কোন ভাষার কোন শব্দই প্রায় চিরকাল একই অর্থ বহন করে না। নানাকারণেই অধিকাংশ শব্দের অর্থান্তর ঘটে থাকে। শব্দার্থের এই পরিবর্তন নানা ধারায়ই সংঘটিত হলেও ভাষাবিজ্ঞানিগণ প্রধানতঃ পাঁচটি ধারাকেই স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন

  • (১) অর্থসঙ্কোচ

  • (২) অর্থপ্রসার, 

  • (৩) অর্থোন্নতি, 

  • (৪) অর্থাবনতি 

  • (৫) অর্থসংশ্লেষ/অর্থসংক্রম বা শব্দার্থের আমূল পরিবর্তন।

অর্থসঙ্কোচ/শব্দার্থের সঙ্কোচ: যে কোন শব্দের অর্থসমষ্টির মধ্যে যদি কোন এক প্রধান হয়ে ওঠে অথবা সমষ্টিবাচক শব্দকে ব্যষ্টি অর্থেও সমগ্র থেকে অংশকে কিংবা কারণবাচক শব্দ থেকে কার্যবাচক শব্দকে বােঝায় তখন শব্দের ‘অর্থ সঙ্কোচ’ ঘটে থাকে। ‘মৃগ’ শব্দের মূল অর্থ ‘পশু’ (মৃগয়াপশুশিকার, মৃগেন্দ্র-সিংহ, পশুরাজ), কিন্তু এখানে ব্যষ্টি বােঝাতে সমষ্টিবাচক শব্দপ্রয়ােগ হওয়াতে অর্থসঙ্কোচ হলাে, কারণ শব্দটির প্রচলিত অর্থ ‘হরিণ’। ‘মহােৎসব’ শব্দের অর্থ ‘যে মহৎ উৎসব’ কিন্তু বর্তমানে এটি বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের একটি বিশেষ উৎসবে (মােচ্ছব) পরিণত হওয়াতে অর্থসঙ্কোচ হয়েছে। ‘কৃপণ’ শব্দের মূল অর্থ ‘কূপার পাত্র’, কিন্তু অর্থ সঙ্কোচের ফলে ‘ব্যয়কুণ্ঠ’ অর্থ দাঁড়িয়েছে। ‘বৈবাহিক’ শব্দের মূল অর্থ ‘বিবাহ- সম্পর্কিত’, অর্থসঙ্কোচের ফলে ‘বড় শ্যালক’।

অর্থপ্রসার/শব্দার্থের প্রসার: শব্দের মূল অর্থ যখন কোন কারণে বস্তুর সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে বস্তুনিরপেক্ষ হয়ে দাঁড়ায় তখনই তার প্রসার ঘটে-একেই বলা হয় ‘শব্দার্থের প্রসার’। ‘ধন্য’ শব্দের মূল অর্থ ‘যার ধন আছে’ কিন্তু এখন তার অর্থ প্রসারিত হয়ে যে কোন সৌভাগ্যবানকেই বােঝাতে পারে। ‘কালী’ বলতে বােঝাতাে ‘কালাে রঙ-এর তরল লিখবার উপাদান’—অর্থপ্রসার ঘটাতে এখন কালী কালাে রঙ ছাড়াও হয় এবং তরলতাবর্জিত ও লিখবার উপাদান না হলেও চলে (যেমন জুতা কালী)। ব্যক্তিনাম ব্যক্তি বা বস্তুনিরপেক্ষ হয়ে সাধারণ বস্তু বা ভাবের পরিচায়ক হলে তার অর্থবিস্তার ঘটে—ম্যাকিন্টস্ (Macintosh) নামক ব্যক্তি যে ধরনের বর্ষাতি ব্যবহার করতেন তারই নাম হয়ে দাঁড়ায় Macintosh। কোন স্থান থেকে আগত বস্তুর নাম ঐ স্থানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে শব্দার্থের প্রসার ঘটাতে পারে। ‘বাটাভিয়া’ থেকে আনীত ফল ‘বাতাবী’, কিংবা ‘মার্তাবান’ থেকে আগত কলা ‘মর্তমান কলা’—এতে হয়েছে শব্দার্থের প্রসার।

অর্থোন্নতি/শব্দার্থের উৎকর্ষঃ শব্দের বাচ্যার্থ বা মূল অর্থ অপেক্ষাও যদি এর প্রচলিত অর্থ ভাবের বিষয় বা ভাবকে প্রকাশ করে তবেই শব্দের অর্থোন্নতি ঘটে থাকে। ‘মন্দির’ শব্দের মূল অর্থ ছিল ‘গৃহ’। কিন্তু এর প্রচলিত অর্থ ‘দেবগৃহ’, কাজেই এখানে অর্থোন্নতি ঘটেছে। ‘ভােগ’ এবং ‘ভােজ’ দুটি শব্দের একই অর্থ অথচ ‘ভােগ’ শব্দটি প্রধানত ‘দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত অন্নাদি’ বােঝাতেই ব্যবহৃত হয় বলে এখানে শব্দার্থের উৎকর্ষ ঘটেছে। ‘ভীষণ সুন্দর’ শব্দ ‘ভীষণ’ শব্দের অর্থোন্নতি ঘটে কারণ ‘ভীষণ’ শব্দের মূল অর্থ ‘যা ভয় দেখায়’- সুন্দর কখনাে ভয় দেখাতে পারে না বলেই ভীষণের অর্থোন্নতি। মেয়েদের ‘দেবী’ উপাধিও অর্থোন্নতির দৃষ্টান্ত।

অর্থাবনতি/শব্দার্থের অপকর্ষঃ কোন শব্দের বাচ্যার্থ বা মূল অর্থ উকবাচক হলেও প্রচলিত অর্থ যদি অপেক্ষাকৃত হীন অর্থ বােঝায় তাহলে অর্থের অপকর্য ঘটে থাকে। মহান শব্দের মূল অর্থ ‘মহৎ ব্যক্তি’, কিন্তু এর প্রচলিত অর্থ ‘সুদখাের’—অতএব অসাধু ও নিষ্ঠুর হওয়াই সম্ভবত তাই অর্থাবনতি ঘটালাে। ‘পীরিতি’ শব্দটি ‘বৈষ্ণব পদাবলী’তে ‘রাধাকৃষ্ণের অপার্থিব প্রেম’, কিন্তু এর প্রচলিত অর্থ ‘অবৈধ প্রেম’, অতএব এখানে শব্দের অর্থাপকর্য ঘটেছে। ‘ইতর’ শব্দের মূল অর্থ ‘অপর, অন্য’ কিন্তু প্রচলিত অর্থ ‘নীচ, ছােট লােক’- অতএব অর্থাবনতির দৃষ্টান্ত। ‘গ্রাম্য, নগর’ শব্দেও অর্থের অবনতি ঘটেছে।

অর্থসংক্রম /শব্দার্থের আমূল পরিবর্তন:- শব্দার্থের ক্রমিক সঙ্কোচ ও প্রসারের ফলে মধ্যবর্তী ভরে লুপ্ত হয়ে যায় বলে মূলের সঙ্গে প্রচলিত অর্থের আর কোন সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না, এইভাবেই ‘অর্থসংক্রম’ বা শব্দার্থের আমূল পরিবর্তন ঘটে থাকে। ‘সন্দেশ’ এবং ‘তত্ত্ব’ দু’টি শব্দেরই মূল অর্থ ছিল ‘সংবাদ’, প্রাচীনকালে যখন যাতায়াতের কোন সুব্যবস্থা ছিল না, তখন কন্যাগৃহে সংবাদ আদানপ্রদানের জন্য লােক পাঠানাে হতাে—অবশ্যই তাদের সঙ্গে থাকতাে হাঁড়িতে মিষ্টদ্রব্য এবং পােটলায় কাপড়-চোপড়। সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনে সংবাদ আদানপ্রদান সহজ সাধ্য হলেও কন্যার শ্বশুরগৃহের চিরকালের প্রাপ্য হাঁড়ি বােঝাই মিষ্টি এবং কাপড় চোপড়ের দাবি কিন্তু বাতিল হলাে না ফলে সন্দেশ এবং তত্ত্ব সংবাদ ছেড়ে ‘মিষ্টদ্রব্য’ ও ‘কাপড়চোপড়’ বােঝাতেই ব্যবহৃত হতে লাগলাে। ‘বিবাহ’ শব্দে জোর করে বহন করে নিয়ে যাবার ইঙ্গিত পাওয়া যায়, কিন্তু বর্তমানে এটি একেবারেই ‘সামাজিক অনুষ্ঠান’। ‘গবেষণা’ শব্দের মূল অর্থ ‘গােরু খোঁজা’, এখন তা কাগজপত্রেই নিবনদ্ধ থাকায় অর্থসংক্রম ঘটেছে, ‘শুশ্রুযা’ মূল অর্থ ‘শােনবার ইচ্ছা’ আমূল পরিবর্তনের ফলে ‘পরিষেবা’।