কাব্যের মধ্যে পূর্বাপর সঙ্গতি ও ধারাবাহিকতা পূর্ণ কোন কাহিনী পরিবেশন করলেই ডাকে ‘আখ্যায়িকা-কাব্য’ রূপে চিহ্নিত করা হয়। আর আখ্যায়িকা কাব্য যখন কোন মহং জাতীয় জীবনাদর্শের আধার হয়ে ওঠে, তার বর্ণনায় চিত্রকল্পে ও চরিত্র চিত্রণে সেই ভাব সমুন্নতি উদ্ভাসিত হয়, তখনই সেই রচনা মহাকাব্যের মর্যাদা লাভ করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালী কবিরা বায়রণ, ম্যুর, স্কট প্রভৃতির কাহিনী কাব্যের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। আখ্যায়িকা কবিতার রোমান্টিক কল্পনা বৈচিত্র্য, কাহিনীরস, ও নাটকীয়তা প্রভৃতি তারা কবিত্বের গৌরব রূপে অনুভব করেছিলেন। আখ্যায়িকা কাব্য ও মহাকাব্যকে দেশাত্মবোধ প্রকাশের উপযুক্ত মাধ্যমরূপেও তারা অনুভব করেছিলেন। তাদের আদর্শে বাংলা ভাষায় আখ্যায়িকা ও মহাকাব্য রচনায়‌ অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এই ধারায় প্রথম পথিকৃত হলেন ইংরেজী শিক্ষিত প্রথম বাঙালী কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বিদেশী রীতিকে অনুসরণ করে মহাকাব্য রচনায় পদ চারণা করেছিলেন। তাঁর পদ্মিনী উপাখ্যান এই শ্রেণীর সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ। এরপর একে একে মহাকাব্যের আঙিনায় আপন আপন স্বাক্ষর রাখতে আবির্ভূত হলেন—হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও নবীনচন্দ্র সেন। তারা নিজ নিজ ভাব ও বৈশিষ্ট্যের দ্বারা স্বাতন্ত্র্য ধর্মী মহাকাব্য রচনা করে আপন কীর্তিকে চির ভাস্বব করে রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন।

বাংলা মহাকাব্যের ধারায় মধুসূদন দত্তের কৃতিত্ব ও অবদান:

আধুনিক বাংলা কাব্যের রূপস্রষ্টা হলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনি তাঁর ইউরোপীয় সাহিত্যের বিস্তৃত ও গভীর জ্ঞানে, দুঃসাহসিক কবি প্রতিভার প্রবল শক্তিমত্তা ও আত্মবিশ্বাসে বাংলা কবিতাকে একটি সংকীর্তন গণ্ডী থেকে মুক্ত করে আধুনিক জীবন চেতনার বৃহত্তর জগতে ব্যাপ্তির ঐশ্বর্য দিয়েছেন। এই জীবনবোধ ও প্রতিভার দুর্জয় শক্তিতেই নতুন জীবনাদর্শের উপযুক্ত আধার নির্মাণের তাগিদে মধুসূদন প্রচণ্ড দুঃসাহসে বাংলা কাব্যে দীর্ঘকাল প্রচলিত পয়ারে চরাণাস্তিক মিল এবং শ্বাসযতি ও অর্থযতির যান্ত্রিক ঐক্যবন্ধনকে ভেঙে মিল্টনের ‘ব্ল্যাংকভার্সের’ অনুসরণে ‘অমিত্রাক্ষর ছন্দ’ সৃষ্টি করেছেন। তাঁর ১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত বর্ণনাময় কাব্য ‘তিলোত্তমাসম্ভব’কে মধুসূদন নিজেই মহাকাব্যিকা বলেছেন। এই আখ্যায়িকা কাব্যটি মধুসূদনের শিক্ষানবিশী পর্বে রচনা। ত্রুটি বিচ্যুতি সত্ত্বেও রচনাটিতে মধুসূদনের শক্তির পরিচয় মেলে। ১৮৬১ খ্ৰীঃ প্রকাশিত ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ মধুসূদন তার নবজাগরণ যুগলব্ধ নতুন জীবনবোধের প্রকাশে রামায়ণ কাহিনীর রূপান্তর ঘটিয়েছেন। দূরাচারী চির নিন্দিত রাক্ষসরাজ রাবণকে তাঁর কাব্যের নায়করূপে গ্রহণ করে তার মধ্যে সর্ব বন্ধনমুক্ত, আত্মশক্তিতে বলিষ্ঠ, আত্মমর্যাদা সচেতন আধুনিক মানুষের পৌরুষদীপ্ত ব্যক্তিত্ব ও জীবনাদর্শকে রূপায়িত করেছেন। রাম তার কাছে ভীরু, দুর্বল, প্রতি পদে দেবতাদের অনুগ্রহের উপর নির্ভরশীল। বিভীষণের ধর্মবোধহীন স্বার্থপরতা ও স্বদেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা তাঁর কাছে অমার্জনীয় অপরাধ মানব হৃদয়ের সর্বপ্রকার অনুভূতির প্রকাশে অমিত্রাক্ষর ছন্দের শক্তি সংশয়াতীত ভাবে প্রমাণিত। হোমার ভার্জিল, দান্তে মিল্টন বাল্মীকির মহাকাব্যের রচনা থেকে ভাব, বিষয়বস্তু ও প্রকাশ ৭ লা আহ্বান করে মধুসূদনই যথার্থ মহাকাব্য রচনায় সফল হয়েছিলেন।

বাংলা মহাকাব্যের ধারায় হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কৃতিত্ব ও অবদান:

হেমচন্দ্রের প্রথম কাব্য ‘বীরবাহু (১৮৬৪)-র বিষয় কাল্পনিক, কাব্যকাহিনীতে রূপকথার মতো অনেক অসম্ভব ঘটনা স্থান পেয়েছে। তবে বাংলা দেশের শিক্ষিতদের মধ্যে সদ্য জাগ্রত দেশাত্মবোধ এই কাব্যে প্রবল ভাবোচ্ছ্বাসে প্রকাশিত হয়েছিল, সেদিক থেকে তার মূল্য স্বীকার্য। হেমচন্দ্রের প্রধানতম ও সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত রচনা বৃত্রসংহার (১৮৭৫, ৭ মহাকাব্য)। ইন্দ্রকে পরাজিত করে বৃত্রের স্বর্গ অধিকারইদ্র ও শচীর দুঃখ দুর্গতি ভোগের পর দধীচির অস্থি নির্মিত বস্তু। কাহিনীর কাঠামোটুকু শুধু পৌরাণিক বেশীর ভাগ অংশই কবির নিজস্ব কল্পনা, কতকটা ইংরাজী যে মহাকাব্যোচিত বিশালতা স্থাছে, মেঘনাদবধ কাব্যে তা দেখা যায় না। ডঃ সুকুমার সেন যথার্থই বলেছেন : ‘বৃত্রসংহারে অনেকগুলি ভালোমানুষী চরিত্র আছে বটে কিন্তু যথার্থ মহৎ চরিত্র নাই। একমাত্র মহৎ চরিত্র দধীচি কাব্যে উপেক্ষিতাই রহিয়া গিয়াছে। দেবতা চরিত্রগুলিতে ব্যক্তিত্বের পরিচয় গোচর নয়। বৃত্রের ভূমিকায় বৈদিক ও পৌরাণিক ইন্দ্রশত্রু অসুরের গম্ভীর মহিমা পরিস্ফুট নয়। বৃত্রসংহারের নায়ক শিবের বরপ্রাপ্ত ভক্ত মাত্র, বৃত্রের সম্বল চন্দ্রশেখরের দয়া। ভাগ্যের উপর অপরিহার্য বিশ্বাস। এইখানে হেমচন্দ্রের বৃত্র মধুসুদনের রাবণের তুলনায় নিষ্প্রভ, ‘ঐন্দ্রিলার ভূমিকায় অসুর মহিষীর দৃপ্ত তেজ ফুটে নাই, ফুটিয়াছে রূপকথার সুয়োরানীর হিংসা ও অভিমান।” তবুও বলতে হয় হেমচন্দ্রের বৃত্রসংহার বাংলা সাহিত্য কাব্যে এক অবিস্মরণীয় মহাকাব্য।

বাংলা মহাকাব্যের ধারায় নবীনচন্দ্র সেনের কৃতিত্ব ও অবদান:

নবীনচন্দ্র সেনের প্রথম ঐতিহাসিক গাথাকাব্য হল ‘পলাশীর যুদ্ধ। ইংরাজদের লেখা ইতিহাসে সিরাজ চরিত্র কলঙ্কের কালিমালেপনে আচ্ছন্ন। নবীনচন্দ্র তার উপরে নির্ভর করে সিরাজকে নায়কত্বের মর্যাদা দিতে কুণ্ঠিত হয়েছেন। তাঁর কাব্যে মোহনলালই প্রাধান্য পেয়েছে। তার মধ্য দিয়েই দেশাত্মবোধ অভিব্যক্ত, পলাশীর যুদ্ধের কাব্যমূল্য বিশেষ কিছু নেই, তবে তার দেশপ্রেমের ভাবোচ্ছ্বাস সমকালীন পাঠকদের প্রভাবিত করেছিল। তার ‘রঙ্গমতি স্কটের আদর্শের রচিত আখ্যায়িকা কাব্য। কাল্পনিক কাহিনীর পটভূমি চট্টগ্রামের রাঙামাটি অঞ্চল, শিবাজীর প্রসঙ্গ সন্নিবিষ্ট করে কবি রচনাটিকে স্বাদেশিকতার গৌরব দিতে চেয়েছেন। নবীনচন্দ্র সেন তাঁর ত্রয়ী কাব্যে—রৈবতক (১৮৮৬), কুরুক্ষেত্র (১৮৯৩) ও প্রভাস (১৮৯৬)-এ ঐক্যবদ্ধ অখণ্ড ভারতবর্ষের জাতীয়তার আদর্শের মূর্তি তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। বিষয়বস্তুতে মহাকাব্যোচিত বিশালতা লক্ষ্যণীয়। তিনটি কাব্যের কেন্দ্রীয় ঘটনা যথাক্রমে সুভদ্রাহরণ, অভিমন্যু ও যদুবংশ ধ্বংস, নিষ্কামধর্ম, নিষ্কাম প্রেমের সূত্রে আর্য অনার্যের ঐক্যবন্ধন এবং অখণ্ড হিন্দু সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা, এই উদ্দেশ্য সাধনেই নায়ক শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব। তাঁর সহায় ছিল অর্জুনের বীরত্ব, কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ বেদব্যাসের মনীষা, সুভদ্রার প্রীতি ও শৈলজার প্রেম, দুর্বাসার অকারণ প্রতিহিংসা ও অভিমান এবং বাসুকীর সংশয় ছিল তার বিরোধী শক্তি। কল্পনা আবেগের মাত্রাহীন অসংযম, রচনা রীতিতে শৈথিল্য, সুলোচনার অসংযত কৌতুক চাপল্য ও লঘুতা, চরিত্র চিত্রণে দুর্বলতা প্রভৃতি ত্রয়ী কাব্য মহাকাব্যের গৌরব অর্জনে গুরুতর বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সবশেষে বলতে হয়। বঙ্কিমচন্দ্র নবীনচন্দ্রের সঙ্গে ইংরেজ কবি বায়রণের তুলনা প্রসঙ্গে লিখেছিলেন—“যদি উচ্চৈস্বরে রোদন, যদি আন্তরিক মর্মবেদী কাতরোক্তি, যদি ভয়শূন্য তেজোময় সত্যপ্রিয়তা। যদি দুর্বাসা প্রার্থিত সেই ক্রোধ, দেশ বাৎসল্যের লক্ষণ হয়। তবে দেশ বাৎসল্য নবীন বাবুর।’ কোন কোন ব্যক্তির পক্ষে এগুলি নিশ্চয়ই দেশবাৎসল্যের লক্ষণ হতে পারে না। কিন্তু উচ্ছ্বসিত ক্রন্দন এবং কতোরোক্তিকেই কবিতা বলা যায় না। কবিতা সৃষ্টির জন্য কল্পনার সংযম প্রয়োজন। নবীনচন্দ্রে এই সংযমের নিতান্ত অভাব ছিল। এই কারণেই সাময়িক কালের শ্রেষ্ঠ সমালোচক বঙ্কিমচন্দ্রও তাঁকে কবি হিসাবে উচ্চ আসন দিতে কুণ্ঠিত হয়েছেন। মধুসূদন বা রবীন্দ্রনাথের কাব্যকলার তুলনায় নবীনচন্দ্রের রচনাসমূহ উচ্চ আসন দাবী করতে পারে না। তবুও এই মহাকবির মধ্যবর্তী সময়ে হেমচন্দ্রের মতোই নবীনচন্দ্রই যুগচেতনার প্রতিপালনে তার সৃষ্ট কাব্যের প্রতি সাধারণ পাঠকদের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠার সূচনার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা কাব্যের ক্ষেত্রে নবীনচন্দ্রের প্রভাব মন্দীভূত হয়ে আসে। তবুও তাকে সাহিত্য ক্ষেত্রে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়। এটাই তার অনন্য কৃতিত্ব।