বাংলা রচনা : আমার শৈশবমূতি 

আমার শৈশবমূতি 

‘ দিনগুলি মাের সােনার খাঁচায় রইল না

সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি। ‘ 

জীবন যে এত মধুর, পৃথিবী যে এত সুন্দর তা একমাত্র শৈশবের চোখ দিয়ে না দেখলে বােঝা যায় না। জীবনে যা কিছু সুন্দর, সুখকর, তা আমি দেখেছি শৈশবের জানালায় উঁকি দিয়ে। মুগ্ধ হওয়ার এক সহজাত প্রবৃত্তি নিয়ে আমি জন্মেছি বলেই হয়তাে যা-কিছু দেখতাম, তাতেই ছিল বিস্ময়। জোনাক-জ্বলা রাত্রি, বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ, নারকেলের চিরল পাতায় বাতাসের ঝিরিঝিরি, রূপকথার গল্পের সেই সুয়ােরানী-দুয়ােরানী, পাতালপুরীর রাজকন্যার দুঃখ সবই শৈশবের স্মৃতির পাতায় রঙিন হয়ে আছে। জীবন এগিয়ে চলছে, আমি বড় হচ্ছি, কিন্তু শৈশবের সেই ফেলে আসা দিনগুলাের কথা মনে হলে আমি থমকে দাঁড়াই। আমার হৃদয় ভেঙে কান্না আসে। আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না শৈশবের খেলার মাঠে ফেলে আসা রঙিন বেলুনের কথা। ঘুড়ি ওড়ানাে বিকেলবেলার স্মৃতি। 

আমার শৈশব-কৈশাের কেটেছে গ্রামে। বাবা চাকরিসূত্রে থাকতেন শহরে। বাড়িতে দাদি, চাচা, ফুফু ভাইবােন, আত্মীয়স্বজনের কলকাকলিতে মুখর ছিল আমাদের বাড়ি। আম, জাম, কাঁঠাল, নারকেল, সুপারি গাছে ছায়াসুনিবিড় ছিল গ্রামের বাড়িটি। আমি ছিলাম পরিবারের সকলের আদরের। বিশেষত, আমার দাদি আমাকে খুবই আদর করতেন। প্রতি রাতে তিনি আমাকে রূপকথার গল্প বলে ঘুম পাড়াতেন। আর সেই গল্পকে বাস্তব মনে করে আমি কল্পনায় পাখা মেলে ঘুমের মধ্যে হয়ে যেতাম দিগ্বিজয়ী রাজপুত্তর। পঙ্খিরাজের ঘােড়ায় চড়ে, কোমরে বাঁধা তলােয়ার নিয়ে স্বপ্নে আমি ছুটে চলছি সেই অপরূপ দেশে । আমার দাদি ছিলেন অত্যন্ত স্নেহপরায়ণ, মিষ্টিভাষী এবং আমার খুব প্রিয়। 

চার বছর বয়স পর্যন্ত আমার কিছুই মনে পড়ে না। পাঁচ বছর বয়সে আমাকে স্থানীয় স্কুলে ভর্তি করানাে হয়। মা আমাকে বর্ণমালা লেখা শেখাতেন। শহর থেকে আব্বা বাড়ি আসার সময় আমার জন্য আনতেন ছােট্ট উপহার। কলমের বাক্স, স্কুলের ব্যাগ, রঙিন পেন্সিল। সেইসব উপহার পেয়ে আমি যে কী খুশি হতাম! সেই আনন্দের কথা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। 

বাড়ির কাছেই ছিল আমাদের স্কুল। পাড়ার সমবয়সী আমরা একসঙ্গে স্কুলে যেতাম। বাড়ি থেকে স্কুল খুব দূরে ছিল না। হেঁটেই স্কুলে যেতে হতাে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীতে স্কুলে যাওয়ার পথটি বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠত। স্কুলের দীর্ঘ বারান্দায় ঝুলাননা পেতলের ঘণ্টায় বুড়াে দপ্তরিকাকা যখন ঘণ্টা বাজাতাে, সেই দৃশ্যটি ছিল দেখার মতাে। 

স্কুলের পাশ দিয়ে চলে গেছে রেললাইন। দুপুরবেলা তীব্র হুইসেল বাজিয়ে চলে যেত দুরন্ত ট্রেন। ট্রেনের জানালায় দেখা যেত কত উৎসুক অপরিচিত মুখ। ঝিঙ্কা ট্রেনের সেই শব্দ আজো আমার কানে বাজে। কখনাে বিকেলে আমরা রেললাইনে বেড়াতে যেতাম। রেললাইনের দুপাশে প্রচুর বরই গাছ। আমরা পাকা পাকা বরই পেড়ে খেতাম। বিকেলে স্কুলের মাঠে পাড়ার ছেলেরা ফুটবল খেলত। কখনাে মাঠের পাশে বসে ফুটবল খেলা উপভােগ করতাম। বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী’ উপন্যাসের দুর্গা, অপুর মতাে কাশবনে লুকোচুরি খেলতাম। খালের পানিতে ভেসে থাকা কচুরিপানার বেগুনি ফুলকে মনে হতাে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ফুল। ঝাড়বাতির মতাে এক-একটা ফুল আমাকে কী যে আকর্ষণ করত। কত তুচ্ছ, নগণ্য জিনিস আমার কাছে মহামূল্যবান মনে হতাে। 

মায়ের কাছ থেকে আবদার করে একটা টিনের বাক্স নিয়েছিলাম। তাতে পরম যত্নে লুকিয়ে রাখা আছে আমার নানা সংগ্রহ। আমাদের পুরােনাে রেডিও, বাবার পুরােনাে ঘড়ি, একটা সুন্দর পাইলট কলম, একটা রেকর্ডপ্লেয়ার। এখন আর এসবের চল নেই। কিন্তু বাক্স খুলে ওগুলাে বের করলেই পুরােনাে দিনের স্মৃতি ভেসে ওঠে। 

শৈশবকে আমি খেলার মাঠে গ্রামের বাড়িতে আর গ্রামের স্কুলঘরে ফেলে এসেছি। সেই স্বপ্নময়, সুখকর সৃতি, মধুর দিনগুলি মনের পাতায় বারবার অনুরণন তােলে। যতই বড় হচ্ছি ততই রূঢ় বাস্তবের মুখখামুখি হচ্ছি। ততই মনে হচ্ছে, আহ্ শৈশবে কত আনন্দেই না ছিলাম। কে আমায় ফিরিয়ে দেবে সেই দিনগুলি!