উনবিংশ শতাব্দীর সমাজ পরিপ্রেক্ষিতে মধুসূদন, হেমচন্দ্র ও নবীনচন্দ্র রচিত বাংলা মহাকাব্যগুলির পরিচয় দাও।

কাব্যের মধ্যে পূর্বাপর সঙ্গতি ও ধারাবাহিকতাপূর্ণ কোনও কাহিনী পরিবেষণ করলেই তাকে আখ্যায়িকা-কাব্য’-রূপে চিহ্নিত করা হয়। আর আখ্যায়িকা কাব্য যখন কোনও মহৎ জাতীয় জীবনাদর্শের আধার হয়ে ওঠে, তার বর্ণনায়, চিত্রকল্পে ও চরিত্র-চিত্রণে সেই ভাবসমুন্নতি উদ্ভাসিত হয়, তখনই সেই রচনা মহাকাব্যের মর্যাদা অর্জন করে। উনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি কবিরা বায়ুরন, মুর, স্কট প্রভৃতির কাহিনী-কাব্যের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। আখ্যায়িকা কবিতার রােমান্টিক কল্পনা বৈচিত্র্য, কাহিনীরস ও নাটকীয়তা প্রভৃতি তারা কবিত্বের গৌরবরূপে অনুভব করেছিলেন। আখ্যায়িকা কাব্য ও মহাকাব্যকে দেশাত্মবােধ-প্রকাশের উপযুক্ত মাধ্যমরূপেও তারা অনুভব করে তাদের আদর্শে বাঙলা ভাষায় আখ্যায়িকা ও মহাকাব্য-রচনায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।

ইংরেজি-শিক্ষিত প্রথম বাঙালি কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের শিষ্য এবং তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েও শেপীয়র, স্কট-বায়রন, বিশেষতঃ টমাস মুরের অনুসরণে পাশ্চাত্ত্য রােমান্টিক কবি-কল্পনার প্রয়ােগে বাঙলা কাব্যে আধুনিক ধারা প্রবর্তন করলেন। অবাস্তব কাল্পনিক পরিবেশে প্রণয়লীলার পরিবর্তে তিনি ঐতিহাসিক পটভূমিকায় দেশাত্মবােধকে কাব্যের বিষয়বস্তুরূপে গ্রহণ করেছেন। টডের রাজস্থান কাহিনী থেকে বিষয়বস্তু সংগ্রহ করে রঙ্গলাল বাঙলা সাহিত্যের প্রথম আখ্যানকাব্য ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’ (১৮৫৮) রচনা করেছিলেন। ইতিহাসলব্ধ বিষয়বস্তু, প্রকৃতি বর্ণনা ও রােমান্টিক দেশপ্রেম গতানুগতিক কবিতার জীর্ণ আধারে নতুন রস সঞ্চারিত করেছে। রানা ভীমসিংহের ক্ষত্রিয়দের প্রতি উৎসাহ বাণী ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়’ এদেশে দেশাত্মবােধের উদ্দীপনা জাগিয়ে তুলেছিল। রঙ্গলালের দ্বিতীয় আখ্যানকাব্য ‘কর্মদেবী’র (১৮৬২) চার-সর্গ সম্বলিত কাহিনীও রাজপুত-ইতিহাস থেকে সংগৃহীত। নায়ক সাধুর চরিত্র-পরিকল্পনায় দেশপ্রেমের আদর্শের ছবি স্পষ্টতরভাবে অঙ্কিত। তৃতীয় কাব্য ‘শূরসুন্দরী’র কাহিনীরও ভিত্তি রাজপুত ইতিহাস। কাব্যটি সম্পূর্ণরূপেই বর্ণনাত্মক। রঙ্গলালের তৃতীয় আখ্যানকাব্য ‘কাঞ্চীকাবেরী’র (১৮৭৯) বিষয়বস্তু উড়িষ্যার ইতিহাসের একটি রােমান্টিক কাহিনী। এই কাহিনীর কাঠামাে কবি পেয়েছিলেন পুরুষােত্তম দাসের ওড়িয়া কাব্যে। কাহিনীর আধুনিক রূপ রচনার জন্য তার একটু ঐতিহাসিক ভূমিকা দিয়েছেন এবং কাঞ্চীর যুদ্ধ রাজপুত যুদ্ধের আদর্শে বর্ণনা করেছেন। ‘কাঞ্চীকাবেরী’র রােমাণ্টিক বিষয়বস্তুতে ভক্তিরস প্রবাহিত হয়েছে। কিন্তু রঙ্গলাল কাব্য-প্রকরণে প্রাচীন কাব্যধারারই অনুসরণ করেছেন, ভাষা, ছন্দ ও প্রকাশকলায় তিনি কোনও মৌলিকতার পরিচয় দিতে পারেন নি। তাঁর ‘কর্মদেবী’ প্রকাশের পূর্বেই বাঙলা কাব্যসাহিত্যে মধুসূদন আবির্ভূত হয়েছিলেন, তার ফলে রঙ্গলালের কবিখ্যাতি স্নান হয়ে পড়ে।

প্রকৃতপক্ষে মাইকেল মধুসূদন দত্তই আধুনিক বাঙলা কাব্যের রূপস্রষ্টা। তিনি তাঁর ইয়ােরােপীয় সাহিত্যের বিস্তৃত ও গভীর জ্ঞানে, দুঃসাহসিক কবিপ্রতিভার প্রবল শক্তিমত্তা ও আত্মবিশ্বাসে বাঙলা কবিতাকে একটি সংকীর্ণ গণ্ডি থেকে মুক্ত করে আধুনিক জীবনচেতনার বৃহত্তর জগতে ব্যাপ্তির ঐশ্বর্য দিয়েছেন। এই জীবনবােধ ও প্রতিভার দুর্জয় শক্তিতেই নতুন জীবনাদর্শের উপযুক্ত আধার নির্মাণের তাগিদে মধুসূদন প্রচণ্ড দুঃসাহসে বাঙলা কাব্যে দীর্ঘকাল প্রচলিত পয়ারে চরণান্তিক মিল এবং শ্বাসযতি ও অর্থতির যান্ত্রিক ঐক্যবন্ধনকে ভেঙে মিল্টনের ‘ব্ল্যাঙ্ক ভার্সে’র অনুসরণে ‘অমিত্রাক্ষর ছন্দ’ সৃষ্টি করেছেন। তাঁর ১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত বর্ণনাময় কাব্য তিলােত্তমাসম্ভব’কে মধুসূদন নিজেই Epicling বা মহাকাব্যিকা’ বলেছেন। এই আখ্যায়িকা কাব্যটি মধুসূদনের শিক্ষানবিশি পর্বের রচনা। ত্রুটিবিচ্যুতি-সত্ত্বেও রচনাটিতে মধুসূদনের শক্তির পরিচয় মেলে। ১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ মধুসূদন তার নবজাগরণ-যুগলব্ধ নতুন জীবনবােধের প্রকাশে রামায়ণ কাহিনীর রূপান্তর ঘটিয়েছেন ও দুরাচারীরূপে চিরনিন্দিত রাক্ষসরাজ রাবণকে তাঁর কাব্যের নায়করূপে গ্রহণ করে তার মধ্যে সর্ববন্ধনমুক্ত, আত্মশক্তিতে বলিষ্ঠ, আত্মমর্যাদা সচেতন আধুনিক মানুষের পৌরুষদীপ্ত ব্যক্তিত্ব ও জীবনাদর্শকে রূপায়িত করেছেন। রাম তার কাছে ভীরু, দুর্বল, প্রতি পদে দেবতাদের অনুগ্রহের ওপর নির্ভরশীল; বিভীষণের ধর্মবােধহীন স্বার্থপরতা ও স্বদেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা তাঁর কাছে অমার্জনীয় অপরাধ। মানবহৃদয়ের সর্বপ্রকার অনুভূতির প্রকাশে অমিত্রাক্ষর ছন্দের শক্তি সংশয়াতীতরূপে প্রমাণিত। হােমরের ইলিয়দ, ভার্জিলের এনেইদ, দান্তে, তাসসাে ও মিল্টনের মহাকাব্য, বাল্মীকির রামায়ণ ইত্যাদি রচনা থেকে ভাব, বিষয়বস্তু ও প্রকাশকলা আহরণ করে মধুসূদনই ভাষায় যথার্থ মহাকাব্য রচনায় সফল হয়েছিলেন।

হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের ‘বীরবাহু কাব্য’-এর (১৮৬৪) বিষয় কাল্পনিক। কাব্যটিতে রঙ্গলালের প্রভাব অত্যন্ত স্পষ্ট। বীরবাহুর কাহিনীবিন্যাসে সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও সংহতির অভাব, তবে কোথাও কোথাও বর্ণনার লালিত্য আছে। কাব্যকাহিনীতে রূপকথার মত অনেক অসম্ভব ঘটনা স্থান পেয়েছে। তবে বাঙলাদেশের শিক্ষিতদের মধ্যে সদ্যজাগ্রত দেশাত্মবােধ এই কাব্যে প্রবল ভাবােচ্ছাসে প্রকাশিত হয়েছিল, সেইদিক থেকে তার মূল্য স্বীকার্য। হেমচন্দ্রের প্রধানতম ও সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত রচনা বৃত্রসংহার মহাকাব্য (প্রথম খণ্ড ১৮৭৫, দ্বিতীয় খণ্ড ১৮৭৭)। ইন্দ্রকে পরাজিত করে বৃত্রের স্বর্গ অধিকার, ইন্দ্র ও শচীর দুঃখদুর্গতি ভােগের পর দধীচির অস্থিনির্মিত বজ্রে ইন্দ্রের বৃত্রবধ ও স্বর্গ-উদ্ধার এই মহাকাব্যের বিষয়বস্তু। কাহিনীর কাঠামােটুকুই শুধু পৌরাণিক, বেশির ভাগ অংশই কবির নিজস্ব কল্পনা, কতকটা ইংরেজি কাব্যের অনুকরণ। বৃত্র- সংহার-এর কথাবস্তুতে ও পটভূমিতে যে মহাকাব্যোচিত বিশালতা আছে, মেঘনাদবধ কাব্যে তা দেখা যায় না।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর কৈশাের বয়সের সমালােচনায় ‘মেঘনাদবধে’ নয়, বৃত্রসংহারেই মহাকাব্যের ভাবসমুন্নতি নির্দেশ করেছিলেন ঃ “স্বর্গ উদ্ধারের জন্য নিজের অস্থিদান এবং অধর্মের ফলে বৃত্রের সর্বনাশ যথার্থ মহাকাব্যের বিষয়। কিন্তু সমগ্র কাহিনীটি শিথিল, হেমচন্দ্র তাকে মহাকাব্যের সংহতি দিতে পারেন নি। তার চরিত্র চিত্রণও অত্যন্ত দুর্বল।”

ডাঃ সুকুমার সেন যথার্থই বলেছেন : “বৃত্রসংহারে অনেকগুলি ভালােমানুষী চরিত্র আছে বটে কিন্তু যথার্থ মহৎ চরিত্র নাই। একমাত্র মহৎ চরিত্র দধীচি কাব্যে উপেক্ষিতই রহিয়া গিয়াছে। দেবতাচরিত্রগুলিতে ব্যক্তিত্বের পরিচয় গােচর নয়। বৃত্রের ভূমিকায় বৈদিক ও পৌরাণিক ইন্দ্রশত্র অসুরের গম্ভীর মহিমা পরিস্ফুট নয়।…… বৃত্রসংহারের নায়ক শিবের বরপ্রাপ্ত ভক্তমাত্র, বৃত্রের সম্বল চন্দ্রশেখরের দয়া। ভাগ্যের উপর অপরিসীম বিশ্বাস। ….এইখানে হেমচন্দ্রের বৃত্র মধুসূদনের রাবণের তুলনায় নিষ্প্রভ। ঐন্দ্রিলার ভূমিকায় অসুর মহিষীর দৃপ্ত তেজ ফুটে নাই, ফুটিয়াছে রূপকথার সুয়ােরাণীর হিংসা ও অভিমান।”

নবীনচন্দ্র সেনের ‘পলাশীর যুদ্ধ’ ঐতিহাসিক গাথাকাব্য। ইংরেজদের লেখা ইতিহাসে সিরাজ চরিত্র কলঙ্কের কালিমালেপনে আচ্ছন্ন। নবীনচন্দ্র তার ওপরে নির্ভর করে সিরাজকে নায়কত্বের মর্যাদা দিতে কুণ্ঠিত হয়েছেন। তাঁর কাব্যে মােহনলালই প্রাধান্য পেয়েছে, তার মধ্য দিয়েই দেশাত্মবােধ অভিব্যক্ত। নবীনচন্দ্র ‘পলাশীর যুদ্ধে’ অনেক স্থানেই বায়রনের Childe Harold-এর যুদ্ধ বর্ণনা পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন, এমন কি কোথাও কোথাও তার আক্ষরিক অনুবাদ পর্যন্ত করেছেন। ‘পলাশীর যুদ্ধে’র কাব্যমূল্য বিশেষ কিছু নেই, তবে তার দেশপ্রেমের ভাবােচ্ছাস সমকালীন পাঠকদের প্রভাবিত করেছিল। নবীনচন্দ্রের ‘ক্লিওপেট্রা’ একটি দীর্ঘ বর্ণনামূলক কবিতা মাত্র, কবি দ্বিচারিণী ক্লিওপেট্রার প্রতি পাঠকের সহানুভূতি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন, রচনাটির বিশেষত্ব মাত্র এইটুকুই। ‘রঙ্গমতী’ (১৮৮০) স্কুটের আদর্শে রচিত আখ্যায়িকা কাব্য, কাল্পনিক কাহিনীর পটভূমি চট্টগ্রামের রাঙামাটি অঞ্চল, শিবাজীর প্রসঙ্গ সন্নিবিষ্ট করে কবি রচনাটিকে স্বাদেশিকতার গৌরব দিতে চেয়েছেন। এই রচনাটির কাব্যমূল্যও অকিঞ্চিৎকর। নবীনচন্দ্র সেন তার ত্রয়ী কাব্যে—’রৈবতক’ (১৮৮৬), ‘কুরুক্ষেত্র’ (১৮৯৩) ও ‘প্রভাস’ (১৮৯৬)-এ ঐক্যবদ্ধ অখণ্ড ভারতবর্ষের জাতীয়তার আদর্শের মূর্তি তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। বিষয়বস্তুতে মহাকাব্যোচিত বিশালতা লক্ষণীয়। তিনটি কাব্যের কেন্দ্রীয় ঘটনা যথাক্রমে সুভদ্রাহরণ, অভিমন্যবধ ও যদুবংশ ধ্বংস। নিষ্কাম ধর্ম ও নিষ্কাম প্রেমের সূত্রে আর্য-অনার্যের ঐক্যবন্ধন এবং অথণ্ড হিন্দুসংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা। এই উদ্দেশ্যসাধনেই নায়ক শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব। তার সহায় ছিল অর্জুনের বীরত্ব, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের মনীষা, সুভেদ্রার প্রীতি ও শৈলজার প্রেম। দুর্বাসার অকারণ প্রতিহিংসা ও অভিমান এবং বাসুকির সংশয় ছিল তার বিরােধী শক্তি। কল্পনা ও আবেগের মাত্রাহীন অসংযম, রচনারীতিতে শৈথিল্য, সুলােচনার অসংযত কৌতুকচাপল্য ও লঘুতা, চরিত্র-চিত্রণে দুর্বলতা প্রভৃতি ত্রয়ী-কাব্যের মহাকাব্যের গৌরব অর্জনে গুরুতর বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিছক আখ্যায়িকা কাব্য হিসেবেও ঘটনা ও চরিত্রের টানাপােড়েন তাদের সংহত রূপ দিতে কবি ব্যর্থ হয়েছেন। নবীনচন্দ্র অবতার মহাপুরুষদের জীবন নিয়ে কয়েকটি আখ্যায়িকা-কাব্য লিখেছিলেন ও যীশুখ্রীষ্টের জীবনী নিয়ে ‘খৃষ্ট’ (১২৯৭), বুদ্ধের জীবনী ‘অমিতাভ’ (১৩০২) ও শ্রীচৈতন্যের নবদ্বীপ-লীলাকাহিনী ‘অমৃতাভ’ (১৩১৬); কোনওটির কাব্যমূল্যই উল্লেখযােগ্য নয়।