প্রহসন একপ্রকার নাট্য সৃষ্টি যেখানে হাস্যরসময় জীবনের আলেখ্য রূপায়িত হয়ে উঠে। সমাজের কুরীতি সংশোধনের জন্য রহস্যময় ঘটনা সম্বলিত হাস্যপ্রধান একাঙ্কিকা নাটককে প্রহসন বলে। নানাবিধ সামাজিক সমস্যা এবং প্রাচীনপন্থি ও নব্য সমাজের মানুষদের চারিত্রিক অসঙ্গতিই প্রহসনের বিষয়। উনিশ শতকের গদ্যসাহিত্যে যে ব্যঙ্গাত্মক নকশা জাতীয় রচনার প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল, মনে হয় নাটকের আঙ্গিকে সেই জাতীয় বিষয় উপস্থাপনের চেষ্টা থেকেই প্রহসনের জন্ম। এতে চরিত্রের চেয়ে ঘটনা বিন্যাসের দিকে বেশি দৃষ্টি দেওয়া হয়।
উনিশ শতকের বাঙালি সমাজে একদিকে পুরুষের বহুবিবাহ অন্যদিকে বিধবা বিবাহরোধ, তদুপরি ইংরেজদের প্রভাবে কিছু উঠতি যুবক মদ্যপান, বেশ্যাসক্ত হয়ে সমাজের সাধারণ রীতিনীতি ও জাতি ধর্ম বিনষ্ট করে সমাজকে অধঃপতনের অতলে তলিয়ে দিচ্ছিল। তৎকালীন বিত্তবানদের কুৎসিত কার্যকলাপ এবং সমাজের কুপ্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে একের পর এক প্রহসন রচিত হয়।
বাংলা প্রহসনের বিকাশে প্রথমেই রামনারায়ণ তর্করত্নের নাম উল্লেখযোগ্য। তাঁর ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’-এ সামাজিক কৌলিন্য প্রথা এবং ‘নবনাটক’- এ বহুবিবাহ, ও বিভিন্ন সামাজিক কুপ্রথা বর্ণিত হয়েছে। মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘একেই কি বলে সভ্যতা’য় ইংরেজি শিক্ষিত যুব সম্প্রদায়ের উচ্ছৃঙ্খলতা এবং ‘বুড়ো সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসনে অধর্মচারী লোকের ভণ্ডামো ও চরিত্রহীনতার চিত্র বর্ণিত হয়েছে। দীনবন্ধু মিত্রের ‘সধবার একাদশী’তে তৎকালীন সমাজের উচ্ছৃঙ্খলতা ও অনাচারের চিত্র এবং জামাই বারিক প্রহসনে জামাতা তোষণ পদ্ধতিকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। মীর মশাররফ হোসেন তাঁর প্রহসনগুলোতে তৎকালীন সমাজের অনাচার ও উচ্ছৃঙ্খলাকে তুলে ধরেছেন। তাঁর রচিত প্রহসনগুলো হচ্ছে- ‘এর উপায় কি’, ভাই ভাই এইতো চাই, ফাঁস কাগজ, একি ইত্যাদি। গিরিশচন্দ্র ঘোষ তৎকালীন সামাজিক অসঙ্গতিকে অবলম্বন করে রচনা করেন-বেল্লিক বাজার, বড়দিনের বকশিস প্রভৃতি। জোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের উল্লেখযোগ্য প্রহসন হচ্ছে- কিঞ্চিত জলযোগ, এমন কর্ম আর করব না, হিতে বিপরীত, হঠাৎ নবাব ইত্যাদি। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রাচীন ও নবীন সম্প্রদায়ের উচ্ছৃঙ্খলতাকে ব্যঙ্গ করে তাঁর প্রহসনগুলো রচনা করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রহসন হচ্ছে- কল্কি অবতার, বিরহ, প্রায়শ্চিত্ত, পুনর্জন্ম ইত্যাদি। বাংলা প্রহসন রচনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান অতুলনীয়। তাঁর বৈকুণ্ঠের খাতা, চিরকুমার সভা, শেষ রক্ষা প্রভৃতি প্রহসন বাংলা প্রহসনের ধারাকে সমৃদ্ধ করেছে।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।
Leave a comment