একুশের চেতনা ও আমাদের সংস্কৃতি
একুশ আমার অহংকার
একুশে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য
জাতীয় জীবনে একুশের চেতনা ও তাৎপর্য

[ রচনা সংকেত :  ভূমিকা, একুশের চেতনা, ভাষা আন্দোলনের গোড়ার কথা, আন্দোলনে-সংগ্রামে বাংলাভাষা, একুশের প্রভাব, বাঙলা সংস্কৃতি ও একুশের চেতনা, উপসংহার । ]

ভূমিকা : প্রতিটি বিবেচনার জন্যে একটি ন্যূনতম মানদণ্ড বা প্রত্ন-প্রতিমার প্রয়োজন। অন্যথায় সে বীক্ষণ হয় খণ্ডিত, অসম্পূর্ণ ও একদেশদর্শী। একুশের চেতনা ও আমাদের সংস্কৃতির পরিচয় উদ্ধৃত করতে গেলেও প্রস্তাবিত বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের সুস্থ ও সম্পূর্ণ ধারণা থাকা আবশ্যক ।

একুশের চেতনা : ‘একুশের চেতনা ’ বলতে তাৎক্ষণিকভাবে ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে বোধ আমাদের মধ্যে স্তরীভূত হয়েছে তাকে বোঝায়। কিন্তু গভীরতর বিবেচনায় আমরা দেখি, এ পরিধি শুধু ১৯৫২ সালের ঘটনাবলি এবং একালে পূর্ব বাংলার অধিবাসীদের অন্তরে সৃষ্ট জাগরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না বরং তা হয় আরও ব্যাপক ও বিস্তৃত। তবে ভাষা আন্দোলনই এর মূল উৎস এবং এ সংক্ষিপ্ত সারণি ধরেই আমরা বৃহৎ জগতে উপনীত হয়েছি। ইতিহাস থেকে দৃষ্টান্ত সংগ্রহ করে বিষয়টি ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। স্পার্টাকাস ছিলেন একজন ক্রীতদাস। কিন্তু বিদ্রোহী হয়ে তিনি স্বতন্ত্রভাবে আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর নেতৃত্বে তখন সংগঠিত হয়েছিল একটি ক্রীতদাস বাহিনী। স্পার্টাকাসের সেনাবাহিনী রোম সাম্রাজ্যে আঘাত হানে এবং কিছুকালের জন্যে হলেও সিজারের আসনকে তারা টলিয়ে দিয়েছিল। পরবর্তীতে স্পার্টাকাস ব্যক্তিউর্ধ্ব তাৎপর্য এবং একটি আইডিয়া হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। নিপীড়িত মানুষের সংগ্রামী চৈতন্য হিসেবে তিনি কালাতিক্রমী মহিমায় ভাস্বর। ১৯৫২ সালে আমরা ভাষাকে কেন্দ্র করেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছি। একুশের চেতনা সেদিক থেকে একটি মূল্যবোধ, জীবনাদর্শ যা আমাদেরকে প্রতিবাদী করে তোলে এবং সর্বপ্রকার নিপীড়ন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে স্বকীয় সত্তা-স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত ও বিকশিত হওয়ার আহবান জানায় ।

আমাদের জাতিসত্তার স্বরূপ আবিষ্কারে একুশের অবদান অসামান্য। একুশের মাধ্যমেই আমরা পরিপূর্ণভাবে জেনেছি বাংলা আমাদের ভাষা, আমরা বাঙালি। একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই আমরা বাষট্টি, ছেষট্টি ও ঊনসত্তরে আন্দোলন করেছি। এর ফলে আমরা একাত্তর সালে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেছি। আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশে একুশের উজ্জীবনী শক্তি টনিকের মতো কাজ করে। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?’— আব্দুল গাফফার চৌধুরীর লেখা এ গান বাঙালির হৃদয়ে নতুন স্পন্দন জাগায় ।

ভাষা আন্দোলনের গোড়ার কথা : ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে যে ঘটনা ঘটেছিল তা প্রতিটি বাঙালির হৃদয়কেই রক্তাক্ত করে। দ্বিজাতি তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট তারিখে পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। পূর্ব বাংলায় মুসলমানরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বাংলা ভাষা এবং বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি চরম অবজ্ঞা পোষণ করে সেদিন বাঙালির হাতে যে নতুন শিকল পরানো হয় তার পরিণাম হয় মারাত্মক। পাকিস্তানের নব্য উপনিবেশবাদী, ক্ষমতালিপ্সু, উদ্ধত শাসকরা শুরু থেকেই এদেশের মানুষের উপর অত্যাচারের স্টিম রোলার চালাতে থাকে। প্রথমেই তারা ফন্দি আঁটে কিভাবে এদেশের মানুষের মুখের ভাষাকে কেড়ে নেয়া যায়। এ অংশের মানুষকে বসে রাখার জন্য তারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং বাঙালিদের ঘাড়ে পাকিস্তানি সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়ার নীল নকশা রচনা করে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে এক সমাবেশে ঘোষণা দেন, Urdu and Urdu shall be the state language of Pakistan. কিন্তু এদেশের ছাত্র-যুবকরা সে সমাবেশেই  No, No. It can’t be ধ্বনি তুলে তাঁর সে উর্দ্ধতপূর্ণ ঘোষণার সমুচিত জবাব দেয়)। (প্রতিবাদের ভাষা এবং এর ব্যাপকতা ক্রমেই বাড়তে থাকে। পাকিস্তানি সরকার সকল প্রতিবাদকে পাশবিক শক্তি দ্বারা দমনের চেষ্টা চালায়। তাদের একপেশে সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামে অবতীর্ণ হয় এদেশের মানুষ। এদেশের দামাল ছেলেরা মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বজ্রকঠিন শপথ গ্রহণ করে। পূর্ববাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন। আন্দোলনের পুরোভাগে এসে দাঁড়ায় এদেশের ছাত্র ও যুবসমাজ

আন্দোলনে-সংগ্রামে বাংলা ভাষা : একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রতিবাদ সভা এবং মিছিল হবে তা আগেই ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করার জন্যে সরকার ২১ ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা আইন জারি করে। ২০ ফেব্রুয়ারি রাত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্ররা গোপন বৈঠক করে এবং সিদ্ধান্ত নেয়, যেমন করেই হোক তারা ১৪৪ ধারা লঙ্ঘন করবেই। সে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একুশে ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আহূত হয় ছাত্রদের প্রতিবাদ সভা। সভা শেষে তারা মিছিল বের করে। সেদিন ছাত্রসমাজের প্রতিবাদী কণ্ঠে ধ্বনিত হয় স্বাধিকারের দাবি। প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন বসেছিল সে সময়। ভাষার দাবিতে সোচ্চার মিছিলটি এগিয়ে যায় প্রাদেশিক ভবনের দিকে। মিছিলকে ছাত্রভা করার জন্যে পুলিশ গুলি চালায়। পুলিশের বেপরোয়া গুলিবর্ষণের ফলে রাজপথে লুটিয়ে পড়ে সালাম, রফিক, জব্বার, সফিউর প্রমুখ দামাল ছেলেরা। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে তারা লিখে যায় এক অনন্য ইতিহাস। তাঁদের নিঃসৃত রক্তে সেদিন লেখা হয়ে যায় পূর্ববাংলার অমোঘ ভাগ্যলিপি। তাঁদের এ মহান আত্মত্যাগের ফলেই বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষার সম্মান লাভ করে। বাঙালির স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে থাকে সেই দিন, সেই রাজপথ, সেই ফুলার রোড।

‘‘ এই পথ, পীচ ঢালা এ কাল পথ
লিখে দিল এক ইতিহাস 

বুকের রক্ত দিয়ে জীবনের শেষ ক্ষণে
গেয়ে গেল তারা এ গান
আমার মুখের ভাষা, আমার সে প্রাণ।’’

একুশের প্রভাব : একুশের চেতনা আমাদের সাহিত্যাঙ্গনেও ফেলেছে সুদূরপ্রসারী প্রভাব। একুশের অনবদ্য দলিল হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলন। প্রতি বছর একুশ উপলক্ষে প্রকাশিত হয় অসংখ্য কবিতা। একুশ উপলক্ষে আয়োজন করা হয় ‘জাতীয় কবিতা উৎসব’। একুশের প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ জাতীয় বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় একুশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একুশের সাংস্কৃতিক চেতনার আর একটি অসামান্য ফসল ১৯৫৫ সালে বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠা। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চা, গবেষণা ও বিকাশে আমাদের জাতীয় জীবনে এ প্রতিষ্ঠানের অবদান অসামান্য।

বাঙলা সংস্কৃতি ও একুশের চেতনা : উন্নত সংস্কৃতিই একটি জাতির পরিপূর্ণ পরিচয়। কোন জাতিসত্তাকে সত্য-স্বরূপে আবিষ্কার করতে হলে পরিচয় গ্রহণ করতে হবে সে জাতির সংস্কৃতির সাথে। জাতির সংস্কৃতি আবার একদিনে গড়ে ওঠে না। দীর্ঘকালের ভৌগোলিক ভাঙাগড়া, আবহাওয়া, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, রাজনৈতিক ও সামাজিক অগ্রযাত্রা ইত্যাদির মধ্য দিয়েই সংস্কৃতি স্তরীভূত হয়ে স্ফটিক স্বচ্ছ রূপ পায়। আমাদের সংস্কৃতি বলতে আমরা যে ব-দ্বীপ অঞ্চলে বাস করি সেই ভূ-ভাগের অধিবাসীদের জীবনবোধ, জীবনাচরণ, আবেগ-অনুভূতির মধ্য দিয়ে অভিব্যক্ত ও প্রকাশিত সংস্কৃতিকেই বোঝায়। অন্য কথায়, বাঙালি সংস্কৃতিই আমাদের সংস্কৃতি। পহেলা বৈশাখ, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, আমাদের পল্লীসাহিত্যের বিভিন্ন উপাদান, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ— এ সবই আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গীভূত। আমাদের সংস্কৃতি-অন্বেষায় একুশের চেতনা সন্দীপ্ত মশালের মতো আমাদেরকে নিজ বাসভূমে প্রত্যাবর্তনের পথ দেখিয়েছে। ‘৪৭-এর রাজনৈতিক মানচিত্রের পরিবর্তনের ফলে আমরা নিজেদের প্রকৃত আত্মপরিচয় থেকে দূরে সরে গিয়েছিলাম। এ পর্বের শিল্প-সাহিত্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, সামাজিক আনন্দ-বিনোদনের ক্ষেত্রে আমরা হয়ে উঠেছিলাম অনুকরণপ্রিয়, অন্যের দ্বারা প্রভাবিত।

পঞ্চাশ দশকের শেষার্ধ থেকেই আমরা নতুন করে নিজেদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে সচেষ্ট হয়েছি। ‘কাগমারী সম্মেলন’ এ চেতনারই ফসল। অতঃপর ‘ছায়ানট’, ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’র মত সমাজ সংগঠনের জন্ম হয়েছে।

ভাষা, সংগীত ও সাহিত্য কোন বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। জাতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে এসব গভীরভাবে সংযুক্ত। সব ভাষারই আবার কিছু মৌলিক লেখক, কবি, শিল্পী থাকেন যাঁরা জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরই ধারক ও বাহক। রেডিও-টেলিভিশনে সরকার কর্তৃক রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ হলে এবং খণ্ডিত বুদ্ধির কিছু ভাবুক ‘রবীন্দ্রনাথ আমাদের ঐতিহ্য নয়’ বললেও আমরা রবীন্দ্রনাথকে ত্যাগ করিনি। রবীন্দ্র-প্রেম আমাদের মাতৃভাষা এবং নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি লালিত ভালোবাসারই অন্য প্রকাশ। একথা ঠিক যে, মায়ের মতো দেশ ও নিজস্ব সংস্কৃতি অবিভাজ্য। কোন অবস্থাতেই তা ত্যাগ করা যায় না।

উপসংহার : বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এবং এরপরেও আমরা বেশ কিছুকাল অতিক্রম করে এসেছি। একুশের চেতনা কিন্তু এরই মধ্যে মরে যায়নি। এখনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী, সে মূল্যবোধকে আমরা ছায়ার মতোই বহন করছি। এদেশীয় ইতিহাসে ব্যক্তি পূজা প্রাধান্য পেয়েছে। ফলে অনেকক্ষেত্রেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধও নিজস্ব সাংস্কৃতিক চেতনার অনুপস্থিতি প্রবলভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর থেমে যায়নি। এক অর্থে একুশের চেতনা আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এ বোধ কখনই বিসর্জিত হবে না। কালের পালাবদলের সঙ্গে তা ভিন্নরূপে আমাদেরকে নির্মাণ করবে, আমাদের সমাজ-সংস্কৃতিকে নব আঙ্গিকে প্রতিষ্ঠা দেবে।