“Young Dramatist এই পোড়ার দুঃখটারে তো খুঁইজ্যা বেড়াইতে হয় না। দুঃখটাতো নিজেই তোমারে খুঁজতে আছে; সেইটারে কিছুতেই পারসোনাল হইতে দিও না। আগুনের মধ্যে হাত বাড়াইয়া দিবা, তাইর পর ভাববা পুরাতাছে সারা দেশটা।” – উত্তপ্ত অভিজ্ঞতার উপাদান থেকে বাংলা নাটকের গণমুখী বলিষ্ঠ রূপ নির্মাণের কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন যিনি, তিনি প্রখ্যাত নট ও নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য। যুগচেতনার বিশেষ আবহে অভিজ্ঞতার ব্যাপ্তিও গভীরতা পায়। কারণ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের উত্তপ্ত পরিস্থিতি, দেশে স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম নীতি, মন্বন্তর বা দুর্ভিক্ষ, বিশ্ব আলোড়নকারী রুশ বিপ্লব, ভারতবর্ষে কমিউনিষ্ট পার্টির জন্ম (১৯২২) ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহে এই সময়টি ছিল সুচিহ্নিত। স্বভাবতই এক সংগ্রাম মুখর পরিবেশের মধ্যে বিজন ভট্টাচার্যের নাট্যসত্তা বিকশিত হয়। ভারতীয় গণনাট্য সংঘের প্রতিষ্ঠাকালে (১৯৪৩) ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টির ডাকা ফ্যাসিবিরোধী ‘জনযুদ্ধের আহ্বানে সাড়া দিয়ে নাট্যকাররূপে ঘটে তাঁর আত্মপ্রকাশ। যুদ্ধ, মন্বন্তর, ও বন্যায় বিধ্বস্ত সারা দেশ তখন অগ্নিগর্ভ। মুম্বাইতে ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের শাখা সংগঠন এদেশে বিভিন্ন জেলায় ও কলকাতায় স্থাপিত হয়। বিজন ভট্টাচার্য পার্টির এই সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে নাটক লিখে মঞ্চ নির্দেশনা দিয়ে এবং স্বয়ং অভিনয় করে তাঁর বৈপ্লবিক শিল্পীসত্তাকে প্রকাশ করেন।
বিজন ভট্টাচার্যের নাটক সমূহ :
ক) পূর্ণাঙ্গ : আগুন (১৯৪৩), জবানবন্দী (১৯৪৩), নবান্ন (১৯৪৪), অবরোধ (১৯৪৭), জুতুগৃহ (১৯৫২), দেবীগর্জন (১৯৬৬), ধর্মগোলা (১৯৬৭), সোনার বাংলা (১৯৭১), চলো সাগরে (১৯৭৭) মরা চাঁদ (১৯৭৮) ইত্যাদি।
খ) একাঙ্ক : মরা চঁাদ (১৯৪৬), কলঙ্ক (১৯৫০, জননেতা (১৯৫০), সাগ্নিক (১৯৬৮), চুল্লী (১৯৭৪), হাঁসখালির হাঁস (১৯৭৭)
গ) রূপকনাট্য: স্বর্ণকুম্ভ (১৯৭০)
ঘ) গীতিনাট্য : জীয়ন কন্যা (১৯৪৭) প্রভৃতি।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ তখনও অব্যাহত। গান্ধীজির আগষ্ট আন্দোলন তখনও সক্রিয় এবং তারা বিপরীতে ব্রিটিশ দমননীতি ভয়াবহ রূপে প্রকট। অন্যদিকে শুরু হয়েছে হিটলারের রাশিয়া আক্রমণ, জাপানের সাম্রাজ্যবাদী পাশবিক মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ, এদেশে শ্রমিক ধর্মঘট, নৌ বিদ্রোহ, হিন্দু মুসলমান ঐক্যের জন্য সংগ্রাম, আজাদ হিন্দ ফৌজের মুক্তির ছবি, চীনের মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি চাঞ্চল্যকর ঘটনাধারার প্রকাশ। এই জাতীয় আগষ্ট আন্দোলন, মন্বন্তর, বন্যা আর মহামারী কবলিত শহর ও গ্রাম বাংলার প্রেক্ষাপটে গণনাট্যের জন্ম। এই জাতীয় নাটকের কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য :
-
ক) নাটকে সুতীব্র রাজনৈতিক ও সামাজিক চেতনার প্রকাশ- শ্রেণী চরিত্র বিশ্লেষণ, শোষণের স্বরূপ উদ্ঘাটন এবং সমাজ বিপ্লবের স্বপ্ন।
-
খ) ব্যক্তিমূলক একক অভিনয়ের পরিবর্তে গোস্বামী ঐক্যের প্রকাশ – একক নায়কের অবসান।
-
গ) নৈরাশ্যবাদ ও জীবনের অর্থহীনতাকে প্রকাশ করাও তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম
-
ঘ) দেশে বিদেশে সমস্ত রকম অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রকাশ
-
ঙ) ব্যয়বহুল মঞ্চ সজ্জার রীতি পরিত্যাগ করে। সাধারণের উপযোগী স্বল্প ব্যয়ে নির্মিত মঞ্চোপকরণ ব্যবহার।
-
চ) গণসঙ্গীতের প্রচলন, গীতিকার ও সুরকারের বৈশিষ্ট্য ভূমিকা পালন
-
ছ) প্রতীকী অভিনয় মূকাভিনয় নাচ গান ইত্যাদির প্রয়োজনীয় প্রয়োগ প্রভৃতি।
গণনাট্য সংঘের উদ্যোগে অভিনীত হয় প্রথম নাটক বিজন ভট্টাচার্যের ‘আগুন’ নাটকটি। পরে এটি ‘অরণি’ পত্রিকায় মুদ্রিত হয়। আগুন নকশাধর্মী রচনা, কাহিনীর মধ্যে ধারাবাহিকতা অনুপস্থিত। খাদ্য সংকটের প্রাক্কালে খাদ্যের তথা চালের সমবন্টন কামনাই এই নাটকের মূল বক্তব্য। কৃষক, শ্রাগক, শহুরে মধ্যবিত্ত ওড়িয়া খদ্দের প্রভৃতি চরিত্রগুলির কোনটাই পূর্ণাঙ্গ নয়। এই অসম্পূর্ণতাই একে আশানুরূপ নাট্য সাফল্য দেয়নি।
‘জবানবন্দী’ একটি দরিদ্র কৃষক পরিবারের দুঃখময় কাহিনী। এই নাটকের বিষয়বস্তু নাট্যকারের ভাষায় : “সেও এক সোনার ধানের দুঃস্বপ্ন—মাঠের রাজা পরাণ মণ্ডল (জবানবন্দীর নায়ক) যে স্বপ্ন দেখতে দেখতে কলকাতার ফুটপাতে না খেতে পেয়ে হুমড়ি খেয়ে মরেছিল।”
গণনাট্য সংঘের সফল প্রযোজনা ‘নবান্ন’। বহুরূপী সম্প্রদায়ের প্রাণ পুরুষ শম্ভুনাথ মিত্র এবং বিমল ভট্টাচার্যের পরিচালনায় শ্রীরঙ্গমে (বর্তমানে বিশ্বরূপা) ১৯৪৪ খ্রীঃ ২৪শে অক্টোবর থেকে নাটকটি সাতদিন ধরে অভিনীত হয়। নাট্যকার নাটকটি রচনার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বলেন : ‘ঘরে সেদিন অন্ন ছিল না। নিরন্নের মুখ। চেয়ে সেদিন আমি নবান্ন লিখেছিলাম। নাটক আরম্ভ করেছিলাম ১৯৪২ সালের জাতীয় অভ্যুদয় আগষ্ট আন্দোলনকে স্বাগত জানিয়ে। আগষ্ট বিপ্লব, বন্যা ও সাইক্লোন, অন্নাভাব ও রোগ, গ্রাম ত্যাগ এবং উদ্বাস্তুরূপে শহরে এসে নিদারুণ অভাবে পরিবারের কর্তার মস্তিষ্ক, বিকৃতি নারী ব্যবসায়ীদের ফাঁদে পড়া কৃষক বধূর দুরবস্থা, লম্পট ব্যবসায়ীদের চিত্র, সরকারী প্রচেষ্টায় অনেক জনের গ্রামে ফেরা, চাষবাস করে নতুন ধানের ‘নবান্ন’ উৎসব পালন। বিকৃত মস্তিষ্ক কর্তাব প্রত্যাবর্তন এবং সকলের সমবেত শপথে ভবিষ্যৎ দুর্ভিক্ষ রোধের প্রতিজ্ঞায় নাটকটি সমাপ্তি ঘোষণা করেছে।
বিজন ভট্টাচার্যের অন্যান্য নাটকগুলির বিষয়বস্তুর মধ্যেও বৈচিত্র্য দেখা যায় : ‘দেবীগর্জন’ নাটকে মার্কসবাদ প্রাধান্য পেয়েছে। ‘মরাচঁাদ’, এক যুগ সচেতন রাজনৈতিক কর্মী অন্ধ হতাশ গায়ককে উদ্বোধন করার কাহিনী। ‘কলঙ্ক’ বাঁকুড়ার সাঁওতাল আদিবাসীদের জীবন নিয়ে লেখা নাটক। গোত্রাত্তর এর বিষয়বস্তু উদ্বাস্তুদের ভাগ্য বিপর্যয়ের কাহিনী। অবরোধে’ দেখা গেছে মিল মালিকের মুনাফা লোভ ও শ্রমিক শোষণের নগ্নরূপ। ‘জীয়নকন্যা’ মনসার ভাষাণ নিয়ে গীতিনাট্য, ‘গর্ভবতীজননী’ বাদা অঞ্চলের অধিবাসী বেদেদের ব্রতকথা নিয়ে লেখা নাটক। সাময়িক নৈরাশ্য কাটিয়ে মানুষের মতো বেঁচে থাকার জন্য যৌবন, বসন্ত শক্তির প্রকাশ দুটি ছেলে মেয়ের জীবন অবলম্বনে দেখানো হয়েছে ‘অকাল বসন্ত’ নাটকে।
অতএব বলতে হয়, বিভিন্ন ধরনের নাটক রচনার মধ্য দিয়ে বিজন ভট্টাচার্যের নাটকে দেখা গেছে– (১) শ্রেণী নির্যাতন ও শোষণ এবং জনগণের সংঘবদ্ধ বিদ্রোহ ও সংগ্রামের চিত্র (২) জীবন সম্পর্কে বলিষ্ঠ আশাবাদী চেতনা (৩) লৌকিক সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে প্রাণচেতনাকে রূপের পরিচয় (৪) বিষয় অনুযায়ী নাটকীয় আঙ্গিক ব্যবহার।
বাংলা নাটকে এই প্রবাদ প্রতীয় ব্যক্তিত্ব গণনাট্য ছেড়ে কেন চলচ্চিত্রে চলে গেলেন সে ইতিহাস আজও হয়তো তেমনভাবে লেখা হয়নি। বস্তুত গণনাট্যের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক, শম্ভু মিত্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং শেষে দূরত্ব, সত্তরের দশকের রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রভাবে নাট্য রচনায় পরিবর্তন ধারা ইত্যাদি প্রসঙ্গ গুলি নিয়ে পরিপূর্ণ তথ্যময় বিবরণ দিয়ে একখণ্ড ইতিহাস লেখা হতে পারে। তবু বাংলা গণনাট্যে তাঁর পথিকৃতের ভূমিকা কোনও মতেই বিস্মৃত হবার নয়।
Leave a comment