[ রচনা সংকেত : ভূমিকা, একটি চাঁদনি রাতের বর্ণনা, নিজস্ব অনুভূতি, উপসংহার। ]
ভূমিকা : বাংলার প্রকৃতি বড় মধুর। ঋতুতে ঋতুতে বৈচিত্র্যের ডালি সাজিয়ে প্রকৃতি প্রকাশ পায় নব নব রূপে। এখানের শিশুর আকাশে সূর্য আলো ঢালে উষ্ণ আমেজে, চাঁদ জ্যোৎস্না বিলায় মধুর স্নিগ্ধতায়। চাঁদের মধুর হাসি হৃদয় কেড়ে নেয়, চোখে সরল আনন্দের জাগরণ আনে। সব ঋতুতে জ্যোৎস্না ঝরা রাত একরকম নয়। শরতে হেমন্তে জ্যোৎস্না বিধৌত শান্ত স্নিগ্ধ রজনী মোলায়েম বোধের জন্ম দেয়। হৃদয় এক অনাবিল শেফালির গন্ধে মৌ মৌ করে। শীতের জ্যোৎস্না কুয়াশা মলিন। সেখানে পাণ্ডুর চাঁদ বিবর্ণ ছায়া ফেলে, প্রকৃতির বুক নীরস ধূসরতায় আচ্ছন্ন হয়। বসন্তে জাগে নতুন আবাহনী । কে দখিনা মলয়ে পুষ্পকলিরা খেলা করে, বাতাসে জাগে মদির গন্ধ, প্রকৃতির বুক ভরে চাঁদের আলো রাতের মহিমাকে করে দীপ্ত। মনের চোখ খুলে দিয়ে ষড়ঋতুর জ্যোৎস্নাঝরা রাতের বৈচিত্র্য অনুভব করা সহজ। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার পুষ্পিত রূপ একেবারে ভেসে ওঠে দুনয়নে। সামগ্রিক বর্ণনায় না গিয়ে কোন এক শরৎ রাতের জ্যোৎস্না স্নিগ্ধ রজনীর গভীর প্রশান্ত রূপের বর্ণনাই তুলে ধরতে চেষ্টা করব।
একটি চাঁদনি রাতের বর্ণনা : ছোট নদী। বর্ষার প্রতাপ আর নেই। কুলকুল রবে তা বয়ে চলেছে এখনো তা শীর্ণ হয়নি। নদীর তীরে গাছের ছায়ায় মনোরম পরিবেশ। শরতের মাঝামাঝি। আকাশে চাঁদ ওঠেছে। অজস্র জ্যোৎস্নার জোয়ারে প্রকৃতি উচ্ছল। রাতের বুকে স্তব্ধতা। দূরে কোথায় মন্দিরে আরতির ক্ষীণ রেশ ক্ষণে ক্ষণে শুভ্র জ্যোৎস্নার বুকে ঢেউ তুলছে। আমি একা বসে আছি নদীর কূলে। জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়েছে নদীর জলে, কাশ বনে, শেফালী বনে, গোল চাঁদ আকাশে, হালকা মেঘেরা পাল তুলে ভেসে যাচ্ছে চাঁদের আলোর লুকোচুরি খেলা মনের মাঝে কি এক অভাবিত আমেজ জাগিয়ে তুলেছে। দূরে ওপারের গ্রামের শ্যামল গাছগুলি জ্যোৎস্না-সমুদ্রে ভাসমান, সবুজ সৌন্দর্যে ঝলকিত। নদীর বুকে চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ে আল্পনা আঁকছে। ভেসে পড়ছে ঢেউ ২ ঢেউ। এক চাঁদ শত চাঁদ হয়ে দোল খাচ্ছে। আমার পাশে কেউ নেই। স্নিগ্ধ বাতাস বইছে। শিশিরের শব্দ পাওয়া যায় কান পাতলে। জ্যোৎস্না রাত জেগে আছে কি এক মধুর মূরতি নিয়ে। অবাক বিস্ময়ে চেয়ে আমি দেখি সে মূরতি। এমনি রাতে কবি গুরুকেই মনে পড়ে ー
“চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙ্গেছে উছলে পড়ে আলো।
ও রজনীগন্ধা, তোমার গন্ধসুধা ঢালো ॥
পাগল হাওয়া বুঝতে নারে ডাক পড়েছে কোথায় তারে
ফুলের বনে যার পাশে যায় তারেই লাগে ভালো।”
ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, অথচ অন্তর অনুভব মধুর ছোঁয়া হৃদয়কে করে তুলেছে পুলকিত। পিছন ফিরে তাকালে দেখা যায় মাঠে শস্যনত। শ্যামল সুন্দর। ধানের নত পল্লব শিশির স্নাত। চিকচিক করছে জ্যোৎস্নার পুলক পরশে। শোভাময়ী সে রাত আমার দু’চোখে মোহন স্বপ্নের অঞ্জন পরিয়ে দিয়েছে। আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে চেয়ে আছি, পুলক শিহরণে ক্ষণে ক্ষণে রোমাঞ্চিত হচ্ছি। এত রূপ, এত বৈচিত্র্য, এমন গম্ভীর মূরতি, স্নিগ্ধ সজল সুহাসিনী রাত আর কখনো আমি প্রত্যক্ষ করিনি। আমি ডুবে আছি একরাশ জ্যোৎস্নার জলে ।
বিভিন্ন জনের দৃষ্টিতে চাঁদনি রাত : চাঁদনি রাতকে নিয়ে কবি সাহিত্যিকদের উৎসাহের শেষ নেই। কবিরা নানা উপমার মাধ্যমে চাঁদনি রাতকে কবিতা রচনা করেন। তাছাড়া গান, গল্প, উপন্যাসেও চাঁদনি রাতের আবেদন কম নয়। কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী সত্তা চাঁদের জোছনায় রোমান্টিকতার রূপ লাভ করে। শিল্পী তাঁর তুলির আঁচড়ে চাঁদনি রাতকে ধরে রেখেছেন বইয়ের পাতায়। চাঁদনি রাত কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পীর চোখে নতুন মাত্রা দান করে। তাঁরা চাঁদনি রাতের অপরার শোভায় মশগুল হয়ে স্ব স্ব ক্ষেত্রে নতুন সৃষ্টি দান করেন। ইংরেজ কবি জন কীটস চাঁদনি রাতের সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়েছিলেন কবিতায় তাঁর কামনা ছিল এমন ー
“তোমার পদে এই মিনতি করি দয়াময়
আমার মরণ চাঁদনি প্রহর রাইতে যেন হয়।”
গ্রাম ও শহর জীবনে চাঁদনি রাত : গ্রাম ও শহর জীবনে চাঁদনি রাতের উপলব্দিতে পার্থক্য দেখা যায়। শহর যান্ত্রিক সভ্যতার ধারাবাহি। শহরে রয়েছে বৈদ্যুতিক আলোর ঝলকানি। শহরের অধিকাংশ মানুষই বুঝতে পারে না যে, কখন চাঁদ ওঠে আবার কখন ডুবে যায়। একারণেই শহর জীবনে চাঁদনি রাতের সৌন্দর্য মূর্ত হয়ে ওঠে না। শহরের মানুষ চাঁদনি রাতের কোমল স্নিগ্ধ রূপকে উপলব্ধি করতে পারে না। অন্যদিকে গ্রামীন জীবনে পূর্ণিমার চাঁদের স্নিগ্ধ জোছনা মানুসের কাছে অপার সৌন্দার্য্যের আধার হিসেবে ধরা দেয়। গ্রামে বৈদ্যুতিক আলোর ঝলকানি নেই। সন্ধার পর নেমে আসে দিগন্ত জোড়া গাঢ় অন্ধকার। আর এর মাঝে চাঁদনি রাতের স্নিগ্ধ সুষমা মানুষের মনকে উদ্বেলিত করে তোলে। চাঁদনি রাতে নানি দাদিরা নাতি নাতনি নিয়ে উঠানে মাদুর পেতে বসে গভীর রাত পর্যন্ত গল্প বলে। ছোট ছেলেমেয়েরা গল্প শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে তারা বুঝতে পারে না।
চাঁদনি রাতের প্রকৃতি : চাঁদনি রাতে সমস্ত প্রকৃতি অপরূপ শোভা মন্ডিত হয়ে উঠে। সূর্য অস্ত যাওয়ার পর প্রকৃতিতে চাঁদনি রাতের অস্তিত্ব অনুভূত হয়। আলো আধারের মিলনই হচ্ছে, চাঁদনি রাতের মূল বৈশিষ্ট্য। কেননা চাঁদনি রাতের যে আলো তা পূর্ণ আলো নয়। যা শুধু মাত্র প্রকৃতিকে নিকট কালো অন্ধকার থেকে বাচিয়ে দেয়। চাঁদনি রাতে খুব বেশি দূর পর্যন্ত প্রকৃতিকে দেখা যায় না। তবে যে টুকু দৃষ্টির সীমায় আসে তা ধরা দেয় অপরূপ মহিমায়। চাঁদনি রাতের প্রকৃতি মানুষের মনকে উদ্বেলিত করে পুলতিক করে। বিরহ কাতর মনকে আরও বেদনা বিধুর করে তোলে। আবার কাউকে কাউকে মিলনের সুখ স্বর্গে বাসিয়ে দিতেও চাঁদনি রাতের তুলনা মেলা ভার। চাঁদনি রাতের প্রকৃতিতে একা জেগে থেকে প্রিয়ার কথা মনে করতে অসাধারণ সুখ অনুভূত হয়, চাঁদনি রাতে নদীর তীরে ঘুরে বেড়াতে খুবই ভাল লাগে। দূরের কাশবনকে ঘোমটা পড়া নব বধুবলে ভ্রম হয় ।
নিজস্ব অনুভূতি : আলোকময় সে রাত দিগন্তের শুভ্র রেখায় কি এক মোহময় আল্পনা এঁকে দিল। আমার অস্তিত্বে, অনুভবে আর কোনো অনুভূতি নেই। শুধু পবিত্র এক পরিবেশ শুভ্রতার চাদর গায়ে দিয়ে সজাগ জীবনবোধে হৃদয়ের গভীরে নাড়া দিয়ে গেল। আমার কোনো মালিন্য নেই, অহেতুক আতিশয্য নেই। সাংসারিক দুশ্চিন্তা নেই, কর্মের তাড়া নেই, জাগ্রত সে রাত আমাকে অনাবিল অনিন্দ্য ভুবনের মহিমাদীপ্ত জ্যোৎস্না স্নিগ্ধ প্রকৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। শরৎ রাতের জ্যোৎস্না পড়েছে মাঠের বুকে, নদীর জলে, কাশবনে, গাছের মাথায়। দূরে আকাশ মহলে তারার মেলা। সমগ্র প্রকৃতি আকাশ, মাটি, জল, বনানী, জুড়ে চাঁদের আলো লুটোপুটি খাচ্ছে। আমি বিজীন নদী তীরে জ্যোৎস্না বিধৌত প্রকৃতিতে দুচোখ রেখে মুগ্ধ বিস্ময়ে আত্মবিমোহিত। স্তব্ধতা ধীর লয়ে আমার চারপাশ জুড়ে নিবিড় শান্তি নিয়ে নেমে এল। দূরে নদীর চরে ডাহুক ডাকছে, এপারে ডাহুকী ব্যথার রাগিনী জাগিয়ে তুলেছে বিরহী হৃদয়ের আকুল কান্নায়। আমার তনুমন সমর্পিত প্রকৃতির মনোহর রূপ মাধুর্যের লাস্যময় স্নিগ্ধ সৌন্দর্যের গভীরে। জ্যোৎস্না রাতে একা জেগে আছি হৃদয়ে না পাওয়ার বেদনা, কণ্ঠে বিরহী সুরের অনুরণন। চকোর-চকোরির বিরহকাতর কান্নার রেশ আমার চিত্তের আনন্দকে ম্লান করে দিল বৈকি। চাঁদনি রাতের বুক ভরে বিরহী পাখির করুণ সুর আমার মগ্ন চৈতন্যে সহসা বেদনার ছোঁয়া দিয়ে গেল ।
উপসংহার : প্রকৃতি মানব মনে বিশেষ প্রভাব ফেলে। শত কর্মে ব্যাপৃত মানুষ যখন প্রকৃতির শোভা-স্নিগ্ধতায় অবসর মুহূর্তকে অন্তরে ধারণ করে তখন এক অনাবিল আনন্দে মন ভরে ওঠে। বিশেষ করে চাঁদনী রাতে মানুষ এক অপার্থিব আনন্দ উপভোগ করতে সক্ষম হয়।
Leave a comment