আমার কলেজ জীবন
[সংকেত : ভূমিকা; কলেজে ভর্তির পূর্ব মুহূর্ত; প্রথম দিনের স্মৃতি; কলেজে অতিবাহিত দিনগুলাে; কলেজ জীবনের জ্যোতির্ময় প্রভাব; নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন; কলেজে সংস্কৃতি চর্চা; কলেজে খেলাধুলা; উল্লেখযােগ্য স্মরণীয় স্মৃতি; উপসংহার।]
ভূমিকা : দূর অতীতকে জীবন্ত করে বর্তমানকে ভুলিয়ে দিতে চায় স্মৃতি। গতিময় জীবনে সামনে ক্রমাগত এগিয়ে চলার সময় পেছনে ফিরে তাকাতে ভালাে লাগে। যদিও সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার সমন্বয়ে মানব-জীবন গঠিত, তবু তার মধ্য থেকে অতীতের সুখের স্মৃতিচারণ করতে মন-প্রাণ মধুরতায় ভরে ওঠে। স্মৃতিচারণের যে অধ্যায় আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় তা হলাে আমার কলেজ জীবন। বস্তুত ছাত্রজীবন মানব-জীবনের সবচেয়ে সুখময় অধ্যায় আর কলেজ জীবন হলাে ছাত্রজীবনের তারুণ্যে উজ্জ্বল অনন্য মধুরতম অংশ। কলেজ জীবনের স্মৃতি আমার জীবনের অনেকখানি জায়গা জুড়ে আছে। সে স্মৃতিচারণে আজো আমি মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ি । সে এক অনবদ্য নস্টালজিয়া! সেই জীবনের কথা ভাবলে আজো আমার হৃদয় প্রশান্তিতে ভরে ওঠে । তাই সব ভোলা যায়, কিন্তু আমার কলেজ জীবনের স্মৃতি ভোলা যায় না। সে বড়ো মধুর স্মৃতি জাগানিয়া চিরস্মরণীয়- অপূর্ব নিবিড় অনুভূতি।
কলেজে ভর্তির পূর্ব মুহূর্ত : প্রকৃতপক্ষে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার আগ পর্যন্ত কলেজ জীবন সম্পর্কে আমার কল্পনায় তেমন কিছু আসতো না। কিন্তু এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পরপরই আমি কলেজ জীবন সম্পর্কে নানা রকম ভাবনা ভাবতে শুরু করি। আমার কল্পনার ক্যানভাস জুড়ে ছড়াতে থাকে আকর্ষণ ও কৌতূহলের বিচিত্র রং। এক সময় কলেজ সম্পর্কে আমার আগ্রহ ও উত্তেজনা এতটাই বেড়ে গেল যে, কেবল মনে হতে লাগল কবে ফল বের হবে, আর আমি কবে কলেজে ভর্তি হবো! অতঃপর ফল বের হলো— আমি এ প্লাস (A’) পেয়ে উত্তীর্ণ হলাম এবং ঢাকা বোর্ডের অন্তর্ভুক্ত রামশীল কলেজে মানবিক বিভাগে ভর্তি হলাম। নবীনবরণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের বরণ করে নেওয়া হলো।
প্রথম দিনের স্মৃতি : অধীর অপেক্ষার পর এলো সেই শুভদিন ৪ জুলাই। আমার কলেজ জীবনের প্রথম দিন । বেলা দশটায় ক্লাস শুরু। দশটা বাজার ১৫ মিনিট আগেই ক্লাসে এসে উপস্থিত হই । দুজন পরিচিত ছাড়া আর সবাই নতুন মুখ। বিভিন্ন স্কুল থেকে তারা এসেছে। সবার চোখে-মুখে তারুণ্যের দীপ্তি ঝলমল করছিল। ঘণ্টা বাজল— প্রথম ক্লাসেই এলেন অধ্যক্ষ নিজে। ক্লাসটি ছিল বাংলা- কিন্তু বাংলা স্যার এলেন না। প্রথম ক্লাসে অধ্যক্ষ কলেজের নিয়ম-কানুনসহ আরও নানা বিষয়ে উপদেশমূলক বক্তব্য দিলেন। তারপর আমাদের হাজিরা গ্রহণ করে তিনি সামনে এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন এবং সমস্ত ক্লাসের দিকে একবার তাকালেন। অধ্যক্ষ মহোদয় সবার সাথে কুশল বিনিময় করে সকলের নিজ নিজ পরিচয় জেনে নিলেন। কলেজ জীবনে নিজেকে যথার্থভাবে মানিয়ে নেবার জন্য তিনি সকলকে সতর্কতার সাথে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। তিনি গভীর মনোযোগের সাথে সকলকে পড়াশোনায় আত্মনিয়োগ করতে বললেন। কারণ কলেজ জীবনের ভালো ফল উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য অপরাজেয় শক্তি হিসেবে কাজ করে। তিনি আরও বললেন, সুন্দরভাবে জীবন গঠন করাই শিক্ষার্থীদের প্রধান দায়িত্ব। অধ্যক্ষের বক্তব্য ছিল সংক্ষিপ্ত কিন্তু সুনির্দিষ্ট। তাঁর তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য আমার কাছে বাকি জীবনে চলার পথের একটি আলোকবর্তিকা বলে মনে হলো। তাঁর জাদুমাখা কণ্ঠের অমিয় বাণী আমি বিমুগ্ধ হয়ে আত্মস্থ করলাম।
কলেজে অতিবাহিত দিনগুলো : কলেজে প্রথম দিনের পর থেকেই রুটিন মাফিক ক্লাস এবং অন্যান্য সহায়ক কার্যক্রম শুরু হলো। প্রায় দুই বছর শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সাহচর্য লাভ করলাম। এ সময়ে অনেকেই বন্ধু হয়ে গেল। বন্ধুরা একসঙ্গে পড়ালেখাসহ অনেক আনন্দ ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান করেছি। অন্যদিকে, শিক্ষকদের আন্তরিকতাপূর্ণ পাঠদান ও স্নেহ আমাকে বিমুগ্ধ করেছে। তাঁদের দেখানো আলোর পথ ধরে আমি ক্রমেই মনুষ্যত্ববোধ জাগরণের লক্ষ্যে অগ্রসর হয়েছি। বস্তুত কলেজ জীবন অনেকটা সুবোধ বালকের মতোই কাটিয়েছি। যে কারণে কখনো কোনো শিক্ষকের বিরাগভাজন হতে হয়নি। তবে ক্লাসের মধ্যে কোনো বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে আমিই ছিলাম অগ্রগামী । আর বিষয়টিকে শিক্ষকগণ অত্যন্ত ইতিবাচক বলে উল্লেখ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে, অধিক জানার জন্য প্রশ্ন করার কোনো বিকল্প নেই। ফলে কলেজ জীবন শেষ হয়ে গেলেও আমার মনের মাঝে চির জাগরুক হয়ে আছে সেই ক্যাম্পাস, অসংখ্য বন্ধু-বান্ধব, শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণ— যাঁরা আমাকে পৌঁছে দিয়েছেন জ্ঞানরাজ্যের উন্মুক্ত দ্বারে। তাঁদের প্রতি আমি চিরকৃতজ্ঞ।
কলেজ জীবনের জ্যোতির্ময় প্রভাব : কলেজ জীবনে আমি প্রায় দুই বছর অতিবাহিত করেছিলাম। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির এই সময় আমার জীবনে চির-অম্লান হয়ে থাকবে। ছাত্রজীবনে পড়াশোনার জগতে স্বাধীনভাবে বিচরণের সুযোগ আমি এখানেই পেয়েছি। বিচিত্র বিষয় সম্পর্কে অভিজ্ঞ শিক্ষকগণের কাছ থেকে যেমন জানার সুযোগ পেয়েছি, তেমনি বহুগ্রন্থের আধার গ্রন্থাগার দিয়েছে নতুন এক জগতের সন্ধান। যে জগতে একবার প্রবেশ করলে মনুষ্যত্বের মূলমন্ত্রটি শিখে নেওয়া যায় এবং কিঞ্চিৎ হলেও মনুষ্যজন্মের যথার্থ সার্থকতা সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। সেখানে মুক্ত মনে, খোলা চোখে বিচিত্র জ্ঞানরাজ্যে বিচরণের সুযোগ পেয়েছি, যা আমৃত্যু অক্ষয় স্মৃতি হয়ে থাকবে। বস্তুত কলেজ জীবনেই আমি আত্মবিশ্বাস আর স্বনির্ভরতা অর্জনের উপায় আত্মস্থ করতে পেরেছিলাম; যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন যথার্থ সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। কলেজ জীবনে বন্ধুদের উষ্ণ সান্নিধ্য যেমন আমার বিকাশমান জীবনকে সুখময় করে তুলেছিল তেমনি বাকি জীবনেও সেই অনুভূতির রসদ নিয়ে আমি আমার ব্যক্তিত্বকে প্রসারিত করে চলছি। সুতরাং আমার সার্থক জীবনযাত্রায় কলেজ জীবনের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে।
নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন : স্কুল জীবনে আমি মা-বাবার সাথে ছিলাম। তাঁদের অভিভাবকত্বে আমি আমার স্কুল জীবন কাটিয়েছি । তখন পড়ালেখা ব্যতীত অন্য কোনো চিন্তা ছিল না। কিন্তু কলেজে ভর্তি হয়ে আমাকে কলেজ হোস্টেলে থাকতে হয়েছিল। এর প্রধান কারণ বাসা থেকে কলেজের অধিক দূরত্ব। ফলে এটা ছিল, আমার জন্য এক নতুন ব্যাপার। এক্ষেত্রে আমার অভিভাবকত্ব আমাকেই গ্রহণ করতে হয়েছিল। এতে যেমন স্বাধীনতা ছিল তেমনি ছিল কঠিন এক দায়িত্ব পালনের ভার । বেঁচে থাকার অর্থই দায়িত্ব পালন এবং সেই দায়িত্ব পালনে সফল হতে পারলেই জীবন সার্থক হয়। আমি সেই দায়িত্ব পালনের প্রথম শিক্ষা কলেজ জীবনেই পেয়েছিলাম। তাছাড়া স্কুল জীবনে আমি নির্দিষ্ট একটা গণ্ডির মধ্যে থাকতাম। অথচ কলেজ জীবন ছিল স্কুল জীবন থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও স্বাধীন, যা পরবর্তী জীবনে আমার মানসিক বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের ছাত্রছাত্রীর সাথে বন্ধুত্ব এবং অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলীর সান্নিধ্যের ফলে যে মনোবল ও সাহস গড়ে উঠেছিল তা আমাকে জীবনের বাস্তবতাকে চিনিয়েছে; বুঝিয়েছে বেঁচে থাকা মানে জীবনের সাথে এক বিচিত্র সংগ্রাম। মূলত, স্কুল জীবনে ছাত্র ও শিক্ষকের মাঝে যে দূরত্ব থাকতত তা ছিল জ্ঞানার্জনের পথে অন্তরায়। মনে এমন কিছু অদম্য প্রশ্ন থাকতাে, যা ভীতির কারণে স্কুলের শিক্ষকদের কাছে বলা যেত না। কিন্তু কলেজ জীবনে স্যারদের বন্ধুসুলভ আচরণে সে ভীতি দূর হয়ে গিয়েছিল। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলাে, কলেজে কোনাে নির্দিষ্ট বিষয়কে এত বিশদ ব্যাখ্যা করা হতাে যে, আলােচ্য বিষয়টি পুরােপুরি আয়ত্তে চলে আসতাে। মােটকথা, সাবিক দিক থেকেই কলেজ জীবন ছিল নতুন নতুন অভিজ্ঞতায় ভরপুর।
কলেজে সংস্কৃতি চর্চা : কলেজে শুধু পড়ালেখাই হতাে না, নিয়মিত সংস্কৃতি চর্চাও হতাে। আর সংস্কৃতি ধারণ ও লালন-পালন তথা সংস্কৃতিমান হওয়াই যে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য, তা আমি কলেজে এসেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম। কলেজে ভাষা শহিদ দিবস, স্বাধীনতা দিবস, শারদোৎসব, সরস্বতী পুজো, রবীন্দ্র জয়ন্তী, নজরুল জয়ন্তী প্রভৃতি উপলক্ষ্যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হতাে। এছাড়াও কলেজ কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের প্রতিযােগিতারও আয়ােজন করতেন। প্রতিযােগিতায় অংশ নিয়ে এবং অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করে আমি আমার কলেজে বেশ পরিচিত ছিলাম। আহ! সেসব দিনের কথা ভাবলে আজও মনটা বড় চঞ্চল হয়ে ওঠে।
কলেজে খেলাধুলা : কলেজে খেলাধুলার প্রচুর সুযােগ ছিল। ক্যারাম, ক্রিকেট, ফুটবল, দাবা, হকি, টেনিস- যার যে খেলা পছন্দ অবসরে সে সেই খেলায় অংশগ্রহণ করত । আমার সবচেয়ে ভালাে লাগতাে ক্যারাম ও ক্রিকেট। মাঝে মাঝে টেনিসও খেলতাম। কেউ কেউ শুধু পড়া নিয়েই থাকতাে, আবার কেউ কেউ দেখতাম শুধু খেলাধুলা নিয়েই পড়ে আছে। এর কোনােটাই আমার পছন্দ হতাে না। কেননা ছাত্রছাত্রীদের প্রধান কাজই হলাে পড়াশুনা করা। তবে পড়াশুনার পাশাপাশি শরীর ও মনে প্রফুল্লতা আনয়নের জন্য খেলাধুলা ও সংস্কৃতি চর্চা করাও একান্ত প্রয়ােজন।
উল্লেখযােগ্য স্মরণীয় স্মৃতি : কলেজ জীবনের কিছু স্মৃতি আছে, যা আমার স্মৃতির আকাশে আজও ধ্রুবতারার মতাে জ্বলজ্বল করছে। এবং সেই সব স্মৃতির ঔজ্জ্বল্য কখনাে স্নান হবে বলে মনে হয় না। সেই সব স্মৃতি আজও আমার মনের মাঝে আনন্দের শিহরন তােলে। একবার বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী আমাদের কলেজে এসেছিলেন। আমি তখন দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র । কলেজের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বেশ জনপ্রিয় হওয়ায় আমার ওপর দায়িত্ব পড়েছিল অভিনন্দনপত্র পাঠ করার । আবৃত্তিতে আমি যেমন সবার সেরা ছিলাম তেমনি বাংলা উচ্চারণে আমার মতাে পারদর্শী আর কেউ ছিল না। প্রথমে আমার ভেতর একটু ভয় কাজ করছিল। কিন্তু মঞ্চে উঠতেই মুহূর্তের মধ্যে সব জড়তা দূর হয়ে গেল। অভিনন্দনপত্র পাঠে আমি সবার বাহবা কুড়িয়ে নিয়েছিলাম । সে যে কী আনন্দ! গর্বে আমার বুক ফুলে উঠছিল সেদিন সকলের প্রশংসা ও ভালােবাসায় আমি সিক্ত হয়েছিলাম। অনেক স্মৃতির মধ্যে এটিই আমার কলেজ জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য স্মরণীয় স্মৃতি, যা আমাকে আজও মহৎ কাজে উৎসাহ যােগায়।
উপসংহার : কলেজ জীবনের সবই ছিল মাধুর্যমণ্ডিত। পরিণত বয়সে সকলেই ছাত্রজীবনের স্মৃতিচারণ করে মানসিক আনন্দ লাভ করে। এ এক অনবদ্য অনুভূতি, যা বলে বুঝানাে যায় না। এ শুধু সেই উপলব্ধি করতে পারে, যে তার জীবনের মূল্যবান সময় বিকিয়ে গড়ে তুলেছে মধুময় সােনালি অতীত। আমার স্পষ্ট মনে আছে সেই ২০২০-২০২১ সালের কথা, যখন আমি কলেজে পড়তাম। মনে পড়ছে সেই সব বন্ধুদের আর আমার শ্রদ্ধেয় স্যারদের । মনে পড়ছে কলেজের সামনের পুকুর, পুকুর পাড়ে নারকেল গাছের সারি- যেখানে আমি আমার জীবনের দুটি বছর কাটিয়েছিলাম। বস্তুত আমার ভবিষ্যৎ জীবনের বীজ আমি কলেজ জীবনেই বপন করেছিলাম, যার জন্য আজ আমি এত দূর আসতে পেরেছি। তাই আমি আমার কলেজ জীবনকে ভুলতে পারিনি, আর ভােলা সম্ভবও নয়। আজও কলেজ জীবনের কথা স্মরণ করলে আমার হৃদয়ে আনন্দ-বেদনার অনেক চিত্র ফুটে ওঠে যা, বিস্মৃতির অতলে স্মৃতিভান্ডার হয়ে রবে অম্লান চিরকাল।
Leave a comment