ইতিহাস পাঠের প্রয়োজনীয়তা

[সংকেত : ভূমিকা; ইতিহাস; ইতিহাসের পরিধি; ইতিহাস পাঠের আবশ্যকতা; বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস রচনার পদ্ধতি; উপসংহার ।]

ভূমিকা : ‘ইতিহাস’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো অতীত কথা, প্রাচীন কাহিনি কিংবা পূর্ব-বৃত্তান্ত। অর্থাৎ ইতিহাসে অতীতের বিষয়বস্তুই নিহিত থাকে। কিন্তু এ অতীতের রেশ বর্তমান কিংবা ভবিষ্যতেও প্রভাব বিস্তার করে। সুতরাং ইতিহাসের মৌল কাজ হলো অতীতের সঙ্গে বর্তমানের সেতুবন্ধন গড়ে তোলা; যেখান থেকে ভবিষ্যতের দিক-নির্দেশনা গ্রহণ করা যেতে পারে। তাই ইতিহাসে অতীতের বিষয়ের পুনরাবৃত্তি নয় বরং ইতিহাস প্রবহমান নদীর মতো এগিয়ে চলে। ইতিহাস পৃথিবীর সমস্ত বিষয়কে সঙ্গীকরণের ক্ষমতা রাখে । তাই মানব-জাতির ইতিহাসে যেমন মানুষের আবির্ভাব, ক্রমবিকাশ, সভ্যতা-শিক্ষা-সংস্কৃতি, নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি বিষয় থাকে তেমনি দেশ-জাতি কিংবা কোনো ভাষার ইতিহাসেও নানাবিধ বিষয়ের অনুপুঙ্খ চিত্র ধরা পড়ে। সুতরাং নিজেকে জানার প্রয়োজনে, বিশ্বকে চেনার প্রয়োজনে কিংবা সর্বমানবের সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশাসহ বস্তুনিষ্ঠ উপলব্ধির জগৎ তৈরিতে ইতিহাসের ভূমিকা অনবদ্য।

ইতিহাস : ইতিহাসের সংজ্ঞার্থ নির্ণয় করা কষ্টকর বটে। কেননা বস্তুনিষ্ঠ সংজ্ঞার্থ প্রদানে অনেক ঐতিহাসিক এবং গবেষকদের মধ্যে মত-বিরোধ থাকাই স্বাভাবিক। তদুপরি কয়েকজন মনীষীর বক্তব্য এ প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য। ইতিহাসের জনক বলে খ্যাত হেরোডোটাস বলেন, ‘ইতিহাস হলো যা সত্যিকার অর্থে ছিল বা সংঘটিত হয়েছিল তা অনুসন্ধান করা ও লেখা। এক্ষেত্রে ড. জনসনের মতে, ‘যা কিছু ঘটে তাই ইতিহাস।’ র‍্যাপসনের মতে, ‘ইতিহাস হলো ঘটনার বৈজ্ঞানিক এবং ধারাবাহিক বিবরণ।’ প্ৰখ্যাত গবেষক মেইট্যলান্ড উল্লেখ করেছেন— ‘What men have done and said, and above all, what they have thought that is history.’ উপর্যুক্ত বক্তব্যগুলো থেকে স্পষ্টত বোঝা যায়, ইতিহাসে মানুষ তথা বিশ্বের প্রায় সকল বিষয়াদি থাকতে পারে। সুতরাং ইতিহাসের ব্যাপ্তি নিঃসন্দেহে অনেক বড়ো। ইতিহাস সম্বন্ধে সংকীর্ণ ধারণা থেকেই সাধারণভাবে মনে করা হয়, কোনো রাজা- বাদশাহ, সম্রাট-সুলতান, জমিদার ইত্যাদি অতীত বিষয়ের নানা কাহিনি। কিন্তু ইতিহাস শুধু অতীতের চর্বিত-চর্বণে থেমে থাকে না; বরং ইতিহাস সত্যানুসন্ধানে গভীর প্রত্যয়ে ঘটমান বর্তমানকে বিশ্লেষণে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার সিঁড়ি নির্মাণের ভূমিকা পালন করে। সুতরাং ইতিহাস হলো— অতীতের যেকোনো ঘটনার বস্তুনিষ্ঠার চিত্র— যা বর্তমানকে পর্যবেক্ষণ করে ভবিষ্যতের কর্মপন্থা নির্ধারণে একান্ত সহায়ক শক্তি হিসেবে বিবেচিত। তাই ইতিহাসের মধ্যে অসংখ্য বিষয়ের অবতারণা হওয়াই স্বাভাবিক। 

ইতিহাসের পরিধি : ইতিহাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো মানুষের ইতিহাস। মানুষ কীভাবে বন্ধুর পথ অতিক্রম করে আজকের এ সভ্যতায় পৌঁছল তা জানার কৌতূহল ইতিহাসই নিবৃত্ত করতে পারে। এ প্রসঙ্গে পণ্ডিত নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস (আদিপর্ব)’-এর প্রথম অধ্যায়ে তাঁর মতটি প্রণিধানযোগ্য : ‘রাষ্ট্র, সমাজ, ধর্ম, শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, আর্থিক বিন্যাস সমস্ত কিছুই গড়িয়া তোলে মানুষ; এই মানুষের ইতিহাসই যথার্থ ইতিহাস।’ আর ইতিহাসের পরিধির মধ্যে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো প্রাধান্য রাখে—

১. মানব সমাজ ও প্রতিকূলতা : পৃথিবীতে মানব-জাতির উদ্ভব, সমাজ, সভ্যতায় পদার্পণসহ নানাবিধ প্রতিকূলতার বিবরণ ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু হিসেবে বিবেচিত।

২.আর্থনীতিক বিষয়াদি : মানব-সভ্যতায় অর্থের ভূমিকা অপরিহার্য। সুস্থ-সুন্দর জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে তাই মানুষকে অর্থ উপার্জন করতে হয়। এছাড়াও জীবিকার প্রয়োজনে খাদ্য উৎপাদন করতে হয়। আবার এসব উৎপাদনের সঙ্গে ব্যবসা- বাণিজ্যসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়ও মানুষের জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। তাই কোনো দেশ বা জাতির ইতিহাসে আর্থনীতিক বিষয়াদি এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে থাকে।

৩. রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কর্মকাণ্ড : একটি রাষ্ট্রের সুষ্ঠু পরিচালনার ক্ষেত্রে রাজনীতিক এবং সামাজিক ব্যবস্থার যথাযথ সমন্বয় থাকা বাঞ্ছনীয়। এজন্য রাজনীতিক চিন্তা-ভাবনা, কর্ম-পরিকল্পনা কতটুকু সমাজ-মানসে প্রতিফলিত তার সঠিক মূল্যায়ন রাষ্ট্রকে করতে হয়। সুতরাং রাষ্ট্র, সমাজ, জনগণ, প্রশাসন ও রাজনীতি ইতিহাসের উপজীব্য হতে পারে।

৪. শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিষয়াদি : জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা মানব-সভ্যতা বিকাশে যেমন একান্ত প্রয়োজন তেমনি মনুষ্যজীবনকে সুন্দর করে, মহৎ করে ও বিচিত্র করে তোলাও প্রয়োজন । বস্তুত শিক্ষা-দীক্ষা আর সংস্কৃতি চর্চার মধ্য দিয়ে মানবজীবনে এগুলো অর্জন .. করা যায়। সুতরাং শিক্ষা-সংস্কৃতি ইতিহাসের অন্যতম বিষয় হিসেবে গৃহীত।

ইতিহাস পাঠের আবশ্যকতা : মানুষের জানার আকাঙ্ক্ষা চিরন্তন ও দুর্নিবার। তবে এ চেনা ও জানার কৌতূহল মৃত্যু অবধি মূর্তিমান জিজ্ঞাসার চিহ্ন হয়ে থেকে যায়। সৃষ্টির আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত মানুষ জানতে চায়— তাই অসীম মহাকাশে বা অতল সমুদ্রেও মানুষ অনুসন্ধান চালায়। বস্তুত এ বিশাল পৃথিবীর কতটুকু মানুষ উপলব্ধি করতে পারে? তারপরেও পৃথিবীর পথে মানুষের এই নিরন্তর পথ-চলা । আর এক্ষেত্রে ইতিহাস মানুষকে তার অনুসন্ধিৎসার অনেকখানিই পূরণ করে দিতে পারে। কারণ ‘চণ্ডীপাঠ থেকে জুতা সেলাই পর্যন্ত’ গত এবং সমাগত সকল ঘটনাই ইতিহাসের পাতায় ভাস্বর হয়ে থাকে। সুতরাং মানবের জ্ঞান ও চেতনার জগতকে সমৃদ্ধ করতে ইতিহাস পাঠের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। নিম্নোক্ত কতিপয় বিষয় ইতিহাস পাঠের আবশ্যকতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয় :

১. মানবসভ্যতা : আদিম গুহাবাসী মানুষ কীভাবে সভ্যতার স্বর্ণ-শিখরে পৌঁছল— সচেতন মানুষ মাত্রই ইতিহাসের এই দুর্গম অধ্যায়টি জানতে চায়। মানুষ তাই সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারা থেকেও নিজেকে চিনতে, জানতে ও শিক্ষা গ্রহণ করতে আগ্রহী। সুতরাং এক্ষেত্রে মানুষকে ইতিহাসের দ্বারস্থ হতে হয়।

২.সমাজ-ব্যবস্থা : পৃথিবীতে প্রথম সমাজ কীভাবে সৃষ্টি হলো, আর কোন প্রয়োজনে সৃষ্টি হলো— এর ইতিবৃত্ত জানার আগ্রহ সকলের রয়েছে এবং কীভাবে কোন কোন পর্যায় পেরিয়ে আজকের সমাজ-ব্যবস্থা এরূপ ধারণ করেc এমনকি ভবিষ্যতে সমাজ- ব্যবস্থার রূপ কী হবে এ প্রয়োজনেও ইতিহাস পাঠ অত্যাবশ্যক। 

৩. জাতীয় পরিচয় : যেকোনো জাতির আত্ম-পরিচয় নিহিত থাকে সেই জাতির ইতিহাস আর ঐতিহ্যের মধ্যে । আর এই পরিচয় থেকেই মানুষ উদ্বুদ্ধ হয় তার সমাজ ও দেশ উন্নয়নে তথা দেশপ্রেমে। সুতরাং জাতীয় পরিচয়ের প্রয়োজনে ইতিহাসের পাঠ দরকার।

৪. জ্ঞানার্জন : জ্ঞানশক্তির জন্যই মানুষ পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত। এই জ্ঞানার্জনের নানাবিধ পথের মধ্যে ইতিহাস অন্যতম। সুতরাং যেকোনো বিষয়ের ইতিহাস পাঠের মধ্য দিয়ে সেই বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞানার্জনের অপার সুযোগ পাওয়া সম্ভব। 

৫. পরিকল্পনা প্রণয়ন : যেকোনো পরিকল্পনা প্রণয়নে এবং তা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ইতিহাস পাঠ অত্যন্ত জরুরি। 

৬. সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ : একটি জাতির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মধ্যে নিহিত থাকে সেই জাতির মৌল সত্তা। আর তাই যেকোনো জাতির উচিত ইতিহাসের মধ্য দিয়ে সেই বিষয়টিকে বাঁচিয়ে রাখা। যেকোনো জাতি-গোষ্ঠী বা গোত্রকে ভালোভাবে জানতে হলে ইতিহাস পাঠের বিকল্প কিছু নেই।

বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস রচনার পদ্ধতি : যেহেতু ইতিহাসের পাতায় কোনো দেশ কিংবা জাতির সমস্ত তথ্য-উপাত্ত অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের কথা থাকে, তাই ইতিহাস প্রণয়নে সংশ্লিষ্ট সকলকে যোগ্যতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে সেই দায়িত্ব পালন করতে হবে। এক্ষেত্রে ঐতিহাসিকদের নিরপেক্ষ এবং নির্মোহ বিশ্লেষণে ইতিহাস রচনা করতে হবে। আমরা উদাহরণ হিসেবে দেখতে পাই, ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে বিদেশিদের দ্বারা রচিত ইতিহাস অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের স্বার্থে রচিত হয়েছিল। আমাদের গৌরবের ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে নানা কুচক্রীমহল দ্বারা আজও নানাভাবে বিতর্কিত করার চেষ্টা চলছে। এক্ষেত্রে আমাদের সজাগ থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। অন্যদিকে, মুক্তিযুদ্ধের সম্মানজনক অধ্যায় নিয়ে ইতিহাসের বৃহৎ কলেবরে কাজ আজও হয়নি; সুতরাং জাতি হিসেবে শুধু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নয়; বরং অন্যান্য ইতিহাসের বিষয়বস্তুকে চুল-চেরা বিশ্লেষণ করে ইতিহাস প্রণয়ন করতে হবে।

উপসংহার : ইতিহাস পাঠ সকলের জন্য প্রয়োজন। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, শিক্ষা, সভ্যতাকে উপলব্ধি করতে হলে ইতিহাস পাঠ করা দরকার। কেননা ইতিহাস শুধু তথ্যমাত্র নয়, বরং দেশ-কাল-স্থান নির্বিশেষে নর-নারীর জীবনের গতি-প্রকৃতিসহ উত্থান-পতনের ধারাস্রোতে ইতিহাসের যে ইঙ্গিত থাকে তা অনুধাবন বিশেষ প্রয়োজন। সুতরাং ইতিহাস পাঠের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।