প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪-১৮৮৩) টেকটাদ ঠাকুর ছদ্মনামে কয়েকটি গদ্যগ্রন্থ রচনা করেন, এবং ওই নামেই পরিচিত হন। সেকালের শিক্ষিত বাঙালি সমাজে প্যারীচাদ অগ্রগণ্য এবং মান্য-সম্মনীয় ব্যক্তি ছিলেন। নব্য চিন্তা ও ভাব-ভাবনা, স্ত্রীশিক্ষার প্রসার ও সমাজ সংস্কার নানা ক্ষেত্রে তার অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণযোগ্য। কৃষিবিদ্যা ও চর্চা, ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর দক্ষতার পরিচয় পাওয়া গেছে। এসবের ঊর্ধ্বে বাংলা গদ্যভাষায় বিবর্তনে তাঁর বিশেষ অবদান সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য, যার প্রভাব আজ পর্যন্ত অনুভূত হয়ে থাকে।
বন্ধু রাধানাথ সিকদারের সহায়তায় তিনি ‘মাসিক পত্রিকা’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন, — যার প্রধান লক্ষ্যই ছিল স্ত্রীশিক্ষার প্রসার। লেখ্য ও কথ্য ভাষায় একপ্রকার মিশ্রণ-রীতিই এই ‘মাসিক পত্রিকা’র প্রধান বিশেষত্ব ছিল।
অক্ষয়কুমার বিদ্যাসাগর এবং তাঁদের ভাষাশৈলীর উত্তরাধিকারীদের গুরুগম্ভীর সাধুরীতির ভাষা সহজ বোধগম্য হবে না বুঝতে পেরে, স্ত্রীলোক ও অল্পশিক্ষিত ব্যক্তিদের বোধগম্য এবং পাঠযোগ্য গদ্যভাষার কথা ভাবতে গিয়ে তিনি কলকাতার কথ্যভাষার ওপর নির্ভর করে ও তা অবলম্বন করে এই অভিনব গদ্যরীতির উদ্ভাবন ও ব্যবহারে ব্রতী হন। যদিও এই অভিনব ভাষারীতি তার পূর্বেও অল্পসল্প অবলম্বিত হতে দেখা গেছে, তথাপি আদ্যন্ত এই অভিনব ভাষরে সুষ্ঠু, সুসামঞ্জস এবং সুগঠিত পদান্বয়-সমন্বিত রূপ উদ্ভাবন ও প্রয়োগের কৃতিত্ব তারই প্রাপ্য।
প্যারীচাঁদের কয়েকটি গ্রন্থ আখ্যান-জাতীয় এবং উপদেশাত্মক; যেমন— ‘আলালের ঘরের দুলাল’ (১৮৫৮), ‘মদ খাওয়া বড় দায়, জাত থাকার কি উপায়’ (১৮৫৯), ‘রামারঞ্জিকা’ (১৮৬১), ‘অভেদী’ (১৮৭১), ‘আধ্যাত্মিকা’ (১৮৮০) ইত্যাদি।
এছাড়া কৃষিতত্ত্ব-বিষয়ক ‘কৃষিপাঠ’ তাঁর রচনাবলীর অন্তর্ভুক্ত। ‘যৎকিঞ্চিৎ’ ঈশ্বরতত্ত্ব-বিষয়ক আলোচনা গ্রন্থ। ‘রামরঞ্জিকা’, ‘অভেদী’, ‘আধ্যাত্মকা’ প্রভৃতি নীতিমূলক রচনা।’ ‘মদ খাওয়ার বড় দায়, জাত থাকায় কি উপায়’ গ্রন্থের বিষয় গ্রন্থনামেই স্বপ্রকাশ। অবশ্য এসব ছেড়ে যে গ্রন্থের জন্য টেকচাদ ঠাকুরের বিস্তৃত পরিচিতি, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিশেষ মর্যাদাপুর্ণ অবস্থান সেটিই তাঁর প্রথম রচনা ‘আলালের ঘরে দুলাল।’ মূলত এই গ্রন্থের ভাষারীতির প্রসঙ্গেই বঙ্কিমচন্দ্র লেখককে সাধুবাদ জানিয়ে তাঁর গদ্যভাষার মূল্যায়ন ও নির্ণয়ে মন্তব্য করেছিলেন : ‘সংস্কৃতপ্রিয়তা ও সংস্কৃতানুকারিতাহেতু বাঙ্গালা সাহিত্য অত্যন্ত নীরস, দুর্বল এবং বাঙ্গালী সমাজে অপরিচিত হইয়া রহিল। টেকচাঁদ ঠাকুর ঠাকুর (অর্থাৎ প্যারীচাদ মিত্র) প্রথমেই এই বিষবৃক্ষের মূলে কুঠারাঘাত করিলেন।
তিনি ইংরেজীতে সুশিক্ষিত, ইংরেজীতে প্রচলিত ভাষার মহিমা দেখিয়াছিলেন এবং বুঝিয়াছিলেন। তিনি ভাবিলেন, বাঙ্গালার প্রচলিত ভাষাতেই বা কেন গদ্যগ্রন্থ হইবে না। যে ভাষায় সকলে কথোপকথন করে, তিনি সেই ভাষায় আলারের ঘরের দুলাল প্রণয়ন করিলেন৷ সেইদিন হইতে বাঙ্গালা ভাষার শ্রীবৃদ্ধি, সেইদিন হইতে শুষ্ক তরুর মূলে জীবনবারি নিষিক্ত হইল।’ বস্তুত, বঙ্কিমচন্দ্রের কথা সর্বাংশে সত্য, এবং ‘বাঙ্গালার প্রচলিত ভাষা’র যে কী গুরুত্ব তা আমরা এখনও মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে থাকি।
প্যারীচাদ সুপরিকল্পিতভাবে যে ‘প্রচলিত রীতি’ বাংলা গদ্যে গ্রহণ করেছিলেন তারই মার্জিত-পরিশ্রুত অপেক্ষাকৃত সাহিত্যগুণ ঋদ্ধ গদ্যভাষাই উত্তরকালে বাংলা কথাসাহিত্যের অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিক থেকে প্যারীচাদের ভাষার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ইতিপুর্বে ‘কথোপকথন’ প্রভৃতি গ্রন্থে লোকের মুখের ভাষা উদাহরণ হিসাবেই মাত্র স্থান পেয়েছে, প্যারীচাদ সেই ভাষাকে আরও পরিণতিসহকারে সাহিত্যিক ভাষার আসনে সমর্যাদায় আসীন করেছেন। তাঁর গদ্যে সাধুরীতিটি কিন্তু সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হয়নি। সাধুভাষার কাঠামোটি ঠিকই আছে। কথ্য শব্দ এবং মাঝে মাঝে বাগ্ভঙ্গির প্রয়োগ করে তিনি তাকে সরল সহজ এবং বোধগম্য করে তুলেছেন।
আলাল-এর ভাষার সর্বোত্তম গুণ-বৈশিষ্ট্য, ‘সাহিত্যিক গদ্যকে জীবনের সান্নিধ্যবর্তী করার অতি আধুনিক আগ্রহ তাতে অঙ্কুরিত হতে আরম্ভ করেছিল।’ প্যারীচাদ যতদূর সম্ভব মুখের কথাকে বাক্যে প্রয়োগ করতে চেষ্টা করেছেন। সংস্কৃত শব্দ ও সমাসবদ্ধ পদের আড়ম্বর নেই। তদ্ভব ও দেশি শব্দের ব্যবহারের দিকে বেশি ঝোক। ছোট ছোট সরল বাক্যে কাজ সারতে পারলে জটিল যৌগিক বাক্যের দিকে ঝোকেন নি। দেশি, তদ্ভব শব্দের পাশাপাশি ধ্বন্যাত্মক শব্দের ব্যবহারে ভাষাকে গতিময় এবং জীবন্ত করে তুলতে চেষ্টা করেছেন। অভিশ্রুতি অপিনিহিত-স্বরসঙ্গতির ব্যবহারের চেষ্টা না থাকায় বুঝতে অসুবিধা হয় না যে সাধুরীতির সহজ-সুগম গদ্যরীতিটিই তাঁর অবলম্বনীয় মনে হয়েছিল, তবে সাধু সংস্কৃত-ভিত্তিক গদ্যভাষা নয়, কথ্যরীতির ভাষারীতিটিই তিনি পছন্দ করতেন। প্যারীচাদ বড় লেখক নন, কিন্তু ভাষার ক্ষেত্রে তাঁর আন্দোলন ও সচেতন ভূমিকা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
Leave a comment