গণশিক্ষা

বয়স্ক শিক্ষা,

নিরক্ষরতা দূরীকরণ,

নিরক্ষরতা দূরীকরণে অভিযান

[ রচনা সংকেত : ভূমিকা, শিক্ষার অধিকার ও নিরক্ষরতা, গণশিক্ষার গুরুত্ব, গণশিক্ষা কখন ও কেন দরকার হয়, বর্তমান গণশিক্ষার অবস্থা, গণশিক্ষা ব্যাহত হবার কারণ, গণশিক্ষা বিস্তারে গণমাধ্যমের ভূমিকা, শিক্ষিত মানুষের কর্তব্য, গণশিক্ষার সুফল, উপসংহার। ]

ভূমিকা : দেশের শিক্ষার হার বৃদ্ধি তথা নিরক্ষরতা দূরীকরণের লক্ষ্যে সাধারণ মানুষের মধ্যে শিক্ষার সম্প্রসারণকে গণশিক্ষা বলা যায়। শিক্ষা মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার। তাই সমাজের একটি নির্দিষ্ট ভাগ্যবান শ্রেণীই যদি শুধু শিক্ষা পায় এবং অন্যেরা নিরক্ষর থাকে, তবে তা দেশের উন্নয়নের জন্য বড় অন্তরায়। আমাদের দেশে সাক্ষরতার হার মাত্র ৬৪ ভাগের মতো। আবার সাক্ষরতাই কিন্তু প্রকৃত শিক্ষার মাপকাঠি নয়। কারণ, সাক্ষর মানুষ মাত্রই শিক্ষিত নয়। সুতরাং দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অশিক্ষিত মানুষকে কেবল সাক্ষর করাই যথেষ্ট নয়। সাক্ষরতা দানের পাশাপাশি নানা সামাজিক এবং পেশাভিত্তিক বিষয়ে শিক্ষাদান ও গণমানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিই গণশিক্ষার লক্ষ্য হওয়া উচিত। 

শিক্ষার অধিকার ও নিরক্ষরতা : শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। তাছাড়া শিক্ষার মধ্যদিয়ে মানুষ জ্ঞানার্জন করে অজ্ঞতা দূর করে। ফলে সে ভালমন্দ বুঝে পথ চলতে পারে। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনেও সফলতা আনয়ন করতে পারে। এ কারণে কোরআন হাদীসেও শিক্ষা অর্জনের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করে প্রত্যেক দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষা বিস্তারের জন্য নানামুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে যায়। শিক্ষার জন্য বরাদ্ধ দেয়া হয় বিপুল পরিমাণ অর্থ। তাছাড়া জাতিসংঘ শিক্ষা বিস্তারের জন্য নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। কিন্তু এতকিছুর পরও অনেক দেশ থেকে যাচ্ছে অন্ধকারে। সেসব দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী নিরক্ষরতার অভিশাপ বহন করছে। এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাতিন আমেরিকার অনেক দেশের মানুষ এখনও নিরক্ষর। বাংলাদেশেও নিরক্ষর মানুষের সংখ্যা কম নয়। শিক্ষার অভাব এদেশের মানুষকে পিছিয়ে রেখেছে পাশাপাশি দেশও পড়ে আছে অন্ধকারে। দেশ ভৌগোলিকভাবে স্বাধীন হলেও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এদেশের মানুষের জীবনে এখনও আসেনি। এর পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে নিরক্ষরতা। সরকারি হিসবে মতে বাংলাদেশে ৬২% লোক শিক্ষিত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শিক্ষিত মানুষের হার আরও কম। শিক্ষার হার বাড়ানো না গেলে দেশকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে না। এজন্য প্রয়োজন সমন্বিত কার্যক্রম ও বাস্তবায়নের পরিকল্পনা।

গণশিক্ষার গুরুত্ব : আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষই অশিক্ষিত। আর একথা বলাবাহুল্য যে, আমাদের দারিদ্র্যের একটি প্রধান কারণ হলো শিক্ষার অভাব। অশিক্ষিত লোক শুধু দারিদ্র্যেরই কারণ নয়, এর ফলে নানা সামাজিক সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। আমরা দেখতে পাই বিশ্বের যে দেশে শিক্ষার হার যত বেশি সাধারণভাবে সে দেশ তত উন্নত। এর ব্যতিক্রম দক্ষিণ এশিয়া নয়। দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের মধ্যে শ্রীলঙ্কার শিক্ষার হার ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। তাই যুদ্ধ বিধ্বস্ত হওয়া সত্ত্বেও দেশটির মাথাপিছু আয় উল্লিখিত ৩টি দেশের চেয়ে বেশি, তাদের জীবনযাত্রাও আমাদের চেয়ে অনেক উন্নত। আমাদের দেশের পাঁচ কোটিরও বেশি লোক নিরক্ষরতা ও অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত। এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে অশিক্ষিত রেখে দেশকে উন্নত করার আকাঙ্ক্ষা আকাশকুসুম মাত্র। তাই অনতিবিলম্বে গণশিক্ষা কর্মসূচির ব্যাপক ও কার্যকরী সম্প্রসারণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

গণশিক্ষা কখন ও কেন দরকার হয় : সাধারণত উন্নত দেশগুলোতে দেশের প্রায় সব শিশুই নির্দিষ্ট বয়সেই স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের অনেক উন্নয়নশীল দেশেই দারিদ্র্য এবং অপরাপর অনেক কারণে সব শিশু নির্দিষ্ট বয়সে স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায় না। যারা বা পায়, তাদের মধ্যে একটি বড় অংশ প্রাথমিক শিক্ষা শেষ না করেই স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়। ফলে দেশের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ অশিক্ষিত বা নিরক্ষর থেকে যায়। মূলত বয়স পেরুনো মানুষের জন্য গ্রহণ করা হয় বয়স্ক শিক্ষা ব্যবস্থা। এছাড়া দরিদ্র শিশু, কর্মজীবী শিশু ও নারীদের শিক্ষার জন্য যে সব ব্যবস্থা রয়েছে তাও গণশিক্ষা কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় যারা শিক্ষা পাচ্ছে না, জনগোষ্ঠীর সে অংশকে সাক্ষর করার উদ্দেশ্যেই নেয়া হয় গণশিক্ষার নানা কর্মসূচি।

বর্তমান গণশিক্ষার অবস্থা : আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা যথেষ্ট গণমুখী নয়। তাই সাধারণ শিক্ষা সবার জন্য সহজলভ্য হয়ে ওঠে না। তবে ইতোমধ্যে গণশিক্ষার যে সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে সেগুলো বেশ কার্যকরী বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। সরকার সম্প্রতি পর্যায়ক্রমে এক একটি জেলাকে নিরক্ষরমুক্ত করার কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। মাগুরা জেলায় প্রথম এ কর্মসূচি সফলভাবে শেষ হয়। সরকারের পাশাপাশি অনেক এনজিও দেশে গণশিক্ষার নানা কর্মসূচি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। ফলে গত ৫-৬ বছরের মধ্যে দেশের সাক্ষরতার একটি সন্তোষজনক উন্নতি ঘটেছে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, এক্ষেত্রে মানুষকে শিক্ষিত করাই অধিক জরুরি। আর কাগজে কলমে শিক্ষার হার বাড়িয়ে কোন লাভ নেই। তাতে নিজেদের প্রতারিত করা হবে মাত্র।

গণশিক্ষা ব্যাহত হবার কারণ : গণশিক্ষাকে আরো বেশি কার্যকর করার জন্য সরকারকে আন্তরিক হতে হবে। আমাদের দেশের নিরক্ষরতা দূরীকরণ এখনও কোন সামাজিক আন্দোলনরূপে গড়ে ওঠেনি। গণশিক্ষার ব্যবস্থাটিও যথেষ্ট পরিকল্পিত নয়। বিভিন্ন সরকার বিক্ষিপ্তভাবে এক্ষেত্রে যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তার ফলাফল অনেক ক্ষেত্রেই পাওয়া গেছে অতি সামান্য। গণশিক্ষার জন্য অভিজ্ঞ শিক্ষক বা শিক্ষাঙ্গন নেই। এছাড়া যে সব সমস্যার কারণে অশিক্ষিত মানুষ শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হতে পারছে না সেদিকেও যথেষ্ট নজর দেয়া হয় না। ঘন ঘন সরকার বদল এবং একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা মাফিক অগ্রসর না হওয়া গণশিক্ষা বিস্তারের অন্তরায়। এ ছাড়াও দুর্নীতি এবং নানা প্রাসঙ্গিক জটিলতা গণশিক্ষা বিস্তারে অনেক ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

গণশিক্ষা বিস্তারে গণমাধ্যমের ভূমিকা : দেশের শিক্ষার হার বৃদ্ধির লক্ষ্যে রেডিও-টিভিকে কাজে লাগালে তা ফলদায়ক হতে পারে। কারণ, এগুলোর মাধ্যমে বিনোদনের মধ্যদিয়ে একজন মানুষকে শিক্ষার প্রতি আগ্রহী এবং সামাজিকভাবে সচেতন করে তোলা সম্ভব। নিরক্ষরতা দূরীকরণের পাশাপাশি কৃষক, শ্রমিকসহ নানা পেশার মানুষের পেশা সম্পৃক্ত বিষয়ের ওপর আলোকপাত করে রেডিও-টিভি তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়া স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা প্রভৃতি ক্ষেত্রে মানুষকে সচেতন করার জন্য রেডিও-টেলিভিশনকে আরও ব্যাপকভাবে কাজে লাগানো দরকার। এসব বিষয়ও গণশিক্ষার অন্তর্ভুক্ত।

শিক্ষিত মানুষের কর্তব্য : আমরা যারা শিক্ষিত তারা প্রায়ই ভুলে যাই অশিক্ষিত মানুষকে জ্ঞানের আলোকে প্রদীপ্ত করা আমাদেরই দায়িত্ব। কোন মানুষের শিক্ষা যখন অপরাপর মানুষের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয় তখনই সে শিক্ষা সার্থকতা লাভ করে। তাই দেশের শিক্ষিত সচেতন অংশের কর্তব্য নিরক্ষর মানুষ শিক্ষিত করবার খানিকটা হলেও দায়িত্ব গ্রহণ। এক্ষেত্রে শুধু সরকার কিংবা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নির্ভর করা যথেষ্ট হবে না। নার ওপর নির্ভর করা যথেষ্ট হবে না। আমাদের দেশের প্রত্যেকটি শিক্ষিত মানুষ যদি মাত্র একটি নিরক্ষর মানুষকে সাক্ষর করার দায়িত্ব গ্রহণ করে তাহলে সমাজ থেকে অশিক্ষা বা নিরক্ষরতার অন্ধকার দূর করা খুব সহজেই সম্ভব। এক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে বলে আমাদের বিশ্বাস। গণশিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে যদি গণশিক্ষা সম্পৃক্ত একটি নম্বরভিত্তিক ব্যবহারিক কোর্স রাখা হয়, তাহলে এ পদক্ষেপ দ্রুত কার্যকরী হবে।

গণশিক্ষার সুফল : প্রাথমিক শিক্ষার ফল পাওয়া যায় দেরিতে কিন্তু গণশিক্ষার ফল পাওয়া যায় সাথে সাথে। সকল মানুষই শিক্ষিত হতে চায়। কিন্তু যারা এ সুযোগ থেকে ছোটবেলায় বঞ্চিত হয়েছে তারা বড় হয়ে সুযোগ পেলে তা তারা হাত ছাড়া করতে চায় না। অনেক দেশে শুধু গণশিক্ষা নয় বরং অন্ধ, বধির, বিকলাঙ্গ মানুষদের রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে শিক্ষা এজন্য সহজ পদ্ধতি দান করা হয়। জীবন ও জীবিকার তাগিদে বয়স্ক মানুষ শিক্ষার পেছনে বেশি সময় দিতে পারে না। এজন্য সহজ ও সহজ উপকরণের মাধ্যমে তাদের শিক্ষা দান করলে দেশের বঞ্চিত গণমানুষ এর সুফল ভোগ করতে পারবে। 

উপসংহার : কেবল প্রচারের উদ্দেশ্যে কাগজে কলমে শিক্ষার হার বাড়িয়ে দেশের কোন উন্নতি আশা করা যায় না। এজন্য দরকার আন্তরিকতা ও কার্যকরী পদক্ষেপ। নিরক্ষরতা দূরীকরণকে একটি সামাজিক বা জাতীয় আন্দোলন রূপে গ্রহণ করা দরকার। কারণ, একবিংশ শতাব্দীতে অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী নিয়ে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা অসম্ভব। এজন্য কেবল সরকারের পদক্ষেপের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। দেশের সব শিক্ষিত মানুষকে এক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবার মন নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। আমরা যদি আমাদের একজন প্রতিবেশী, একজন অশিক্ষিত আত্মীয় বা ঘরের কাজের মেয়েটিকে সাক্ষর করার দায়িত্ব নেই— তাহলে খুব দ্রুতই নিরক্ষরতা দূরীভূত হতে পারে। মনে রাখা দরকার, গুটিকয়েক শিক্ষিত মানুষ জাতিকে উন্নত করতে পারে না। আর জাতির উন্নতির ওপরই নির্ভর করছে বিশ্বের বুকে আমাদের অবস্থানের তাৎপর্য। তাই আমাদের নিজেদের স্বার্থেই নিরক্ষরতার অন্ধকারের বিরুদ্ধে লড়ে যেতে হবে। কারণ, শিক্ষা যেভাবে দেশের ভাবমূর্তিকে নানাক্ষেত্রে দ্রুত উজ্জ্বল করতে পারে আর কোন কিছুতেই তা সম্ভব নয়।