আমার প্রিয় সাহিত্যিক
অথবা, আমার প্রিয় গ্রন্থকার অথবা, তােমার প্রিয় লেখক
[ সংকেত : সূচনা; ঔপন্যাসিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ; প্রথম উপন্যাস; দ্বিতীয় উপন্যাস; তৃতীয় ও শেষ উপন্যাস; উপসংহার। ]
সূচনা : বাংলাদেশি উপন্যাসের প্রথম পর্বের লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ আমার প্রিয় সাহিত্যিক। তিনি সাহিত্যের গতানুগতিক ধারা অনুসরণ না করে একটি ব্যতিক্রমধর্মী স্বতন্ত্র ধারায় সাহিত্যচর্চা করেন, যেখানে তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে মানুষের জটিল অন্তঃপ্রকৃতির মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁরা প্রায়শ তাদের যুগের চেয়ে কিছুটা এগিয়ে থাকেন। চলমান বাঁধানাে সড়ক থেকে সরে গিয়ে তারা নিজেরাই একটা স্বতন্ত্র রাস্তা নির্মাণ করেন। আর এই ধারার একজন শ্রেষ্ঠ লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ আমার প্রিয় সাহিত্যিক।
ঔপন্যাসিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ : সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ একজন আধুনিক ঔপন্যাসিক। আধুনিক উপন্যাসের কলাকৌশল তাঁর আয়ত্তে। অস্তিত্ববাদী দর্শনে বিশ্বাসী, দৃষ্টিভঙ্গিতে আধুনিক, দর্শন চিন্তায় বিশ্বমনস্ক এই লেখক কাহিনির পরিবেশ সৃষ্টিতে একান্তভাবে দেশীয়। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ, চিরচেনা মানুষ ও সামাজিক পটভূমিতে উপন্যাস রচনা করে তিনি একদিকে যেমন উপন্যাস সাহিত্যে এনেছেন নব আঙ্গিক, তেমনি অন্যদিকে হলেন বাংলাদেশের সমাজ সত্যের রূপকার এবং জীবন শিল্পী। সমাজের সমস্যার মতােই ব্যক্তির ভেতর জগতের সমস্যাও উপেক্ষণীয় নয়। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সেই অন্তঃপুরের ছবি আঁকতে চেয়েছেন তাঁর উপন্যাসে। চেতনা প্রবাহের অনুসরণে তিনি ব্যক্তির অন্তর জীবনকে উদ্ঘাটিত করেন। উপন্যাস যেহেতু জীবনের শিল্পরূপ, সেহেতু কথাশিল্পী মানব জীবনের ও মানব মনের এই গভীরতম অংশকে শিল্পের উপজীব্য করে তুললেন। মানুষের মনােবিশ্লেষণের উৎসাহ থেকে সৃষ্ট এ ধরনের উপন্যাসকে চেতনাপ্রবাহ রীতির উপন্যাস বলা হয়। বলতে গেলে কথাসাহিত্যে এ ধরনের নিরীক্ষা সাম্প্রতিক কালের। এ ধরনের উপন্যাসে একজন মানুষকে, তার মন ও মানসকে খণ্ড খণ্ডভাবে বিশ্লেষণ করা হয়। বাংলা সাহিত্যে এ ধরনের উপন্যাস সৃষ্টি করা হয় ইংরেজি কথাসাহিত্যের অনুসরণে।
প্রথম উপন্যাস : সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘লালসালু’ লিখেই বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। বাংলাদেশের সাহিত্যে যেসব উপন্যাস প্রবল আলােড়ন সৃষ্টি করেছিল সেগুলাের মধ্যে লালসালু’ অন্যতম। গ্রামীণ জীবনের পটভূমিকায় রচিত এই উপন্যাসে তিনি ধর্মের নামে স্বার্থান্ধ মানুষের কার্যকলাপকে ফুটিয়ে তুলেছেন। গ্রাম-বাংলার বাস্তব চিত্র হিসেবে এই উপন্যাস অত্যন্ত মূল্যবান। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ বিষয়বস্তু নির্বাচনে এবং অভিনব আঙ্গিক প্রয়ােগে বিশিষ্টতা দেখিয়েছেন বলে অল্প গ্রন্থ রচনা করেও * বিশেষ খ্যাতির অধিকারী হয়েছিলেন। চাঁদের অমাবস্যা এবং কাদো নদী কাঁদো’ বিশেষ পরীক্ষা-নিরীক্ষাপূর্ণ দুটি উপন্যাস; এখানে। জীবন-চেতনার পাশাপাশি সমাজচিত্রও বিদ্যমান। দার্শনিক চেতনা সমৃদ্ধ উপন্যাস হিসেবে এগুলাে বিবেচ্য। ভাষার কারুকার্যে, দৃষ্টির তীক্ষ্ণতায়, আঙ্গিকের সুস্থ রূপায়ণে ও পটভূমিকার বৈচিত্র্যে লেখকের কৃতিত্ব অবিসংবাদিত।
লালসালু’তে ঔপন্যাসিক জীবন ও চরিত্রকে কার্য ও কারণের সঙ্গে মিলিয়ে চিত্রিত করেছেন। এ উপন্যাসে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে মজিদ নামের এক ধর্ম ব্যবসায়ীকে চিত্রিত করার জন্যে উপন্যাসটি রচিত। কিন্তু তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে লক্ষ করলে দেখা যাবে এ উপন্যাসে ব্যাপকভাবে জীবনকে চিত্রিত করা হয়েছে। মাজারের প্রতি দুর্বলতা এ সমাজের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার মধ্যে কম বেশি লক্ষ করা যায়। আর এ দুর্বলতার সুযোেগে ধর্ম ব্যবসায়ী স্বার্থান্বেষীরা তাদের ভাগ্য নির্মাণে সচেষ্ট হয়। এই সমাজে ধর্ম ব্যবসায়ীদের সাধারণ মানুষকে যথেচ্ছ প্রতারণা করার যথেষ্ট সুযােগ বিদ্যমান। এ মাটির শাসক-শােষক শ্রেণির ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। তাদের কাছে মানুষের দুর্বলতাই বড়াে পুজি। ‘লালসাল’র কাহিনিটি উপরে উপরে এমনি একটি ভূহকে শ কেন্দ্রিক গল্প হলেও ভেতরে ভেতরে গ্রামের বাঙালি মুসলমান সমাজ জীবনের আলেখ্য।
দ্বিতীয় উপন্যাস : লেখক তার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘চাদের অমাবস্যা’-এর মাধ্যমে নিজেকে সর্বাঙ্গীণ আধুনিক ঔপন্যাসিক রা করেছেন। উপন্যাসটি বিদেশে বসে রচিত হলেও এতে বাংলাদেশেরই নিসর্গ, সমাজ, মানুষ সুস্পষ্ট রেখায় চিত্রিত। জাবনদর্শন এতে প্রকাশিত। এখানে শিল্পী মনঃসমীক্ষণ করে ব্যক্তির বহির্দেশ থেকে অন্তর্দেশে ঢুকলেন। লালসালু তে এমার কুসংস্কারের যে প্রতিচ্ছবি দেখা যায়, চাদের অমাবস্যা কিছুটা হলেও তারই অপর পিঠ । বড়াে বাড়ির দাদা সাহেব যেন মাজদেরই একটু ভিন্ন উন্নত সংস্করণ। যুক্তিহীন ধর্মোন্মত্ততাকে এই উপন্যাসেও কশাঘাত করেছেন লেখক।
তৃতীয় ও শেষ উপন্যাস : সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ততীয় ও শেষ উপন্যাস ‘কাদো নদী কাঁদো’ চেতনা-প্রবাহ রীতির উপন্যাস। উপন্যাসটির কাহিনির প্রধান আশ্রয় মুহাম্মদ মুস্তফার জীবনালেখ্য, তার জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি। মুহাম্মদ মুস্তফার দুর্ভাগ্যের কাহিনি শােনাতে গিয়ে যে পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে তাতে হতভাগ্য মুহাম্মদ মুস্তফা এবং দুঃখিত ও নিরানন্দ কুমুর ডাঙার অধিবাসীরা দক্ষতার সঙ্গে চিত্রিত হয়েছে। এ উপন্যাসে লেখক চৈতন্যকে এবং জীবনের সমগ্রকে স্পর্শ করতে চেয়েছেন। অস্তিত্বের সমস্যা ও সম্ভাবনা, জীবনের ভেতর ও বাহির, পাপ-পুণ্য, প্রেম-ভালােবাসা, হিংসা-প্রতিহিংসা প্রভৃতি নানা মৌলিক বিষয় দার্শনিকের দূরদৃষ্টিতে এবং শিল্পীর নৈপুণ্যে উপস্থিত করেছেন কাঁদো নদী কাঁদো’তে। জীবনের বিপরীতে মৃত্যু, এই দার্শনিক প্রসঙ্গটি নানাভাবে নানাদিক থেকে উপন্যাসটিকে করেছে শ্রেষ্ঠ । তিনি আর দশজন সাহিত্যিকের মতাে জীবনের ঘটনাবলি বলে যাননি। গতানুগতিক উপন্যাসের মতাে এতে নেই নায়ক-নায়িকার ভিড়, নেই তেমন কোনাে কাহিনি; কিন্তু তা সত্ত্বেও এটি হয়ে উঠেছে দৈনন্দিন জীবনের এক বিচিত্র চালচিত্র; বাস্তব জীবনেরই প্রতিরূপ।
উপসংহার : সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ বিদেশি শিল্পের অনুকরণে বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে যেমন নতুন আঙ্গিক এনেছেন ঠিক তেমনি বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ, সমাজ, চিরচেনা মানুষ ও মানবজীবনকে রূপায়িত করেছেন সুনিপুণভাবে। আর তাই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ আমার প্রিয় সাহিত্যিক।
Leave a comment