিস, আদালত শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। তাই এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিরা গ্রাম। ছেড়ে শহরে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করে। এসব প্রশাসনিক অফিসের কিছু অফিস যদি জেলা ও উপজেলা সদরে বা বিভাগীয় শহরে স্থানান্তর করা যায়, তবে গ্রাম ও শহরের ব্যবধান অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। 

৩. শিক্ষার প্রসার: গ্রামের অধিকাংশ মানুষই অজ্ঞ ও অশিক্ষিত। শিক্ষার আলাে থেকে বঞ্চিত এসব মানুষকে দক্ষ ও যােগ্য কর্মী। হিসেবে গড়ে তােলার জন্য শিক্ষার আলাে প্রজ্বলন অতীব জরুরি। গ্রামের প্রতিটি মানুষ যেন শিক্ষার সুফল ভােগ করতে পারে এজন্য উপজেলা ও মফস্বল অঞ্চলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সম্প্রসারণ ঘটাতে হবে। গ্রামের অজ্ঞ লােকজনের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটাতে পারলে গ্রাম ও শহরের ব্যবধান কমিয়ে আনা সহজ হবে। 

৪. কৃষির উন্নয়ন : বাংলাদেশের বাস্তবতায় কৃষির উন্নয়ন ব্যতীত দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য কৃষির আধুনিকায়ন অত্যন্ত প্রয়ােজন। সেজন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করতে হবে। তাছাড়া জমিতে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও পানি সেচ দেওয়ার সুব্যবস্থা করতে হবে। তাহলেই গ্রামের অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত হবে। এভাবে শহরের সাথে গ্রামের বৈষম্য কিছুটা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। 

৫. পল্লি বিদ্যুতায়ন : বাংলাদেশে এখনও এমন অনেক গ্রাম আছে, যেখানে বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। প্রতিটি গ্রামকে পল্লি বিদ্যুতের আওতাভুক্ত করতে পারলে, গ্রামে গ্যাস, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করে জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে পারলে গ্রাম ও শহরের ব্যবধান ধীরে ধীরে কমে আসবে। 

৬. কুটিরশিল্পের প্রসার : গ্রামীণ অর্থনীতিক উন্নতির জন্য কুটিরশিল্পের প্রসার অনেক দরকার। কেননা কুটির শিল্পজাত পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করে অনেক লােকের কর্মসংস্থানের সুযােগ সৃষ্টি হতে পারে। অতীতে কুটিরশিল্পের যে ঐতিহ্য ছিল তা পুনরুদ্ধার করে গ্রামের বেকার সমস্যা দূর করা সম্ভব। তাহলেই শহর ও গ্রামের ব্যবধান অনেকাংশে কমে আসবে। চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রসার ও গ্রামের অনেক মানুষ অভাব-অনটনে দিন কাটায়। তারা সুষম খাদ্য থেকে বঞ্চিত। স্বাভাবিক কারণেই অপুষ্টির শিকার। ফলে নানা রােগ-ব্যাধিতে তারা আক্রান্ত হয়। গ্রামে উন্নত চিকিৎসার সুযােগ না থাকায় বাধ্য হয়ে তাদের চিকিৎসার জন্য শহরে যেতে হয়। গ্রামে চিকিৎসার সুব্যবস্থার জন্য বিভিন্ন চিকিৎসা প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে গ্রাম ও শহরের ব্যবধান অনেকাংশে কমে আসবে। 

উপসংহার : গ্রাম ও শহরের ব্যবধান চিরকালীন। শহরে নাগরিক সভ্যতার সবরকম সুযােগ-সুবিধা বিদ্যমান কিন্তু গ্রামগুলাে আধুনিক নাগরিক সুযােগ-সুবিধা বঞ্চিত। উপরিউক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে গ্রামের উন্নয়ন সাধন করা যায়। তাহলেই গ্রাম ও শহরের ব্যবধান অনেকাংশে কমে আসবে।