ভূমিকা: প্রহসন এক প্রকার নাট্য সৃষ্টি যেখানে হাস্যরসময় জীবনের আলেখ্য রূপায়িত হয়ে উঠে। সমাজের দোষত্রুটি অবলম্বনে, ব্যঙ্গবিদ্রূপের মাধ্যমে প্রহসন পাঠকের বা দর্শকের কাছে কৌতুকময় হয়ে উঠে। প্রহসনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বিভিন্ন সাহিত্যিক একে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। অধ্যাপক এন চৌধুরী প্রহসনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, “সমাজের কুরীতি সংশোধনের জন্য রহস্যময় ঘটনা সংবলিত হাস্যপ্রধান একাঙ্কিকা নাটককে প্রহসন বলে।” আবার সংস্কৃতি আলঙ্কারিকদের মতে, সমাজের কুরীতি শোধনার্থে ঘটনা সংবলিত হাস্যরস প্রধান একাঙ্কিকা নাটকই হলো প্রহসন।
বাংলা প্রহসনের উদ্ভব: নাটকের মতো প্রহসনও সমাজসচেতন শিল্পীর স্বাক্ষর। উনিশ শতকের বাঙালি সমাজে একদিকে পুরুষের বহুবিবাহ ও অন্যদিকে বিধবা বিবাহরোধ। তদুপরি ইংরেজদের প্রভাবে কিছু উঠতি যুবক মদ্যপান, বেশ্যাসক্ত হয়ে সমাজের সাধারণ রীতিনীতি ও জাতি ধর্ম বিনষ্ট করে সমাজকে অধঃপতনের অতলে তলিয়ে দিচ্ছিল। তৎকালীন বিত্তবানদের কুৎসিত কার্যকলাপ এবং সমাজের কুপ্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে একটির পর একটি প্রহসন নাট্যকারেরা সৃষ্টি করেছেন।
উনিশ শতকে বাংলা সাহিত্যে প্রচুর প্রহসন রচিত হয়েছিল। সাধারণত প্রহসন তিন ভাগে বিভক্ত। যেমন- (১) সমাজ সংস্কার, (২) হাস্যরসপ্রধান বিদ্রূপাত্মক এবং (৩) বুদ্ধিবৃত্তিমূলক। পাশ্চাত্য প্রভাবে এদেশের তরুণ সমাজ মদ্যপানে আকৃষ্ট হয়ে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়ে। হিন্দু সমাজের বহুবিধ কুসংস্কার যেক্ষেত্রে জাতীয় জীবনকে ঘোরতর সংকটাপন্ন অবস্থায় নিপতিত করেছিল তা দূর করার জন্য এ সময়ের সমাজসচেতন নাট্যকারগণ প্রহসন রচনায় আত্মনিয়োগ করেন।
বাংলা প্রহসনের বিকাশ: বাংলা প্রহসনের বিকাশে যারা দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন নিচে তাদের সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
রামনারায়ণ তর্করত্ন (১৮২২-৮৬): কুলীনকুলসর্বস্ব (১৮৫৪) রামনারায়ণ তর্করত্নের একাধারে নাটক ও প্রহসন। সামাজিক কৌলীন্য প্রথা এ প্রহসনটির বিষয়। ‘নবনাটক’ এ লেখকের শ্রেষ্ঠ রচনা। বহুবিবাহ, কুপ্রথা সমাজজীবনে কী ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করেছিল এ প্রহসন তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
মাইকেল মধুসুদন দত্ত: মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) প্রহসন রচয়িতা হিসেবে নাটকের চেয়ে বেশি শিল্পসফল। তাঁর ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ (১৮৬০) এবং ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো’ (১৮৬০) বাংলা নাট্যসাহিত্যে প্রহসনের মর্যাদা দাবি করতে পারে। প্রথম প্রহসনটির মধ্যে তৎকালীন ইংরেজি শিক্ষাভিমানী যুব সম্প্রদায়ের উচ্ছৃঙ্খলতা ও অনাচারের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। দ্বিতীয় প্রহসনটির মধ্যে অধর্মচারী লোকের ভণ্ডামি এবং চরিত্রহীনতার চিত্র বিদ্যমান।
দীনবন্ধু মিত্র (১৮৩০-৭৩): ‘নীলদর্পণ’ নাটকের স্রষ্টা দীনবন্ধু মিত্র সমাজসচেতন শিল্পী। সমসাময়িক জীবনের নানা অসংগতি তার প্রহসনের বিষয়বস্তু। তাঁর সধবার একাদশী প্রহসনে তৎকালীন সমাজের উচ্ছৃঙ্খলতা ও অনাচারের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। বিয়ে পাগলা বুড়ো (১৮৬৬) বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে লেখা প্রহসন। জামাই বারিক প্রহসনটি সামাজিক বিষয়াবলম্বনে রচিত। জামাতা পোষণ পদ্ধতিকে ব্যঙ্গ করে লেখা এ প্রহসনে যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।
মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১২): তৎকালীন সময়ে মুসলমানদের মধ্যে মীর মশাররফ হোসেন একজন শক্তিশালী নাট্যকার ছিলেন। প্রহসন রচনাতেও তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকে ‘এর উপায় কি’ প্রহসনটি রচনা করেন। সমাজের অনাচার ও উচ্ছৃঙ্খলার ব্যঙ্গাত্মক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এ প্রহসনে। তাঁর আরো কয়েকটি প্রহসন হচ্ছে ‘ভাই ভাই, এইতো চাই, ফাঁস, কাগজ, একি ইত্যাদি।
গিরিশচন্দ্র ঘোষ: বিখ্যাত নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষের হাতে বাংলা প্রহসনের দ্বিতীয় ধারার সূত্রপাত ঘটে। তৎকালীন সামাজিক অসংগতিকে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। তার প্রহসনগুলোর মধ্যে ‘সপ্তমীতে বিসর্জন’ ‘বেল্লিক বাজার’, ‘বড়দিনের বকশিস’, ‘সভ্যতার পাণ্ডা’ প্রভৃতি উল্লেখ করা চলে।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর: জ্যোতিরিন্দ্রনাথ প্রহসন রচনার ক্ষেত্রে বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তার প্রহসনের বিষয়বস্তু সমাজজীবন থেকে সংগৃহীত। তাঁর প্রহসনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কিঞ্চিৎ জলযোগ (১৮৭২), এমন কর্ম আর করব না (১৮৭৭), হিতে বিপরীত (১৮৯৬), হঠাৎ নবাব (১৮৮৪), দায়ে পড়ে দারগ্রহ প্রভৃতি।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়: প্রাচীন ও নবীন সম্প্রদায়ের উচ্ছৃঙ্খলতা ব্যঙ্গবিদ্রূপ সহকারে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এর প্রহসনে প্রকাশিত হয়েছে। তার প্রহসনে বিদ্রূপের কাঁটা তীক্ষ্ণভাবে বিদ্যমান। প্রহসনগুলোর মধ্যে কল্কি অবতার (১৮৯৫), বিরহ (১৮৯৭), প্রায়শ্চিত্ত (১৯০২), পুনর্জন্ম (১৯১১) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: বাংলা সাহিত্যে প্রহসন রচনায় রবীন্দ্রনাথের অবদান অতুলনীয়। তাঁর হাস্যরসে একটা সুসংহত পরিমিতিবোধ, একটা সযত্ন চেষ্টালব্ধ সুপরিপাটি শব্দবিন্যাস এবং অন্তঃশায়ী সুগূঢ় রসের ব্যঞ্জনা লক্ষণীয়। রবীন্দ্রনাথের প্রহসনগুলোর মধ্যে বৈকুন্ঠের খাতা (১৮৯৭), চিরকুমার সভা (১৯২৬), শেষ রক্ষা (১৯২৮), ব্যঙ্গকৌতুক (১৯০৭), হাস্যকৌতুক (১৯০৭) ইত্যাদি।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, সমাজজীবনের মধ্যে প্রহসনের প্রতিফলন ঘটে। চারপাশের জীবন এতে প্রতিফলিত হয় এবং হালকা আনন্দের স্পর্শ থাকে বলে প্রহসনের জনপ্রিয়তা অত্যন্ত বেশি। সমাজের নানা অন্যায় অসংগতি, মানুষের চারিত্রিক ত্রুটি এতে উপজীব্য হয় বলেই পাঠক-দর্শকদের মনে এর একটা প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে। এর সাহিত্যিক মূল্যের প্রতি পাঠক দর্শক যথেষ্ট মনোযোগী নয়। তবু সাহিত্যের অঙ্গনে এর স্থান বিস্তৃততর।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।
Leave a comment